বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মুক্তাঙ্গন

তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের জরুরি করণীয়

প্রকাশের সময় : ১৮ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সৈয়দা অনন্যা রহমান
বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী তামাক নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ। এ চুক্তির উদ্দেশ্য বিশ্বব্যাপী সব ধরনের তামাকের ব্যবহার সীমিত করার লক্ষ্যে কিছু সার্বজনীন মাত্রা নির্ধারণ করে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তামাক গ্রহণের কারণে উদ্ভূত মারাত্মক স্বাস্থ্যগত, সামাজিক, পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা।
আর্টিকেল ৫.৩ তে উল্লেখ করা হয়েছে “তামাক নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত জনস্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে রাষ্ট্রসমূহ জাতীয় আইন অনুযায়ী তামাক কোম্পানীর বাণিজ্যিক এবং অন্য কায়েমি স্বার্থ থেকে এই নীতিমালা রক্ষার দায়িত্ব পালন করিবেন”। এবং এ আর্টিক্যালে তামাক কোম্পানী বলতে, সকল প্রতিষ্ঠান, সত্ত্বা, সমিতি এবং ব্যক্তি যিনি তামাক কোম্পানীর জন্য বা তামাক কোম্পানীর পক্ষে কাজে নিয়োজিত আছে, যেমন কিন্তু সীমাবদ্ধ নয়, তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী, পাইকারি বিক্রেতা, পরিবেশক, আমদানীকারক, তামাকজাতদ্রব্য চাষী, খুচরো বিক্রেতা, ফ্রন্ট গ্রুপ এবং অন্য কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানসহ কিন্তু সীমাবদ্ধ নয়, যেসব আইনজীবী, বিজ্ঞানী ও তদবিরকারী তামাক কোম্পানীর স্বার্থ উদ্ধারে কাজ করে তামাক কোম্পানীর অন্তর্ভুক্ত থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
তামাক নিয়ন্ত্রণসহ সকল নীতিকে তামাক কোম্পানীর প্রভাবমুক্ত রাখা সরকার ও প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য। মুনাফাভোগী তামাক কোম্পানীর স্বার্থ এবং জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে নীতিসমূহের স্বার্থ বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক। দুপক্ষের মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। আর্টিক্যাল ৫.৩-এর নির্দেশনা অনুসারে রাষ্ট্রসমূহ তামাক কোম্পানী বা তাদের সহযোগীদের সঙ্গে কোন ধরনের আলোচনা করলে তার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সেই সাথে এ নির্দেশনায় আরো উল্লেখ রয়েছে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বেগবান করতে স্বাস্থ্যহানীকর তামাক পণ্য উৎপাদনে তামাক কোম্পানীগুলোকে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠা বা পরিচালনার জন্য কোনরূপ পৃষ্ঠপোষকতা বা সহযোগিতা প্রদান করা যাবে না
আন্তর্জাতিকভাবে এই চুক্তিটির গুরুত্বপূর্ণ এই ৫.৩ আর্টিকেলের নির্দেশনাসমূহের বাস্তবায়ন তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে শুধু তামাক কোম্পানীর প্রভাবমুক্ত রাখতে কার্যকরই নয় পাশাপাশি তামাক কোম্পানীর কাছ থেকে যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সুবিধা নেয়Ñ তাদের কাছ থেকেও তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে সুরক্ষা করার জন্য এই জরুরি। এ নির্দেশনায় তামাক নিয়ন্ত্রণ ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন সংক্রান্ত নীতিসমূহকে তামাক কোম্পানীগুলোর প্রভাবমুক্ত রাখতে বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ সফল অভিজ্ঞতা ও বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তকে এই সন্নিবেশ করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা অনুসারে বিশ্বের কয়েকটি দেশে এফসিটিসির আর্টিক্যাল ৫.৩ বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তার মধ্যে থাইল্যান্ড বহুজাতিক তামাক কোম্পানীর হস্তক্ষেপ প্রতিহত করার জন্য এফসিটিসির অধিকাংশই বাস্তবায়নের মাধ্যমে সফলতা অর্জন করেছে। তারা বর্তমানে তামাক কোম্পানীর তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রণয়নে বিলম্ব, বিঘিœত ও দুর্বল করার কৌশল চিহ্নিত এবং তা প্রতিহত করার পদ্ধতির উন্নতি সাধন করে যাচ্ছে। তামাক কোম্পানীগুলোর কৌশল প্রতিহত করার জন্য থাইল্যান্ডে জনস্বাস্থ্য কমিউনিটি কর্তৃক গত দুই দশক ধরে সতর্ক নজরদারি চালানো, নীতিনির্ধারণী সভা থেকে তামাক কোম্পানীকে বাদ দেওয়া, তামাক কোম্পানীর পণ্য বিক্রয় ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা, তামাক কোম্পানীর উপর চাপ বজায় রাখা এবং কার্যকরভাবে নিয়মনীতি প্রয়োগে সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার এই পাঁচটি কৌশল ব্যবহার করে আসছে।
ফিলিপাইনে আর্টিক্যাল ৫.৩তে স্বাস্থ্য বিভাগ, সিভিল সার্ভিস কমিশন এবং বিভিন্ন এনজিও এর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক, উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারক, সিভিল সার্ভিস কমিশন ও রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি, সুশীল সমাজ ও এনজিও প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ২০০৯ সালে স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনে আনুষ্ঠানিকভাবে আর্টিকেল ৫.৩-এর নির্দেশিকার বাধ্যবাধকতা বাস্তবায়নে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সাথে নিয়মিত স্বাক্ষাৎ, আন্তঃসংস্থা সংযোগ স্থাপন, নীতিনির্ধারণ এবং যোগাযোগের জন্য একটি দল গঠন করেছে। এই দলটি সরকারি সংস্থার সাথে বৈঠকের মাধ্যমে আর্টিক্যাল ৫.৩ বাস্তবায়নের বিষয়গুলো নিশ্চিত করে। এই কমিটি আর্টিক্যাল ৫.৩ সম্পর্কিত ফ্যাক্টশিট, পোস্টার, ভিডিও, গণমাধ্যমের জন্য উপকরণ তৈরী করে।
বাংলাদেশেও তামাক কোম্পানীগুলো জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে গৃহীত কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করতে প্রতিনিয়ত অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধির সময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে তামাক কোম্পানীগুলোকে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করতে দেখা যায়। অতীত অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের প্রাক্কালে বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচির ভাবমূর্তি ব্যবহার করে মহান জাতীয় সংসদ এলাকায় বৃক্ষ রোপণের প্রচেষ্টা নিয়েছিল বিএটি। তামাক কোম্পানীগুলোর এ ধরনের কার্যক্রম মূলত নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করার একটি প্রক্রিয়া বলেই মনে করে তামাক বিরোধী সংগঠনগুলো।
তামাক কোম্পানীর অপকৌশল থেকে নীতি ও আইন প্রণয়নকে সুরক্ষা দিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি এফসিটিসি তে আর্টিক্যাল ৫.৩ যুক্ত করেছে। বাংলাদেশ যেহেতু আন্তর্জাতিক এ চুক্তিটি স্বাক্ষর ও অনুস্বাক্ষর করেছে সে ক্ষেত্রে সরকারের এ আর্টিক্যালের নির্দেশনা অনুসরণ করার দায়বদ্ধতা রয়েছে। তামাক কোম্পানীর হস্তক্ষেপ সম্পর্কে জনগণ এবং সরকারের সকল শাখার কর্মকর্তাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে নি¤œ লিখিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
১. তামাক নিয়ন্ত্রণ ও তামাক কোম্পানীসমূহের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন ছাড়া এ ধরনের কোম্পানীর সাথে সবরকম যোগাযোগ এড়িয়ে চলতে হবে। আলোচনার প্রয়োজন হলে তার স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণে উদ্যোগ গ্রহণ। ২. তামাক কোম্পানীর পৃষ্ঠপোষকতায় তামাক নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ গ্রহণ, নীতিমালা তৈরি ও বাস্তবায়নে তামাক কোম্পানীর সঙ্গে সব ধরনের অংশীদারিত্বমূলক ও অপ্রয়োগযোগ্য কার্যক্রম বর্জন। ৩. তামাক কোম্পানী ও জনস্বার্থের সংঘর্ষ এড়াতে সরকারি কর্মকর্তা/ কর্মচারীদের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন। ৪. তামাক কোম্পানীকর্তৃক প্রদানকৃত তামাক উৎপাদন, বিক্রয়, রাজনৈতিক অনুদান, তদবির ইত্যাদি বিষয়ে সরকারকে তথ্য দেয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও সত্যতা নিশ্চিতকরণ। ৫. তামাক কোম্পানী কর্তৃক আয়োজিত “সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি”র আড়ালে তামাক কোম্পানীর প্রচারণার অপকৌশল ও অপচেষ্টাকে প্রতিহতকরণ। ৬. স্বাস্থ্যহানীকর তামাক উৎপাদনকারী কোম্পানীগুলো প্রতি কোনরূপ সুবিধা বা পক্ষপাতমূলক আচরণ থেকে বিরত থাকতে হবে। ৭. অন্যান্য তামাক কোম্পানীর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তামাক কোম্পানীকেও আইনগতভাবে নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ গ্রহণ।
ষ লেখক : প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ডব্লিউবিবি ট্রাস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন