আলী এরশাদ হোসেন আজাদ
অনেক হতাশা, আক্ষেপ-অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে এমপিওভুক্তগণের বকেয়াসহ নতুন বেতনস্কেল প্রাপ্তি আশার দ্যুতি ছড়াচ্ছে। এজন্য ‘আন্দোলন আন্দোলন মহড়া’ হয়ে গেলেও এমপিওভুক্তগণের ভাগ্যে জুটলো না বৈশাখীভাতা। তারা যে গ্লানিকর উৎসবভাতা পান তা ঘোচানোরও নেই কোনো আশাবাদ, নেই সুরঙ্গের মুখে আলোর দিশা। বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজই সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র পেশাজীবী যারা ‘সিকিভাগ’ (২৫%) উৎসবভাতা পান। অনেকের মনে হতে পারে আট মাসের বকেয়াসহ নতুন বেতনস্কেল প্রাপ্তির আনন্দিত মুহূর্তে এমন হতাশার কথা বেমানান। অথচ রূঢ় বাস্তবতা হলো বকেয়ার বিপুল অর্থ আমরা সবাই আগাম খরচ করে ফেলেছি। আসন্ন রমজান ও ঈদ ভাবনায় খুবই প্রাসঙ্গিক যে, ঈদের আগে সরকার জুনের বেতন ও ঈদ বোনাসের অর্থ হয়তো ছাড় করবেন। তবুও অনেকেই হয়তো জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে টাকা হাতে পাওয়ার আগেই শাওয়ালের চাঁদ দেখবেন। বকেয়াসহ নতুন স্কেল প্রাপ্তির আনন্দে কি বাস্তবতা ও বঞ্চনার জ্বালা ভুলে থাকবো? যখন রমজান ও ঈদ ভাবনায় শিক্ষকসমাজ দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্ব গতিতে নাকাল। কাজেই, বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীবৃন্দের জন্য পূর্ণাঙ্গ (১০০%) উৎসবভাতার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করছি।
দেশ এখন এসডিজি অর্জনের পথে এবং মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় নাম লেখাতে যাচ্ছে। দেশে ‘পাখি ড্রেসের’ জন্য আত্মহত্যা, ডিভোর্সের ঘটনা ঘটে। তাজরীন, তোবা গ্রুপ বা রানা প্লাজার ঘটনায় আলোড়িত হয় দেশ-দুনিয়া। কিন্তু একজন শিক্ষক আলো ছড়িয়ে নিজেই কি থেকে যাবেন অন্ধকারে? কে শোনাবে মানুষ গড়ার কারিগরদের আশার বাণী? পেশাগত স্বার্থে শিক্ষকদের মলিন জীবনে ত্যাগ ও সংগ্রামী অভিযাত্রা দীর্ঘতর হোক তা কাম্য নয়। তাই সময় ও বাস্তবতায় শিক্ষকসমাজ অধিকারের আওয়াজ তুলে তুলে ক্লান্ত ও নিরাশ হয়ে বর্তমানে এক-একাত্ম আওয়াজে মুখরÑ যা হলো: ‘শিক্ষা জাতীয়করণ’।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন পদের সবাই একই পরিমাণ বাড়িভাড়া পান। তারা বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট, পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল সুবিধা পান না, তারা পদোন্নতি, স্বেচ্ছা অবসর, বদলি সুবিধাসহ অসংখ্য বঞ্চনার শিকার। এমনকি প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদায়নে অনুপাত নামক কালো আইনের কারণে অধিকাংশের পথচলা দুর্ভাগ্যের কাদায় আটকে আছে! কলেজে অধ্যাপনারতদের সসম্মানে ‘অধ্যাপক’ বলা হলেও ‘সহকারী অধ্যাপক’ পর্যন্ত যাওয়ার সামান্য সুযোগ থাকলেও আইনগতভাবে ‘সহযোগী অধ্যাপক’ বা ‘অধ্যাপক’ হওয়ার অধিকার তাদের নেই! মানুষ গড়ার কারিগরদের মাসিক বাড়িভাড়া বাবদ সরকারি বরাদ্দ মাত্র পাঁচশ টাকা ও চিকিৎসাভাতা তিনশ টাকা। যা নিতান্তই অপ্রতুল ও হাস্যকর।
বঞ্চনায় নিমজ্জিত সাধারণ শিক্ষক সমাজ কবে বাঁচার ন্যূনতম সুযোগ পেয়ে উৎসবে হেসে উঠবে? বিনা চিকিৎসায় ধুকবে না? মাথা গোজার ঠাঁইটুকুর জন্য অস্থির হবে না? ‘প্রভাষক’ নামক একই পদে বিশ-পঁচিশ বছর থেকেও কি একেকজন ‘বয়োবৃদ্ধ প্রভাষক’ হিসেবেই তারা কবরে যাবেন? স্কুল-মাদ্রাসা শিক্ষক ও কর্মচারীদের বহু বৈষম্য-বঞ্চনার কি কোন সমাধান নেই? নন-এমপিওগণের ভাগ্যেই বা কী আছে? শিক্ষা জাতির মেরুদ-Ñ জাতিকে খাড়া ও সোঝা রাখার শক্তি জোগায় ‘মানুষ গড়ার কারিগর’গণ, তাদের অবস্থান যতো মজবুত হবে জাতি ততোই দাঁড়াবে শক্ত ও সোজা হয়ে। অথচ চির বঞ্চনাই যেন তাদের ভাগ্যলিপিÑ
“আমি যেন সেই ভাগ্যাহত বাতিওয়ালা
পথে পথে আলো দিয়ে বেড়াই
কিন্তু নিজের জীবনেই অন্ধকার মালা”।
(আশরাফ সিদ্দিকী)
সরকারি প্রাথমিক স্কুলের প্রধানদের পদমর্যাদা ২য় শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়েছে। এতেও তো সামাজিক বৈষম্যের নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হলো। যেখানে একজন কলেজ শিক্ষক (প্রফেসর) এমপিও বা নন-এমপিও হয়ে অনার্স-মাস্টার্স তথা উচ্চ শ্রেণিতে পাঠ দেন অথচ এসব কলেজ শিক্ষকÑ ‘আমৃত্যু প্রভাষক’ থাকাই যেন তাদের ভাগ্য লিখন! আর সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকগণ ‘গেজেটেট’। মানবিক কারণে দ্রুতই অনার্স-মাস্টার্সের শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি খুবই জরুরি। একইভাবে অনুপাত প্রথার গ্যারাকলে আটকে থাকা বিশ-পঁচিশ বছর যারা ‘প্রভাষক’ নামের একই পদে থেকে জীবন-যৌবন হারিয়েছেন সঙ্গে চরম আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন তাদেরকে জরুরি ভিত্তিতে ‘সম্মানসূচক’ পদোন্নতি দেওয়ার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ যারা শূন্য পদে যোগ দিয়েছেন তাদেরও অনেকের এমপিওভুক্তি ঝুলেই থাকছে অজ্ঞাত কারণে বছরের পর বছর। আইসিটি ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস যথাক্রমে এইচএসসি ও ডিগ্রি পর্যায়ে সব গ্রুপের সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হলেও বিষয় দুটির জন্য পদ সৃষ্টি/পদায়ন ও এমপিওভুক্তি হচ্ছে কি? স্কুল-মাদ্রাসায় এমনতর পেশাগত বঞ্চনার চিত্র আরো করুণ।
বর্তমান সরকারের সময়ে প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণসহ বেশ কিছু স্কুল-কলেজ জাতীয়করণের সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কয়েকটি কলেজ সরকারি হওয়াসহ বেশ কিছু স্কুল বিচ্ছিন্নভাবে সরকারিকরণের খবর শোনা গেল। বলা হচ্ছে জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় ও সব উপজেলায় একটি স্কুল-কলেজ সরকারিকরণের কথা। কিন্তু তা কবে, কোন নীতিতে? তাতে কি সব উপজেলা সদরের একটি কলেজ ও স্কুল এক ঘোষণায় আগামী অর্থবছরের সূচনায় সরকারি হবে?
যখন তখন যেখানে সেখানে সরকারিকরণ না করার সান্ত¡না হিসেবে মফস্বলের কলেজে দু-একটি বিষয়ে অনার্স খুলেই ‘বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’ সাইনবোর্ড! এখানেও ‘বৈষম্যের আরেকটি গ্রেটওয়াল’ হলো বেসরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্স খোলার জন্য সরকার ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় উৎসাহ জোগায় কিন্তু অনুমতির শর্তেই থাকে এমপিও দেওয়া হবে না। ফলে মেধাবীগণ উৎসাহ হারান... শিক্ষক সংকট ও শিক্ষার মানের প্রশ্ন(!) নিয়েই চলে গ্রামাঞ্চলে উচ্চশিক্ষা। দেশে শিক্ষকের অসংখ্য পদ শূন্য। নিয়োগের নতুন পদ্ধতির কারণে দীর্ঘকাল শিক্ষক সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা অনিশ্চয়তার শেষ কবে?
জাতীয় বেতন স্কেলেÑ বাড়ি ভাড়া, যাতায়ত ভাতা, গাড়ির সুবিধা, শিক্ষা সহায়ক ভাতা, টিফিন ভাতা, শ্রান্তি ও বিনোদন ভাতা, ধোলাই ভাতা, কার্যভার ভাতা, গৃহকর্মী ভাতা, পোশাক পরিচ্ছদ সুবিধা, পাহাড়ি ও দুর্গম ভাতা, আপ্যায়ন ভাতা, ভ্রমণ ভাতা, আবাসন ভাতা ও গৃহনির্মাণ ঋণ, সমৃদ্ধ সোপান ব্যাংকসহ অসংখ্য আকর্ষণীয় সুবিধাদির পাশাপাশি ঢাকা মহানগরীতে বসবাসরত সরকারিদের মৃত্যুর পর দাফনের জন্য বেশ কয়েকটি কবরস্থান নির্মাণের সুপারিশও রয়েছে। এগুলোও হয়তো আগামী অর্থবছর থেকে কমবেশি বাস্তবায়িত হবে। এসব সুবিধাদিতে এমপিওভুক্তদের অন্তর্ভুক্তি মানবিক কারণেই জরুরি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইউনেস্কো ১৯৬৬ সালের প্যারিস সম্মেলনে ১৩টি অধ্যায় ও ১৪৬টি ধারা-উপধারায় শিক্ষকের মর্যাদা ও অধিকারের সুপারিশ প্রণীত হয়। যাতে শিক্ষকের চিকিৎসা- স্বাস্থ্যসেবা, ছুটি বেতন-ভাতা ও মর্যাদার ক্ষেত্রে বলা আছে (ক) সম্মানজনক পারিতোষিক নিশ্চিতকরণ (খ) যুক্তি সঙ্গত জীবনমান বিধানকল্পে সুবিধাদি নিশ্চিতকরণ (গ) স্কেল অনুযায়ী নিয়মিত বেতন-ভাতাদি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা (ঘ) জীবনধারণের ব্যয়বৃদ্ধির সঙ্গে বেতন কাঠামো পুনঃবিন্যাস ও বর্ধিত বেতন প্রাপ্তির নিশ্চয়তা ইত্যাদি। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষক স্বার্থে বিনিয়োগ যৎসামান্য এবং শিক্ষকের অধিকার নি¤œগামী।
বস্তুত বাঁচার সংগ্রামে, বঞ্চিত ও অবহেলিত শিক্ষকসমাজ ‘শিক্ষা জাতীয়করণে’র আওয়াজে ঐক্যবদ্ধ হলেও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দলীয় লেজুড়বৃত্তির কারণে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। অন্যদিকে শিক্ষক নেতৃবৃন্দ হয়তো এ বিষয়ে একমত যে, ‘তারা কখনো ঐক্যবদ্ধ হবেন না’! পরিশেষে অপেক্ষা, আসন্ন বাজেটে এমপিওভুক্তদের বৈশাখীভাতা (বকেয়াসহ), ১০০% উৎসবভাতা, শিক্ষা জাতীয়করণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ ও ঘোষণা থাকবে। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের ভাগ্যবিড়ম্বনার অবসানে শিক্ষক দরদী প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট ঘোষণাই পারে সবার মুখে হাসি ও বুকে সাহস জোগাতে। কেননা, শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার এবং শিক্ষকের সম্মান সবার উপরে।
ষ লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন