জনবল সংকটে রয়েছে সাতক্ষীরার স্বাস্থ্য সেবা। চিকিৎসক সংকট, দুর্নীতি এবং অবহেলার কারণে চিকিৎসা খাতে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত স্বাস্থ্য সেবার দীর্ঘদিনেও কোনো উন্নতি নেই। মাত্র ৫১ জন ডাক্তার দিয়ে চলছে জেলার স্বাস্থ্য সেবা।
জানা যায়, ১০০ শয্যার সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে দৈনিক গড়ে ২০০ জন রোগী ভর্তি থাকেন। এছাড়া, সপ্তাহের অন্যান্য দিনে আউটডোরে প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসেন আরো ৬০০ থেকে ৮০০ জন রোগী। এমন একটি হাসপাতালে ডাক্তারের সংখ্যা মাত্র চার জন। আর উপজেলাসহ জেলার সকল হাসপাতালে ২০২ জন সরকারি ডাক্তারের স্থলে রয়েছেন মাত্র ৫১ জন ডাক্তার।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আধুনিক চিকিৎসার প্রচুর পরিমাণ সরঞ্জাম থাকার পরও শুধুমাত্র জনবল সংকটের কারণে রোগীরা যথার্থ সেবা পাচ্ছেন না। এমন অবস্থায় একজন সরকারি ডাক্তার তার নৈমিত্তিক দায়িত্ব ফেলে রেখে বেসরকারি ক্লিনিকে অথবা প্রাইভেট প্র্যাকটিসে সময় দিলে স্বাস্থ্যসেবা মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। আর এসব কারণে ভুক্তভোগী রোগীরা চিকিৎসা না পেয়ে গালিগালাজ করেন। এমনকি চিকিৎসকের ওপর হামলা চালান বলেও উল্লেখ করেন তারা।
চিকিৎসকরা বলেন, একজন ডাক্তার নাইট ডিউটি ছেড়ে ভোর ৬ টায় ফিরে আবারো সকাল ৮ টায় কাজে যোগদান করলে তার কাছ থেকে কতটা সেবা পাওয়া যাবে তা অনুমান করা সহজ। সাতক্ষীরা সরকারি মেডিকেল কলেজে এনাটমি ও ফিজিওলজিতে কোন শিক্ষক নেই। সেখানে এনাটমি পড়ান একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ। বেসিক সায়েন্স শিক্ষার সুযোগ কম আছে উল্লেখ করে তারা বলেন সেখানে মিড লেভেলের ডাক্তার কম। সাতক্ষীরা সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রয়োজনের ৫৭ জন ডাক্তারের বিপরীতে রয়েছেন মাত্র ১৬ জন । একজন রোগীর জন্য তিন শিফটে তিন জন ডাক্তার দরকার হয়। একই সাথে দরকার ৯ জন সেবিকাও। অথচ সেই জনবল এখানে নেই। সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে কেবলমাত্র এই জেলারই নয়, পাশর্^বর্তী খুলনা ও যশোর জেলা থেকেও অনেক রোগী এসে থাকে বলে জানান তারা।
স্বাস্থ্যসেবায় এমন বর্ণনা তুলে ধরে শনিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের বিএমএ ভবনে সাংবাদিকদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা তুলে ধরেন আয়োজকরা। এতে সভাপতিত্ব করেন স্বাচিপরে জেলা সভাপতি ডাঃ মোখলেছুর রহমান। এসময় তারা বলেন, এমবিবিএস পাস করার পর বিসিএসের অপেক্ষায় ৪ বছর শেষ করছেন একেক জন ডাক্তার। এ ব্যাপারে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের দীর্ঘসূত্রিতার উল্লেখ করে চিকিৎসকরা বলেন, এডহক ভিত্তিতে চিকিৎসক নিয়োগ ও পদায়ন না করা হলে স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন করার কঠিন হয়ে পড়েছে। সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে এক্সরে ফিল্ম থাকে না, ওষুধের সরবরাহও কম। একই সাথে একজন ডাক্তার যেমন জরুরী বিভাগের সেবা দিচ্ছেন তেমনি গভীর রাতে জরুরি কলেও সেবা দিচ্ছেন তিনি। এভাবে চিকিৎসা সেবা কাঙ্খিত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি। দুইজন কনসালট্যান্ট থাকলে সেবা বিঘিœত হতো না বলেও জানানো হয় মতবিনিময়ে।
চিকিৎসকরা বলেন, ১০০ শয্যার এই হাসপাতালে জনবল বরাদ্দ আছে ৫০ শতাংশ। অথচ বাস্তবে রয়েছে তারও অর্ধেক। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজেও একই সমস্যা বিরাজ করছে। জেলায় ৭০ থেকে ৭৫টি বেসরকারি ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। সেখানে চলছে চিকিৎসার নামে ব্যবসা। তারা কিভাবে সিভিল সার্জনের অনুমোদন পায় এ প্রশ্ন রেখে তারা বলেন, এখন থেকে সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত সরকারি কর্ম সময়ে কোন সরকারি ডাক্তার বেসরকারি ক্লিনিকে রোগী দেখলে তার বিরুদ্ধে এবং একই সঙ্গে ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই সময়ের মধ্যে কোন সরকারি ডাক্তারকে বেসরকারি ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে নিষেধ করেন তারা।
প্রায় সব উপজেলায় স্বল্প সংখ্যক ডাক্তার নিয়ে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে বলে মতবিনিময় সভায় উল্লেখ করা হয়। তারা আরো বলেন, প্রতি বছর গড়ে ২ হাজার ডাক্তার অবসরে যাচ্ছেন। অথচ সেই শূন্যস্থান পূরনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। যে কারনে চিকিৎসক সংকটে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হচ্ছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী প্রতি ১০ জন ভর্তি রোগীর পেছনে একজন ডাক্তার থাকতে হবে। সেই হিসাবে সাতক্ষীরায় ভর্তি হওয়া ২০০ রোগীর জন্য প্রতি শিফটে ২০ জন হলে দৈনিক দরকার ৬০ জন ডাক্তার। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সংখ্যা কমছে, বাড়ছে না জানিয়ে মত বিনিময় সভায় বলা হয়, পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে আরও বেশী গতিশীল করতে হবে।
তথ্য উপাত্ত তুলে ধরে তারা আরো বলেন, সদর হাসপাতালে প্রয়োজন ২৭ জনের স্থলে আছেন ৪ জন ডাক্তার, কালিগঞ্জে ২১ জনের বিপরীতে ৪ জন, আশাশুনিতে ২১ জনের বিপরীতে ৪ জন , কলারোয়ায় ৩৪ জনের স্থলে ৪ জন, তালায় ৩৩ জনের বিপরীতে ৭ জন, দেবহাটায় ১৬ জনের বিপরীতে ৫ জন এবং শ্যামনগর হাসপাতালে ৩৩ জনের স্থলে ৫ জন ডাক্তার রয়েছেন। । এসব হাসপাতালে প্রয়োজন ২০২ জনের স্থলে চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ৫১ জন।
জেলায় শতভাগ সরকারি ডাক্তারের মধ্যে আছে মাত্র ২৬ শতাংশ। মাত্র ৫১ জন সরকারি ডাক্তার দিয়ে জেলার স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন করা কঠিন উল্লেখ করে তারা বলেন, এজন্য দরকার জনবল বৃদ্ধি করা। দেশে রোগ এবং রোগী দুইই বৃদ্ধি পাচ্ছে জানিয়ে তারা বলেন এখন দেশের ১৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে রোগীরা সেবা পাচ্ছে। ডাক্তার আফম রুহুল হক স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালে পাঁচ হাজার ডাক্তারকে নির্বাহী আদেশে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এমনটি না করা হলে স্বাস্থ্যসেবায় নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে।
মতবিনিময় সভায় বক্তব্য রাখেন, স্বাচিপ সভাপতি ডা. মোখলেছুর রহমান, বিএমএ সভাপতি ডা. আজিজুর রহমান, স্বাচিপ সাধারণ সম্পাদক ডা. মনোয়ার হোসেন এবং বিএমএ সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. শামসুর রহমান। এতে আরো বক্তব্য রাখেন সিভিল সার্জন ডা. রফিকুল ইসলাম, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ডা. শাজাহান আলী এবং জেলা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক মালিক সমিতির সভাপতি ডা. হাবিবুর রহমান প্রমূখ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন