মোহাম্মদ আবদুল গফুর
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না এলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতো না। কথাটা সত্য। তবে আংশিক সত্য। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা তো ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের। সে সরকারেরও নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সে সরকার সদ্য স্বাধীন দেশে জনগণের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীকারীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। এমন কি যে পাকিস্তান বাহিনী একাত্তরে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল তাদেরও ছেড়ে দিয়ে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। শুধু তাই নয়, পরবর্তীকালে পাকিস্তানের আমন্ত্রণে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামিক সামিটেও যোগদান করেন বঙ্গবন্ধু।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মনে থাকার কথা, প্রতিবেশী দেশ ভারত একাত্তরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থনদানে এগিয়ে এলেও পরবর্তীকালে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে মোটেই খুশি হয়নি। যে ভারত মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সমর্থন করে, লাহোরের ইসলামিক সামিটে যোগদানের দিনে সেই ভারতের রাজধানী দিল্লিতে বঙ্গবন্ধুর কুশপুত্তলিকা পর্যন্ত দাহ করা হয়। এর কারণ কী?
এর কারণ খুঁজে পেতে হবে আমাদের তৎকালীন ইতিহাসের বাস্তবতায়। সবাই জানেন, উনিশশো একাত্তরের পঁচিশ মার্চ কালরাতে ইয়াহিয়া সরকারের টিক্কা বাহিনী বাংলাদেশের জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু তাঁর সব অনুসারীকে দ্রুত দেশ ত্যাগ করে প্রতিবেশী দেশে চলে যেতে নির্দেশ দিলেও নিজে স্বেচ্ছায় গ্রেফতারবরণ করে পাকিস্তানে কারাভোগের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।
সে সময় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখের নেতৃত্বাধীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়ে ওই সরকারকে ভারত সরকার এমন এক অসম চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করে, যার মধ্যে ছিল:
(এক) মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর অধীনে থাকবে।
(দুই) বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী অবস্থান করবে। (কত দিনের জন্য তা নির্দিষ্ট ছিল না)
(তিন) স্বাধীন বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না।
(চার) বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে একটি সংস্থা গঠন করা হবে।
(পাঁচ) মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি এমন সব কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হবে। প্রয়োজনে ভারতীয় কর্মকর্তাদের দ্বারা শূন্য পদ পূরণ করা হবে।
(ছয়) বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অবাধ সীমান্ত বাণিজ্য চলবে।
(সাত) বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়নের সময় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাহায্য নেয়া হবে।
সম্ভবত ভারতের নেতৃবৃন্দের বিশ্বাস ছিল বঙ্গবন্ধু আর পাকিস্তানী কারাগার থেকে জীবিত ফিরে আসবেন না। তাই বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রটিকে তাদের একটি আশ্রিত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলাই যে ছিল উপরে উল্লিখিত সাত দফা চুক্তির লক্ষ্য এটা সুস্পষ্ট। কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেল, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে জীবিত অবস্থায় মুক্তি পেয়ে প্রথমে লন্ডন যান। পরে দিল্লি হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। লন্ডনে সংক্ষিপ্ত অবস্থানকালেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের সঙ্গে ভারতের সাত দফা চুক্তি সম্পর্কে অবহিত হন এবং নিজের ইতিকর্তব্য স্থির করে ফেলেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিল্লিতে পথে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই তিনি প্রশ্ন করেন, ম্যাডাম, আপনি বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনী কবে ফিরিয়ে আনবেন? ইন্দিরা জবাবে বলেন, আপনি যখন বলবেন, তখনই। বলাবাহুল্য, তখন দেশে-বিদেশে বঙ্গবন্ধুর যে বিপুল জনপ্রিয়তা, তাতে ইন্দিরার পক্ষে অন্য কোনো জবাব দেয়া সম্ভব ছিল না। এভাবেই বাংলাদেশ এক বিরাট আধিপত্যবাদী চক্রান্ত থেকে মুক্তি পায় বঙ্গবন্ধুর সাহসী ভূমিকার কারণে।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যেদিন স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম পদার্পণ করেন, সেদিনই তিনি বাংলাদেশকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেন। পরবর্তীকালে তার লাহোর ইসলামিক সামিটে যোগদান নিয়ে ভারতে তার বিরুদ্ধে কি প্রতিক্রিয়া হয় তা আগেই বলা হয়েছে। তদুপরি তিনি সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়Ñ এ নীতি অবলম্বন করাতে আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনের প্রভাবশালী সা¤্রাজ্যবাদী অপশক্তিও বাংলাদেশের নতুন মুসলিম রাষ্ট্রের স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গিকে বেশি ভালো চোখে দেখতে পারেনি। এর মধ্যে অবশ্য বঙ্গবন্ধু এক মহা ভুল করে বসে। তিনি দেশের সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি মাত্র সরকারি দল রেখে একদলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করলেন। শুধু তাই নয়, দেশের সব পত্রিকা বন্ধ করে মাত্র ৪টি সরকারি পত্রিকা চালু রাখেন।
গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অভ্যস্ত এদেশের জনগণের মধ্যে স্বাভাবিক কারণেই এর বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ ও গভীর অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতির সুযোগে বাইরের মদদে কিছু সংখ্যক বিক্ষুব্ধ সৈনিকের নেতৃত্বে পরিচালিত অভ্যুত্থানে সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু।
গণতন্ত্র ধ্বংসী এ সিদ্ধান্ত নিতে আজীবন গণতন্ত্রের লড়াকু সৈনিক বঙ্গবন্ধুকে কে বা কারা উৎসাহিত করেছিল তা জানা না গেলেও বাকশালের অন্যতম নেতা কমরেড মণি সিংহের তৎকালীন একটি বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয়, এর পেছনে তার সুচিন্তিত পরিকল্পনা কার্যকর ছিল। তিনি ওই বক্তব্যে বলেছিলেন, বাকশাল কোনো একক নাটিকা নয়, একটি বহু অংকের নাটক। এর শেষ অংকের শেষ দৃশ্য না দেখা পর্যন্ত এর গুরুত্ব উপলব্ধি করা যাবে না।
সে যাই হোক এই একদলীয় বাকশালী ব্যবস্থার সুবাদেই যে বঙ্গবন্ধুর জীবনের করুণ পরিণতি ঘটানোর সুযোগ গ্রহণ করে আন্তর্জাতিক সা¤্রাজ্যবাদী অপশক্তিÑ এ বিশ্বাস আমাদের সুগভীর। তবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই যে আন্তর্জাতিক কুচক্রীদের মনোবাঞ্ছা সম্পূর্ণ পূরণ হয় না, উদীয়মান নতুন মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য করাই যে ছিল আন্তর্জাতিক কুচক্রীদের চূড়ান্ত লক্ষ্য, তার প্রমাণ পাওয়া যায় অচিরেই। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে একপর্যায়ে স্বাধীনতার ঘোষক বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান সিপাহি জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হন। প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করে বহু দলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সাফল্য অর্জনকারী জিয়াউর রহমানকে ১৯৮০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর কিছু উচ্চকাক্সক্ষী ও সামরিক নেতার নেতৃত্বে পরিচালিত এক ক্যুর মাধ্যমে হত্যা করে দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শূন্যতা সৃষ্টি করা হয়। জিয়াউর রহমান নিহত হলেও তার সরকারের দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব বিচারপতি আবদুস সাত্তার সে সময় সরকারের হাল ধরেন। ফলে এবার সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অবস্থানকারী মূল কুচক্রী তদানীন্তন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একটি নির্বাচিত সরকারকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে বসেন। এরপর শুরু হয় এরশাদের নেতৃত্বাধীন সুদীর্ঘ স্বৈরাচারী সেনাশাসন।
মজার ব্যাপার এই যে, একটি নির্বাচিত সরকারকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করলে জেনারেল এরশাদের সেই ক্যুর প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়ে বসেন দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনা। এটা এ কারণে সম্ভব হয় যে, উৎখাত হওয়া ওই নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। এর অর্থ এই যে, আওয়ামী নেত্রীর কাছে নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নেতৃত্বে পরিচালিত নির্বাচিত সরকারের চেয়ে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক নেতাকে অধিক কাম্য বিবেচিত হয়েছিল। এটা কিন্তু তাঁর গণতন্ত্রপ্রীতির প্রমাণ বহন করে না।
আওয়ামী লীগ নেত্রী যে আদৌ গণতন্ত্রে আস্থাশীল নন তার আরও বহু প্রমাণ আছে। দেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মনে থাকার কথা, জেনারেল এরশাদের দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসনামলে এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আন্দোলন পরিচালনা করে। আওয়ামী লীগও একপর্যায়ে এই আন্দোলনে শামিল হয়। কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে নবাগত বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আন্দোলনে যতটা আন্তরিক ছিলেন দেশের প্রাচীনতম দল আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনাও যদি ততটা আন্তরিক থাকতেন তা স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের আয়ু অতটা দীর্ঘ হতে পারত না।
এই আন্তরিকতাবিহীন আন্দোলনের শাস্তি তিনি হাতে হাতেই পেয়েছিলেন। এরশাদের স্বৈরশাসন পরবর্তী নির্বাচন যাতে অবাধ নিরপেক্ষ হয় সেজন্য দেশের দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এ ব্যাপারে একমত হয়েছিল যে, নির্বাচন হবে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এবং ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান থাকবেন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। নির্বাচনে নিজ ভোট কেন্দ্রে ভোটদানের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে একপর্যায়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমি সব জেলার খবর নিয়েছি। নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু হয়েছে। আপনারা লক্ষ্য রাখবেন নির্বাচনে হেরে গিয়ে এর মধ্যে কেউ যেন আবার কারচুপি আবিষ্কার না করে। নির্বাচনের পূর্ণ ফলাফল প্রকাশিত হলে যখন দেখা গেল আওয়ামী লীগ নয় অধিকাংশ সিটে বিজয়ী হয়েছে বিএনপি, তখন অবলীলাক্রমে বলে ফেললেন, নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে। অর্থাৎ কোনো নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী না হলেই ধরে নিতে হবেÑ নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। বলাবাহুল্য, এটাও তাঁর গণতান্ত্রিক মনমানসিকতার প্রমাণ বহন করে না।
এবার যে প্রসঙ্গ নিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম সে প্রসঙ্গে আরও কিছু কথা। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ যে বলেছেন শেখ হাসিনার সরকার না হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতো না এ কথা যেমন সত্য, তেমনি এর সঙ্গে আরও এমন অনেক কিছু সম্ভব হতো না শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার না থাকলে। যেমন বলা চলে, নির্বাচন অবাধ না হওয়া। শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচন অর্থই নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ বা নিরপেক্ষ না হওয়া। তার সরকারের অধীনে নির্বাচন তা জাতীয় পর্যায়ে, পৌরসভা পর্যায়ে বা ইউনিয়ন পরিষদ যে পর্যায়েই হোক তা যে সুষ্ঠুভাবে হবে না এটা এখন দেশ-বিদেশের সব পর্যায়ের লোকদের কাছেই বিশ্বাসের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই তার আমলে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের নির্বাচন সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠেছে বিশ্বের গনাক’টি দেশ ছাড়া সর্বত্র। এই স্বল্পসংখ্যক ক’টি দেশের অন্যতম ভারত। সে দেশের নেতৃবৃন্দ চান যেভাবেই হোক শেখ হাসিনার সরকার যেন ক্ষমতায় থাকে। কারণ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে ভারতের আধিপত্যবাদী স্বার্থনিরাপদ থাকে।
সবচেয়ে বড় কথা, যে নির্বাচনের মাধ্যমে তার বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে, সে নির্বাচনে দেশের সর্বকালের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে জাতীয় সংসদের মোট ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সরকার দলীয় প্রার্থীরা নির্বাচিত হন। এ ছাড়া যেসব আসনে নির্বাচন হয়, সেসব আসনেও নির্বাচন কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল একেবারেই নগণ্য। এরকম পরিস্থিতির উদ্ভব হয় ৫ জানুয়ারি ওই নির্বাচন দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি বয়কট করার ফলে। বিএনপি ওই নির্বাচন বয়কট করে অতীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে যে সমঝোতা হয় সে সমঝোতা থেকে আওয়ামী সরকারের সরে যাওয়ার ফলে।
এদেশে সচেতন গণ-মানুষের স্মৃতিশক্তি এতটা কম নয় যে, তারা দেশের দুই প্রধান দলের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সমঝোতার কথা এত শীঘ্রই ভুলে যাবে। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি এরশাদের দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের পর যে প্রথম নির্বাচন হয় তাতে বিএনপি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। ওই সরকারের মেয়াদ শেষে যখন নতুন নির্বাচনের প্রশ্ন ওঠে তখন প্রধানত সেদিনের বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার দাবির মুখেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান সংবিধানে বিধিবদ্ধ হয়। প্রশ্ন ওঠে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অধীনে জাতীয় নির্বাচন সেদিন এত কাম্য হয়ে উঠলেও হাসিনার দৃষ্টিতে এখন তা এত ভীতিজনক হয়ে উঠেছে কেন? নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হবে এটাই কি তাঁর ভয়ের কারণ?
পরিশেষে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ যে বলেছেন, হাসিনা সরকার না হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতো না এ কথা সত্য বলে মেনে নিয়েও বলতে হয়, হাসিনা সরকার না হলে আরও অনেক কিছুই হতো না। যেমন : দেশে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অসম্ভব হয়ে পড়া। নির্বাচন মানেই এখন সরকার দলীয় মাস্তানদের দৌরাত্ম্য, নির্বাচন মানেই এখন নির্বাচনের নামে এমন হাস্যকর মহড়া, যেখানে কারা নির্বাচিত ঘোষিত হবে তা আগে একেই নির্ধারিত থাকে। হাসিনা সরকার ক্ষমতায় না থাকলে ফারাক্কা চুক্তি মোতাবেক ন্যায্য পানি না পাওয়ার পরও এ ব্যাপারে সরকারি নেতৃবৃন্দ নিজেদের মুখ সেলাই করে রাখতেন না। তিস্তা নদীর পানি চুক্তি ভারত অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখতে পারত না। সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর হাতে বাংলাদেশের হত্যা জিরো পয়েন্টে নামিয়ে নিয়ে আসার ওয়াদা পালনে ভারতের অনীহা এত দুঃসাহসী হয়ে উঠতে পারত না। মোটকথা, দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার্থে সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সরকার চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। জাতীয় স্বার্থ রক্ষার্থে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে একটি স্বাধীন দেশের মর্যাদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রেও বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা সীমাহীন। তদুপরি দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ইমান ও বিশ্বাসের বিরোধী পাঠ্যগ্রন্থ চাপিয়ে কোমলমতি কিশোর তরুণদের দুনিয়া ও আখেরাত নষ্ট করে দেয়ার সরকারী ভূমিকাও খুবই ন্যক্কারজনক।
যে সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মতো সর্বনাশা ঘটনা ঘটে, যে সরকারের আমলে অবাধ নির্বাচনের আশা দুরাশায় পরিণত হওয়ার ফলে গণতন্ত্র তার তাৎপর্য হারিয়ে ফেলে, যে সরকারের আমলে প্রতিবেশী দেশের কাছে প্রাকৃতিক পানি প্রবাহের ন্যায্য হিস্সা থেকে বঞ্চিত হওয়া দেশবাসীর দুর্ভাগ্যে পরিণত হয়েছে, যে সরকারের আমলে সীমান্ত হত্যা বন্ধের কোনো সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না, যে সরকার দেশের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ইসলামবিরোধী পাঠ্যপুস্তক পাঠে বাধ্য করে দেশের আগামী প্রজন্মকে ইসলামবিরোধী বিশ্বাসে গড়ে তোলার অপপ্রয়াসে লিপ্ত, তদুপরি যে সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে ৫ জানুয়ারির মত প্রশ্নবিদ্ধ ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমেÑ তাদের প্রতি জনগণের একটিই আহ্বান, সাহস থাকে তো শেখ হাসিনার অতীত দাবি মোতাবেক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন দিয়ে শাসক দলের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের চ্যালেঞ্জ করুন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন