খাদ্যই প্রাণ শক্তির আধার। খাদ্য গ্রহণ করে আমরা শরীর রক্ষা পালন ও বৃদ্ধি করে থাকি। খাদ্যসার গ্রহণ করে দেহ পুষ্টি ও রোগ মুক্ত হয়। আবার ত্রুটিপূর্ণ খাদ্য খেলে দেহ অসুস্থ হয়ে ওঠে। তাই সকল পেশার লোকেরই খাদ্য গ্রহণ সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান থাকা বাঞ্চনীয়। খাদ্যের সাহায্যে রোগ নিরাময় করাকে বলে ডায়েটোথেরাপি। উপযুক্ত খাদ্য গ্রহণে শরীর থেকে অনেক রোগ দূর হয়। আসলে ডায়োটোথেরাপির নীতি হলো রোগের প্রতিকারের চেয়ে রোগ প্রতিরোধ করা। তাই রোগ যাতে না হয় সেজন্য ঠিকমতো খাদ্য খাওয়া উচিত। রোগ হয়ে গেলে তা নিরাময় করা কষ্টকর। উপযুক্ত খাদ্যের মধ্যে শাকসবজি গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা প্রদানকারী খাদ্য এবং সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা ও রোগ প্রতিরোধে বিরাট ভূমিকা পালন করে। আমাদের দেহে ক্ষারীয় অবস্থা বজায় রাখতে শাকসবজি খুবই প্রয়োজনীয় খাদ্য। এতে উচ্চ মাত্রায় ভিটামিন এ, বি, সি, ই, কে খনিজ পদার্থ থাকে। সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য প্রত্যেকের প্রতিদিন ২৮০ গ্রাম শাকসবজি খাওয়া আবশ্যক। এর মধ্যে পাতা সবজি শতকরা ৪০ ভাগ, মূলীয় ও কন্দ জাতীয় সবজি শতকরা ৩০ ভাগ ও অন্যান্য শাকসবজি যেমন বেগুন, ঢেঁড়স ইত্যাদি বাকি শতকরা ৩০ ভাগ হওয়া উচিত। আমরা যে সবজি খাদ্য গ্রহণ করে থাকি তার মধ্যে আমাদের অতি পরিচিত একটি সবজির নাম বেগুন। সারা বছরই বেগুন ফলানো ও পাওয়া যায়। তবে শীতকালে এটি বেশী ফলে এবং বেশী পাওয়া যায়। আসলে আমাদের নিকট বেশ অবহেলার একটি তরকারি হলো বেগুন।
রাসায়নিক উপাদান ঃ বেগুন অত্যাত্য পুষ্টিকর সবজি। বেগুনের পাতায় রাইবোফ্ল্যাডিনে সমৃদ্ধ। এতে আরো আছে নিকোটিনিক এসিড, ভিটামিন সি, বিটা-ক্যারোটিন, সোলাসোনিন ও সোলামর্জিন ফলে থাকে যা আমরা সবজি হিসেবে আমরা খাই তাতে থাকে স্যাপোনিন স্টেরয়েডীয় গ্লাইকো-উপক্ষার, সোলানিন, সোলামার্জিন, সোলা সোনিন, আলফা ও বিটা-সোলানিগ্রিন, সোলাসোডিন, স্টেরয়েডীয় জেনিন, ট্রাইজোনিন খনিজ পদার্থ ও এনজাইম পাওয়া যায়।
পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, প্রতি ১০০ গ্রাম খাবার উপযোগী বেগুনে পুষ্টি উপাদান হলোঃ- আমিষ ১.৮ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ৪ গ্রাম, চর্বি ২.৯ গ্রাম, আঁশ ১.৩ গ্রাম, ভিটামিন এ ৮৫০ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন বি-১ ০.১২ মিলিগ্রাম, বি-২ ০.০৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ১২ মিলিগ্রাম, খনিজ লবণ ০.৮ গ্রাম, আয়রণ ০.৯ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৮ গ্রাম, পটাশিয়াম ২০০ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ৪৭ মিলিগ্রাম, নিকোটিনিক এসিড ০.৯ মিলিগ্রাম, খাদ্যশক্তি ৪২ কিলোক্যালরি। সুতরা আমরা প্রতিনিয়ত বেগুন খেয়ে দেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে পারি।
উপকারিতা ঃ বেগুন শরীরের পুষ্টি পূরণের প্রয়োজনীয় সবজি। বেগুনে ভিটামিন এ, বি, সি, ই, কে প্রোটিন শর্করা আয়রন খনিজ পদার্থ কার্বোহাইড্রেট, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম আছে। যা শরীরের জন্য খুবই প্রয়োজন। আমাদের রক্তে ফ্রি রেডিক্যাল নামে এক ধরনের ক্ষতিকর উপাদান সৃষ্টি হয় বেগুন খেলে তা ধ্বংস হয়ে যায়। বেগুনে নাসুনিন নামে এক ধরনের ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট রয়েছে। যা মস্তিষ্কের শিরা উপশিরার দেয়ালে চর্বি জমতে দেয় না। ফলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ জনিত রোগ বা ব্রেইন স্ট্রোক দূর হয়। মস্তিষ্কের রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা ও সরবরাহ বৃদ্ধি পায়। ফলে আমাদের কাজের গতিবৃদ্ধি পায়। বেগুনে উচ্চ মাত্রায় আঁশ থাকে যা পেটের অসুখ, হজম ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। এটি একটি ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার। এতে থাকা ভিটামিন এ চোখের জন্য খুবই উপকারী। চোখকে যাবতীয় রোগ থেকে বাঁচিয়ে রাখে এবং দৃষ্টি শক্তি প্রখর করে। এর নানা রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা আছে। এতে এক ধরনের এসিড থাকে যা শরীরে প্রবেশ করা রোগ জীবাণু ও টিউমার সৃষ্টির জীবাণু ধ্বংস করে। এতে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়ামও থাকে যা দাঁতকে মজবুত করে এবং দাঁতের মাড়িকে শক্তিশারী ও মজবুত করে তোলে। নখের ভংগুরা রোধ করে। হাঁড়ের গঠন শক্তিশালী করে গড়ে তোলে। এর ফ্ল্যাভোনয়েড যা হৃদপিন্ডের রক্ত সুষ্ঠু সুন্দর সঞ্চালনে কাজ করে। ফাইটোনিউট্রিফেট নামক উপাদান হৃদপিন্ডের জন্য খুবই উপকারি। এ উপাদানটি জ্ঞানীয় দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং মানসিক স্বাস্থ্য অটুট রাখে, উপাদানটি মস্তিষ্কের রোগ ও টক্সিন থেকে মুক্ত থাকতে এবং মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ বাড়াতে সাহায্য করে। মস্তিষ্কে বেশী রক্ত প্রবাহিত হলে অক্সিজেনও বেশী পৌছে দিতে হয় ফলে স্মৃতি শক্তি ও বিশ্লেষণমূলক চিন্তার উন্নতি ঘটে। এটা রক্তের খারপ কোলেস্টেরেলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে থাকে। এর রিবোফ্ল্যাভিন উপাদানটি মুখের ঘাঁ, ঠোঁটের কোণের ঘাঁ, জিহ্বার ঘাঁ, জ¦র জ¦র ভাব প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
বেগুনের আঁশ অ্যান্টি অক্সিডেন্ট শরীরে ক্যান্সার কোষ জন্মাতে দেয় না। ফলে পাকস্থলী কোলন, ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদ্রান্ত্রে ক্যান্সার হয় না। এতে প্রচুর পটাশিয়াম, অ্যান্তোসায়ানিন থাকে যা শরীরের উচ্চরক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। এতে কার্বোহাইড্রেট কম এবং ফাইবার বেশী থাকায় ডায়াবেটিস রোগীরা অনায়াসে খেতে পারেন। একই এ আঁশ গ্লুকোজ শোষণকে ও নিয়ন্ত্রণ করে। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বেগুন ভালো কাদ্য। এতে থাকা ফাইবার বার বার খিদে লাগার প্রবণতা কমিয়ে দেয়। তাই শরীরের ওজন কমাতে নিয়মিত খেলে অতিরিক্ত ওজন কমবে। বেগুনে ভিটামিন ৬, ফ্ল্যাভোনয়েডস, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট থাকায় হৃদপিন্ডের ধমনি গুলো ভালো থাকে। রক্ত সঞ্চালনও ভালে হয়।
ঔষধি গুণ ঃ * যাদের রাতে ঘুম কম হয় তারা একটু বেগুন পোড়ায় (ভালো করে ভেজে) মধু মিশিয়ে রাতে চেটে খেলে রাতে ঘুম আসতে পারে। * লিভারের সমস্যায় লিভার বেড়ে গেলে কঁচি বেগুন ভালো মতো ভেজে রোজ সকালে খালি পেটে খেলে উপকার পাবেন। * যাদের প্রসাব কম হয় তারা নিয়মিত বেগুন খেলে প্রসাব বাড়বে। * ছোট ছোট সাদা বেগুন খেলে অশর্^ রোগের উপকার হয়। * বেগুন চাক চাক করে ফোঁড়ার ওপর বেঁধে দিলে ফোড়া তাড়াতাড়ি পেকে যায়। * শরীরে চর্বি জমে মোটা হয়ে গেলে বেগুন ভাজি করে অল্প লবণ মাখিয়ে রাতে ভাতের পরিবর্তে রুটি দিয়ে খান শরীরের মেদ কমে আসবে। * মহিলাদের মাসিকের সমস্যা দেখা দিলে বা অনিয়মিত মাসিক হলে নিয়মিত বেগুনের তরকারি, ভাজি করে বা রুটির সাথে গুঁড় মিশেয়ে খান উপকার পাবেন। * আঙ্গুল ফুলে মোটা হয়ে গেলে লম্বা একটি বেগুনের মাজের শাঁস বের করে তাতে আঙ্গুল ঢুকিয়ে রাখলে ফুলা ও ব্যথা কমে আসবে। * যাদের পেটে বেশী বায়ু হয় তারা বেগুনের তরকারি, ভাজি ও বেগুনের ছোপের সাথে রসুন মিশেয়ে খান পেটের বায়ুর প্রকোপ কমে আসবে। * আপনার মুখে যদি মেছতা দেখা দেয় তাহলে বুঝবেন আপনার লিভারে সমস্যা হচ্ছে। লিভারের সমস্যায় চেহারা হলদেটে হয়ে গেলে নিয়মিত বেগুন খান উপকার পাবেন। * যাদের রক্তে খারপ ধরনের কোলেস্টরলের পরিমাণ বেশী তারা নিয়মিত বেগুন খান উপকার পাবেন।
সতর্কতা ঃ যাদের গেঁটে বাত আছে কিংবা এজমা বা এলার্জি বেশী তারা বেগুন না খাওয়াই ভালো। তবে ডাক্তারের পরামর্শ মতে খেতে পারেন। কোন প্রকার প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে বেগুন খাবেন না। যে বেগুনে বীজ বেশী সে বেগুন খাবেন না। মনে রাখবেন কচি ও কালো বেগুনে গুণাগুন বেশী। সুতরাং পরিপুষ্ট কচি ও কালো বেগুন সুস্বাস্থ্যের নিয়ামক।
মোঃ জহিরুল আলম শাহীন
শিক্ষক ও স্বাস্থ্য বিষয়ক কলাম লেখক
ফুলসাইন্দ দ্বি-পাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ
গোলাপগঞ্জ, সিলেট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন