১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধারা যে সেতুটি ভেঙে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন সেটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক শুভপুর সেতু। স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশর বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশের একমাত্র সড়ক ছিলো বর্তমান পুরাতন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলা ও চট্টগ্রামের মীরসরাই, রামগড় ও খাগড়াছড়ি সংযোগ স্থাপনকারী এই সেতু দিয়েই তৎকালীন সময়ে সারা দেশের সাথে চট্টগ্রামে প্রবেশদ্বারে অবস্থিত এই সেতুর দখল নিয়েই ১৯৭১ সালে দফায় দফায় পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের। পাকিস্তান বাহিনী যাতে ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এই সেতু অতিক্রম করে চট্টগ্রাম প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য মুক্তিযোদ্ধারা যেমন সেতুটি ধ্বংসের চেষ্টা চালায় তেমনি সেতুটি রক্ষা ও দখলে রাখার জন্য ও পাক হানাদার বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতিবিজড়িত মীরসরাই ও ছাগলনাইয়া উপজেলার মধ্যবর্তি স্থানে ফেনী নদীর উপর অবস্থিত দীর্ঘদিন সংস্কারহীন থাকায় ৬৬ বছরের পুরনো শুভপুর সেতু ক্রমেই যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। যে কোনো মুহূর্তে এটি ভেঙে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের। ফলে যেকোনো মুহুর্তেই ঘটতে পারে বড় ধরণের দুর্ঘটনা।
জানা যায়, ১৯৫২ সালের দিকে আরসিসি স্লাবের ওপর বেইলি ট্রাস দিয়ে ফেনী নদীর ওপর ১২৯ মিটার দৈর্ঘ্যরে সেতুটি নির্মাণ করা হয়। পরে নদীর প্রশস্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৬৮ সালে সেতুটি আরও ২৪৯ মিটার স¤প্রসারণ করায় এর দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ৩৭৪ মিটারে।
সরেজমিনে দেখা যায়, শুভপুর সেতুর কাছেই বালু উত্তোলন করছে একটি সিন্ডিকেট চক্র। আর এতেই ব্রিজের সেতু মূল পিলার গুলোর নিচে থেকে মাটি সরে গেছে। ফলে সেতুটির পশ্চিমাংশ যেকোনো সময়ে ধসে পড়তে পারে। তাছাড়া প্রয়োজনীয় সংস্কার না করায় এর পাটাতনের ঢালাই নষ্ট হয়ে গেছে। লোহার রেলিং ও নাট-বল্টু খুলে চুরি করে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। এখন ছোট যানবাহন পার হলেও এটি কাঁপতে থাকে। দুর্ঘটনা এড়াতে ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে সড়ক বিভাগ। খুঁটি গেঁথে রাখায় বাস অথবা পণ্য বোঝাই ট্রাক এ সেতু অতিক্রম করতে পারে না।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় সেতুটির এক দিকে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। সেতুর ১০ নং পিলারে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এটিকে সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিলে চট্টগ্রাম অংশে হানাদারেরা ডুকতে পারেনি। তিনি জানান, এখনো সেতুর বিভিন্ন স্থানে গোলা-বারুদের চিহ্ন পাওয়া যাবে।
নিয়মিত এই সেতু দিয়ে যাতায়াত কারী বারইয়ারহাট পৌরসভার আনোয়ার এগ্রো সত্ত¡াধিকারী আনোয়ার হোসেন বলেন, ব্যবসায়ের কাজে প্রায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই সেতু দিয়ে যাতায়ত করতে হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্মুখ যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এবং ‘কলমিলতা’সহ বহু বাংলা ছায়াছবির ও স্বল্প দৈঘ্য ছায়াছবির শুটিং স্পট হিসেবে শুভপুর সেতু ব্যবহৃত হয়েছে। সেতুটি বয়সেরভারে রোগাক্রান্ত হওয়ায় কেউ এর খবর রাখে না।
বালাইনাশক কোম্পানী ম্যাকডোলান্ড-এর মার্কেটিং অফিসার আলাউদ্দিন বলেন, এ সেতুকে কেন্দ্র করে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এটি সংস্কার করলে সেই স্মৃতি রক্ষা পাবে। তবে তিনি আরো বলেন মহিপাল-বারইয়ারহাট সংযোগ সড়কটি ১৯৮৩ সালে পুনাঙ্গভাবে চালু হওয়ার পর থেকে রাস্তা সংস্কারের কাজের বাজেট বেশিভাগ নতুন রোডে হয়ে থাকে। তাই পুরাতন রোডে ঐহিতাসিক এই সেতুটি দিকে কারো নজর নেই।
এই সেতুটি নিয়ে সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী বর্তমান এমপি ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমার নিজের মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতিও রয়েছে এই ব্রিজে, আমি চেষ্টা করছি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত শুভপুর সেতুটি পুনঃনির্মাণ, নয়তো সংরক্ষণ করে বিকল্প সেতু নির্মান করার কথা ভাবছি। আমি মন্ত্রণালয়কে এর প্রস্তাবনাও দিয়েছি।
ফেনীর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৗশলী মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন জানান, শুভপুর সেতুটি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় পাশে আরেকটি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে সয়েল টেস্টও সম্পন্ন হয়েছে।
স্থানীয় করেরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন নয়ন বলেন, আমি সংশ্লিষ্ট সড়ক ও জনপথের কর্তৃপক্ষকে কয়েকবার জানিয়েছি সেতুটি মেরামতের জন্য। ব্রিজের এখন যে অবস্থা যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে নদীতে পড়বে। কিন্তু কেউ উদ্যোগ নিচ্ছে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন