শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মহানগর

মনে হয় মৃতপুরী কিংবা ধূসর নগরী

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ৪:২৬ পিএম

নিমতলী ট্র্যাজেডি, তাজরিন গার্মেন্টস ট্র্যাজেডি, রানাপ্লাজা ধ্বস ট্র্যাজেডি, গুলশান ডিএনসিসি মার্কেটে অগ্নিকান্ড, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের অগ্নিকান্ডসহ প্রতিটা ঘটনার পর কোন উদ্যোগেই কার্যকর হয়নি
বাতাসে লাশের গন্ধ আর পোড়া ছাইয়ে মনে হচ্ছে কোনো প্রাচীন ধ্বংসস্তুপ, মৃতপুুরী কিংবা ধূসর নগরী। অসংখ্য মানুষের আনাগোনা থাকলেও কারো মুখে হাসি নেই। সকলের মুখেই কষ্টের ছায়া। পুরান ঢাকার চকবাজারের ওয়াহিদ ম্যানশন ও এর সংলগ্ন এলাকায় শুধু বহুতল ভবনগুলো নয়, রাস্তায় চলা প্রাইভেট কার, রিকশা-অকোরিকশা, মোটর সাইকেল ও টেলাগাড়ি সবই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে পড়ে আছে।
অথচ একদিন আগে গত বুধবার সন্ধ্যা পরেও হৈচৈ, অসংখ্য মানুষের আনাগোনা, মালামাল ওঠানো-নামানো, গাড়ি পোঁ-পোঁ হর্ন, রিকশার টুংটাং ঘন্টার আওয়াজ, সরু গলিতে রিকশা আর গাড়ির জটলা ইত্যাদি সবই ছিল। আর এখন শুধু মানুষের পোড়া কঙ্কাল, আসবাবপত্রের পোড়া ছাই পড়ে রয়েছে। ৬৪ নন্দ কুমার দত্ত রোড, চুড়িহাট্টার চতুর্থ তলা বিশিষ্ট হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনসহ আশপাশের ৫টি বহুতল ভবনে কোনো রংচঙ নেই। সবগুলো পুড়ে ধূসর রং ধারণ করেছে। কোনো তলার দেয়াল ভাঙা, বেরিয়ে আছে শুধু কংক্রিটের পিলার। কোনো তলায় খসে পড়েছে সব প্লাস্টার, গ্রিল বাঁকাচোরা, ভিতরে কোনো কিছু ছিল সেটাও বোঝার উপায় নেই।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহাম্মেদ খান দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, গত মঙ্গলবার রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের পাঁচ তলা ভবনের নিচ তলায় রাসায়নিক গুদামে আগুন ধরে যায়। আগুন দ্রুত একটি কমিউনিটি সেন্টারসহ আরও তিনটি ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। দমকল বাহিনীর ১৩টি ফায়ার স্টেশনের ৩৭টি ইউনিট চেষ্টা চালিয়ে রাত ৩টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
গতকাল নন্দ কুমার দত্ত রোড সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, চকবাজারের চুড়িহাট্টা মোড়টি একটা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। সড়কে দুটি পিকআপ ভ্যান, একটি প্রাইভেটকার, অসংখ্য রিকশা, ভ্যান, সাইকেল, মোটরবাইক, ঠেলাগাড়ি পুড়ে কঙ্কাল হয়ে পড়ে রয়েছে। এছাড়া ভেঙে পড়া কংক্রিটের দেয়াল, প্লাস্টিকের দানা ও পারফিউমের ক্যান পড়ে রয়েছে। চার রাস্তার মোড়ে উত্তর পাশে শাহী মসজিদ। বাড়িগুলোর সামনের গলির রাস্তায় গাড়ি, রিকশা, সাইকেল সবই আছে। তবে শুধু ফ্রেম, যাকে বলা যায় অন্তঃসার শূন্য কঙ্কাল। পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশ জুড়েই চকবাজার। কারাগারের অদূরেই অবস্থিত ওয়াহেদ ম্যানশনসহ ৫টি পুরো ভবন পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তুপে। বাড়ির মূল মালিক ওয়াহেদ হলেও তার দুই ছেলে আসাদ ও ােহেল বাড়িটির দেখাশোনা করতেন বলেই প্রাথমিকভাবে জানিয়েছেন আশপাশের লোকজন। এক ভাই থাকেন চিটাগাং। আরেকজন থাকেন পাশেই। তবে এ ঘটনায় তাদের কেউ মারা যাননি বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় পুরান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশ দিয়ে এগোতেই চোখে পড়লো শুধু ফায়ার সার্ভিসের স্পেশাল ওয়াটার টেন্ডারের সারি সারি গাড়ি। আকাশে টহল দিচ্ছিল সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীর দু’টি হেলিকপ্টার। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীদের পাশাপাশি আগুন নেভাতে আকাশ থেকে পানি ছিটিয়ে কাজ করে ওই দুই হেলিকপ্টার। পুড়ে যাওয়া ভবনের সামনে যেতেই দেখা গেল শুধু ধ্বংসস্তুপ। রাস্তায় পড়ে আছে জ্বলে ছারখার হওয়া কয়েকটি কার। তবে চালকের ভাগ্যে কি ঘটেছে, সেটা জানা যায়নি। গাড়ির পাশাপাশি পড়ে আছে অসংখ্য রিকশা, খসে পড়া ইট, দোকানের বিভিন্ন প্লাষ্টিক পণ্যসামগ্রী। বাতাসে ভাসছে পোড়া মানুষের গন্ধ।
প্রত্যক্ষদর্শী আকিল সাইদ (৪৩) দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আগুন লাগার সময় চুড়িহাট্টা মোড়টি যানজটে ঠাসা ছিল। একারণে রাস্তাতেই অনেকে পুড়ে মারা গেছেন। আগুন লাগা ভবনটির নিচতলার মার্কেটের করিডরের শেষ মাথা থেকে একসঙ্গে ২৪টি লাশ উদ্ধার করি আমরা। দেখে মনে হয়েছে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে তারা দৌড়ে গিয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এছাড়া আশেপাশের দোকান ও রেস্টুরেন্ট থেকেও লাশ উদ্ধার করা হয়।
স্থানীয় লোকজন দুঃখ ও ক্ষোভের সাথে বলেছেন, নিমতলী ট্র্যাজেডি, তাজরিন গার্মেন্টস ট্র্যাজেডি, রানাপ্লাজা ধ্বস ট্র্যাজেডি, গুলশান ডিএনসিসি মার্কেটে অগ্নিকান্ড, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের অগ্নিকান্ডসহ প্রতিটা ঘটনার পর কোন উদ্যোগেই কার্যকর হয়নি। বরাবরই দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার খতিয়ান বেরিয়ে এসেছে। চোখের সামনেই শত শত মানুষের জীবন ও সর্বস্ব হারানোর আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী হয়েছে। পরিবেশের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের উৎস এসব গুদাম ও কারখানা সরিয়ে নেয়ার কাজ করছেন না কেউ।
পুরো এলাকা ঘুরে ও স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ব্যবসায়িক কারণে অন্যতম ব্যস্ত এলাকা হিসেবে পরিচিত চকবাজারের চুড়িহাট্টা। এ এলাকাটিতে ঢোকার সড়কগুলো খুবই সরু। ফায়ার সার্ভিসের বড় পানিবাহী গাড়ি ঢুকতে না পারায় আগুন লাগার পরপরই বেগ পেতে হয় তাদের। প্রায় সাড়ে ৮ বছর আগে ঘটা পুরান ঢাকার নিমতলী ঘটনারই পুনরাবৃত্তি যেনো চকবাজারের চুড়িহাট্টার আগুন। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর নবাব কাটরায় একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরণ ঘটে। এতে একটি প্লাস্টিক কারখানায় আগুন ধরে যায়। ওই কারখানাতে ছিল বিপজ্জনক কেমিক্যাল। সেই আগুনে প্রাণ হারান ১২৪ জন মানুষ। আহত হন অর্ধশতাধিক। পুড়ে যায় অসংখ্য বসতবাড়ি, দোকান ও কারখানা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
NIBIR ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ৬:৪১ পিএম says : 0
Karkhanar malikder ki kora uchit ki korle ar kokhono agun lagbena
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন