জামালউদ্দিন বারী
দেশের ৮টি শিক্ষা বোর্ড, মাদরাসা বোর্ড এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৬ সালের এসএসসি, দাখিল ও ভোকেশনাল সার্টিফিকেট পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে গত ১১ মে। সম্মিলিতভাবে ১৬ লক্ষাধিক পরীক্ষার্থীর অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এই পরীক্ষা দেশের অন্যতম বৃহৎ পাবলিক পরীক্ষা। সাম্প্রতিক অতীতে শুরু হওয়া প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিএসসি) এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরো বেশি। সার্বিক পরিস্থিতিতে শেষোক্ত দুটি পাবলিক পরীক্ষার আদৌ প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা এই বিতর্ক এখন ক্রমে জোরালো হয়ে উঠেছে। প্রাথমিক স্তর থেকে শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নতুন শিক্ষানীতির আওতায় এসব পাবলিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হলেও তা কার্যত শিক্ষার মানোন্নয়নের বদলে শিক্ষাকে অধিকতর বৈষম্যমূলক এবং বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতার বস্তুতে পরিণত করছে বলে অনেকের অভিযোগ। এসব পাবলিক পরীক্ষার কারণে শিক্ষাজীবনের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের অত্যধিক চাপের মুখে ঠেলে দেয়ার পাশাপাশি বিদ্যালয়ের কোচিং বাণিজ্য, প্রাইভেট টিউশনের মুখাপেক্ষী করে তুলতে বাধ্য করা হচ্ছে। বিদ্যালয়গুলো নিজেদের নাম ফলাতে শিক্ষার্থীদের স্রেফ জিপিএ-৫ ও গোল্ডেন জিপিএর ফাঁদে ফেলে দিয়েছে। এখানে শিক্ষার মানোন্নয়ন বলতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা, পাসের হার এবং উচ্চ গ্রেড প্রাপ্তির হারকেই বোঝানো হচ্ছে। প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষার সময় প্রশ্নপত্র ফাঁস করার বাণিজ্যিক তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার পর দেশের সব দৈনিক পত্রিকায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের যুথবদ্ধ উল্লসিত মুখের ছবি ছাপিয়ে ফলাফলের প্রাথমিক পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়। এরপর কয়েক দিন ধরে ফলাফলের বিচার বিশ্লেষণ, পাস-ফেলের কার্যকারণ এবং আসন্ন সম্ভাব্য ভর্তি বাণিজ্য নিয়ে কিছু আশঙ্কা ও উদ্বেগের চিত্র তুলে ধরা হয়। এই গ্রেডিং সিস্টেম, এই তথাকথিত সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতির মধ্য দিয়ে পাবলিক পরীক্ষার এই ফলাফল জাতিকে সামনে এগিয়ে নিতে কতটা সক্ষম হচ্ছে এই বিচারের ভার কেউ আর নিচ্ছে না। দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিম-লে আমরা সবাই একটি স্থায়ী ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রত্যাশা করলেও পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় প্রভাবক হিসেবে শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা কারিকুলামের অবমূল্যায়ন হতাশ হওয়ার মতো। যাই হোক ১৬ লক্ষাধিক পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাসের হার ৮৮ শতাংশের বেশি। এসএসসি পাস করা প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে সর্বোচ্চ গ্রেড জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও লক্ষাধিক। এভাবে প্রতিবছর পর্যায়ক্রমে সব পাবলিক পরীক্ষায়ই লাখ লাখ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়ে উচ্চশিক্ষার সিঁড়িতে পা রাখছে। এদের মধ্যে ঠিক কতজন সত্যিকার অর্থে সুশিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠছে, এই মুহূর্তে সেটাই অনেক বড় প্রশ্ন।
দেশের শিক্ষাবিদ, শিক্ষক সমাজ ও সমাজচিন্তকরা শিক্ষা কারিকুলাম, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক- রাজনৈতিক, নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক মূল্যবোধের বিকাশকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আসছেন। বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সম্পৃক্ত যৎসামান্য কারিকুলাম অবশিষ্ট ছিল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা’ও বিদায় করে দিয়ে প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। মূলত দশকের পর দশক ধরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা দেশের শাসকশ্রেণীর সিদ্ধান্তহীনতা, এক্সপেরিমেন্ট এবং রাজনৈতিক জুয়া খেলার শিকার হয়েছে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের মহাজোট সরকার পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক মতলববাজি ও দূরভিসন্ধি অব্যাহত রয়েছে। আজকে আমাদের দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সেক্টর এবং সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি, লুটপাট, স্বেচ্ছাচারিতা ও অপদখলের সংস্কৃতি ভাইরাল আকার ধারণ করেছে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে দেশ অর্থনৈতিকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে শাসকশ্রেণী যার যার মতো করে প্রচারণা চালিয়ে একটি রাজনৈতিক ফায়দা ও বাহবা কুড়ানোর চেষ্টা করলেও এই এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে দেশ থেকে লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশের জন্য অমূল্য সম্ভাবনাময়-সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী প্রতিভা। সেই সাথে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ধসিয়ে দেয়া হচ্ছে হাজার বছরে গড়ে ওঠা আমাদের সামাজিক, ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষার ভিত্তি। এতসব সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বল্গাহীন অবক্ষয়ের পেছনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নানা কারণ বিদ্যমান থাকতে পারে। তবে এ অবক্ষয়ের শুরু হয়েছিল আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে কলুষিত করার মধ্য দিয়ে। এই কলুষিত সমাজ বাস্তবতার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে একটি সর্বজনীন ইতিবাচক সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় উত্তরণের মূল চাবিকাঠি হচ্ছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে জনগণের জন্য কাক্সিক্ষত মানে উন্নীত করা।
একদিকে শাসকশ্রেণী সব সময়ই দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে হীন রাজনৈতিক খেলার বস্তুতে পরিণত করেছে, অন্যদিকে আরেক শ্রেণী শিক্ষাব্যবস্থার বিপথগামিতার বিরোধিতাকেও রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। তবে যেহেতু শিক্ষাব্যবস্থার সাথে জাতির গড়ে ওঠা, সামগ্রিক সম্ভাবনা ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, সে কারণেই শিক্ষাব্যবস্থার ব্যত্যয়, বিপথগামিতা এবং পরিকল্পিত বিচ্যুতকরণের বিরুদ্ধে দেশের আলেম সমাজ ও সচেতন নাগরিক সমাজের এক ধরনের আবেগি প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের শিক্ষা কারিকুলামে ইসলামী মূল্যবোধের বিষয়গুলো প্রত্যাহার করে প্রতিবেশী সম্প্রদায় ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রের হিন্দুত্ববাদী বিষয়াবলী যুক্ত করার অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগ এখন আর কোনো রাজনৈতিক ব্লেইম গেমের বিষয় নয়। পাঠ্যপুস্তকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধবিরোধী বিষয়গুলো যুক্ত হওয়ার তথ্য-উপাত্ত এখন বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠে এসেছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের আলেম সমাজ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও এসবের বিচার-বিশ্লেষণ ও প্রতিবাদী কর্মসূচির ঘোষণা আসতে দেখা যাচ্ছে। গত শনিবার বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের পুরানা পল্টনের কার্যালয়ে এক গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করা হয়। ‘সেক্যুলার শিক্ষানীতি, শিক্ষা আইন ও হিন্দুত্ববাদী সিলেবাস পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষাবিদ, আলেম ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ শিক্ষাব্যবস্থার ইসলামবিরোধী, হিন্দুত্ববাদের সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছেন। ইতিপূর্বে বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনস্থ আলেম সমাজ এবং হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকেও অনুরূপ কর্মসূচি গ্রহণের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে ইসলামী ভাবধারা বিলুপ্ত করে হিন্দুত্ববাদী পাঠ্যসূচি ও সেক্যুলার শিক্ষা আইন বাতিলের দাবিতে তারা ঢাকাসহ সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিলসহ সভা-সমাবেশও করেছে। শিক্ষা কারিকুলাম থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ মুছে দিয়ে ভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থাকে ধর্মনিরপেক্ষ করা সম্ভব কিনা সে প্রশ্নও উঠেছে। তারচেয়েও বড় প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে এ দেশের ৯০ ভাগ মানুষ ইসলামের ধর্মীয় নৈতিকতার দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত, সেখানে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ইসলামের ইতিহাস ও নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা কমিয়ে দিয়ে হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্য নিয়ে জনমনে বড় ধরনের সংশয় তৈরি হচ্ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পরিবর্তিত সাম্প্রতিক পাঠ্যক্রমে ইসলামের ইতিহাস ও নৈতিক শিক্ষা সম্পৃক্ত গল্প, কবিতা, নিবন্ধগুলো বাদ দিয়ে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত তার ক্রনলজিক্যাল তালিকা দেখে যে কোনো সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন মুসলমান নাগরিকের মধ্যে বিক্ষুব্ধ বিস্ময়বোধ জাগ্রত হতে বাধ্য। প্রথম শ্রেণী থেকে নবম-দশম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্য পাঠে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে তার বিবরণ এখানে তুলে ধরা হয়তো বাহুল্য হতে পারে। এ বিষয়ে এটুকু বলা যায়, নতুন শিক্ষানীতি ও শিক্ষাআইন বাস্তবায়নে এ ধরনের তৎপরতা শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি দেশের জনগণকে আস্থাহীন করে তোলতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আস্থাহীনতা নিয়ে কোনো শিক্ষানীতি বা আইনের সঠিক বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে সাথে সেই ব্যবস্থারও পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। শিক্ষাব্যবস্থা হতে হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক জীবনের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ভবিষ্যতের লক্ষ্য অর্জনের মূল অবলম্বন। শিক্ষাব্যবস্থাকে অনিশ্চয়তা ও সাময়িক এক্সপেরিমেন্টাল বিষয়ে পরিণত করা হলে জাতি সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে পাবে না।
শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান নানাবিধ বৈষম্য দূর করার দাবি অনেক পুরনো। সাম্প্রতিক সময়ে এর সাথে যুক্ত হয়েছে শিক্ষাবাণিজ্য, অনৈতিকতার সম্মিলন। শিক্ষাকে বৈষম্যমুক্ত করতে হবে, এতে কারো দ্বিমত নেই। এর অর্থ কি এই যে, শিক্ষাকে একমুখী করতে হবে? একটি বহুত্ববাদী সমাজে নানা ভাষাভাষী, ধর্ম-বর্ণ ও অর্থনৈতিক শ্রেণীবৈষম্য থাকবে। সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের বৈচিত্র্য বিভিন্ন শিক্ষাক্রমেও থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। যে কারণে ইংরেজ আমলের দূরভিসন্ধিমূলক একমুখী শিক্ষানীতি এ দেশের হিন্দু- মুসলমানরা মেনে নিতে পারেনি। ঠিক একই কারণে একমুখী শিক্ষার নামে এদেশের ঐতিহ্যবাহী মাদরাসা শিক্ষা কারিকুলামকে সাধারণ শিক্ষার সাথে গুলিয়ে ফেলার পরিকল্পনাকে দেশের আলেম সমাজ এবং ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারবে না। কোনো জাতিরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা হতে হয় জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও বিকাশের পথপ্রদর্শক। কোনো জাতিকে পদানত ও দুর্বল করতে চাইলে প্রথমে তার শিক্ষাব্যবস্থায় আঘাত করেই জাতীয় চেতনা তথা সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের গ্রহণযোগ্য ধারণাকে ভেঙে দিতে হয়। ইংরেজ আমলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বারা প্রবর্তিত প্রথম আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কমিশন সে লক্ষ্যকে সামনে রেখেই প্রণীত হয়েছিল। ১৭৫৭ সালের পর ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গর্ভনর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস শিক্ষাব্যবস্থায় যে সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছিলেন তা ছিল ভারতের হিন্দু-মুসলমানের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখার অনুকূল। ওয়ারেন হেস্টিংসের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথমে ১৭৮১ সালে মুসলমানদের জন্য কলকাতা আলিয়া মাদরাসা এবং হিন্দুদের জন্য ১৭৯২ সালে বেনারস সংস্কৃতি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮১৩ সালে প্রণীত ব্রিটিশ-ভারতের প্রথম শিক্ষা চার্টারের ৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদে ভারতের নিজস্ব (হিন্দু ও মুসলমানদের) ভাষা ও ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধারণ করে পাশ্চাত্যের ইংরেজি ভাষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার কথা বলা হয়েছিল। তবে ইংরেজের এই উদার মনোভাব বেশি দিন টিকেনি। উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ভারতের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য লর্ড টমাস বেবিংটন ম্যাকলেকে প্রথমেই ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাকে নিজেদের মতো কওে ঢেলে সাজানোর দায়িত্ব দেন। সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ম্যাকলে ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের ভেদবুদ্ধির কথা প্রকাশ্যেই তুলে ধরেন। ভারতের হিন্দু-মুসলমানের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সঞ্জাত শিক্ষাব্যবস্থার বদলে ইংরেজি মাধ্যমের একমুখী সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ম্যাকলের এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে গোঁড়া হিন্দু ও মুসলমানরা সাধারণ শিক্ষার মূলধারা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তবে ভারতের একটি মডারেট শ্রেণী ইংরেজের এই শিক্ষাব্যবস্থায় ব্রিটিশদের অনুগত সুবিধাভোগী শিক্ষিত শ্রেণী হিসেবে গড়ে ওঠে। এদের কারণেই ভারতে ইংরেজের শাসন পৌনে দুইশ বছর প্রলম্বিত হয়। পশ্চিমা সেক্যুলার শিক্ষানীতি চালুর মধ্য দিয়ে ভারতীয় হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতি ধ্বংসের কারণে ভারতে কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা লর্ড ম্যাকলেকে এখনো ঘৃণার চোখে দেখে। হিন্দুত্ববাদীরা ‘ফোর-এম’-এর ধারণা প্রচার করে থাকে। সেখানে মিশনারি, মার্কসবাদী এবং ম্যাকলের শিক্ষানীতির সাথে মিলিয়ে মুসলমানদেরকেও হিন্দু ধর্মের আপসহীন শত্রু (ইররিকনসাইলেবল এনিমি) বলে বর্ণনা করা হয়েছে। লর্ড ম্যাকলের নব সূচিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাব বর্ণনা করতে গিয়ে ম্যাকলের জীবনীকার জি.ডি. ট্রেভেলিয়ান লিখেছিলেন, ১৮৩৫ সালে এক নতুন ভারতের জন্ম হলো। ভারতীয় প্রাচীন সভ্যতার মূল ভিত্তিগুলো নড়বড়ে হয়ে ওঠে। একটির পর একটি ভিত্তি এবং অট্টালিকা ভেঙে পড়তে থাকে। (‘অ্যা নিউ ইন্ডিয়া ওয়াজ বর্ন ইন ১৮৩৫। দ্য ভেরি ফাউন্ডেশন অব হ্যার অ্যানসিয়েন্ট সিভিলাইজেশন বিগ্যান টু রক এন্ড সোয়ে। পিলার আফটার পিলার ইন ইডিফাইস কেইম ক্রাশিং ডাউন’)।
ভারতে ব্রিটিশদের শাসন-শোষণ ও লুণ্ঠন অব্যাহত রাখতে ভারতীয় সমাজকে তার ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত করার পাশাপাশি ভারতীয় সমাজকে বহুধা ভাগে বিভক্ত করা এবং এখানে ব্রিটিশদের অনুগত ও একটি ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যস্বত্বভোগী দালাল শ্রেণী গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। এ কারণেই গভর্নর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের তুলনায় লর্ড ম্যাকলে ভারতের হিন্দু-মুসলমানের কাছে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাড়ে ৪ দশক পর এদেশের মানুষ আবারো লর্ড ম্যাকলের অনুরূপ একমুখী শিক্ষানীতির পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা করছে। ঔপনিবেশোত্তর বিশ্ব সভ্যতা বহুদূর এগিয়ে গেলেও আমরা এখনো নিজেদের তৈরি করা বিভেদ, বৈষম্য, হীনম্মন্যতা ও অনাস্থার দুর্গ থেকে বের হতে পারছি না। সাতচল্লিশোত্তর আকরাম খান শিক্ষা কমিশন থেকে শুরু করে বর্তমান মহাজোট সরকারের কবির চৌধুরী শিক্ষা কমিশন পর্যন্ত অন্তত এক ডজন শিক্ষা কমিশন গঠিত হলেও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে কোনো শিক্ষানীতিই বাস্তবায়নের পথে এগোতে পারেনি। বর্তমান সরকার শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করলেও এই শিক্ষানীতি এবং প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন একদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ধর্মীয়-নৈতিক মূল্যবোধের প্রতিকূল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, অন্যদিকে শিক্ষানীতির প্রস্তাব অনুসারে শিক্ষার অবকাঠামো উন্নয়নসহ সামগ্রিক লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনীয় বাজেট সংস্থানেও সরকারের অনাগ্রহ লক্ষ্যণীয়। উপমহাদেশের যে কোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশে শিক্ষা খাতের ব্যয় অপ্রতুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভূটান, আফগানিস্তানের মতো দেশগুলো তাদের মোট গড় জিডিপির ৩ থেকে ৪ ভাগ শিক্ষা খাতে ব্যয় করলেও বাংলাদেশে তা ২ ভাগের কাছাকাছি। এমনকি আফ্রিকার সেনেগাল বা রুয়ান্ডাও তাদের জিডিপির ৪ থেকে ৬ ভাগ শিক্ষা খাতে ব্যয় করে থাকে বলে জানা যায়। ১৯৭২ সালের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের আলোকে ১৯৭৪ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষাকমিশন কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টও এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মেনে নিতে পারেনি। ধর্মীয় নৈতিকতাহীন শিক্ষাব্যবস্থার কুফল এখন আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। এরই প্রভাবে এখন শিক্ষার নামে ভর্তি বাণিজ্য, কোচিং বাণিজ্য, সার্টিফিকেট বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সন্ত্রাস, রক্তাক্ত হানাহানি ও লাশের রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ের একশ্রেণীর শিক্ষক ছাত্রী ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ার মতো নৈতিক অবক্ষয়ের শিকার হয়েছে। শুধুমাত্র বাজেট বাড়িয়ে, স্কুল-কলেজের বড় বড় বিল্ডিং বানিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা ও জাতীয় চেতনার এই অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব নয়। সমাজে ও শিক্ষাঙ্গনে অনুকূল স্থিতিশীল পরিবেশ এবং শিক্ষা কারিকুলামে নৈতিক মানসম্পন্ন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার পাঠ নিশ্চিত করতে হবে। প্রায় প্রতিটি শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে শিক্ষার একটি জাতীয় লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। শিক্ষার ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আধ্যাত্মিক লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে সমৃদ্ধ দেশ গড়ার কোনো পরিকল্পনাই কাজে আসবে না।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন