নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান নুরুল হক নুর। অল্প বয়সে হারিয়েছেন মাকে। চাচাতো বোনের বাসায় থেকে এসএসসি পাস করার পর নিজের অদম্য চেষ্টায় করেছেন এইচএসসি পাস। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে হয়ে তৈরি করলেন ইতিহাস। দীর্ঘ ২৮ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রভাবশালী, পেশীশক্তি এবং প্রচলিত ধারার বিরুদ্ধে লড়াই করে ভিপি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। শিক্ষার্থীদের কাছে অকল্পনীয় জনপ্রিয়তা অর্জনকারী নুরকে ভোট চুরি, সিল মেরে, ভোট প্রদানে বাধা দিয়েও পরাজিত করতে পারেনি।
অথচ কোটা আন্দোলনের মাধ্যমে আলোচনায় আসা নুরুল হক নুরের পথটা ফুলে ফুলে সুশোভিত ছিল না। সাগরকন্যা পটুয়াখালির চর অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করে সেখানেই সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর গাজীপুরের কালিয়াকৈরে চাচাতো বোনের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেন এবং কালিয়াকৈর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। এইচএসসি পাশ করেন উত্তরা হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে। চিকিৎসার অভাবে মা মারা যাওয়ায় নুরুল হক স্বপ্ন দেখেছিলেন ডাক্তার হওয়ার। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার পর মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ না পাওয়ায় প্রথমে ভর্তি হন পটুয়াখালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে সুযোগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগে। বর্তমানে সেই বিভাগে স্নাতকোত্তর পর্বে অধ্যয়নরত।
গতবছর সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির ভিত্তিতে গড়ে উঠা কোটা সংস্কার আন্দোলনেই নেতৃত্বে চলে আসে নুর। শিক্ষার্থীদের প্লাটফর্ম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহŸায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এ আন্দোলন করতে গিয়ে তাকে কয়েকবার শারীরিক নির্যাতন, হামলা, মামলা, আত্মগোপন, হত্যার হুমকিসহ হেন কোন নির্যাতন ও অপমান নেই যার শিকার হতে হয়নি। সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের হামলার মুখে তাকে একপর্যায়ে নিজ আবাসিক হল হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ছাড়তে হয়। তারপরও দমে যাননি তিনি। কথা বলেছেন শিক্ষার্থীদের পক্ষে, পাশে থেকেছেন তাদের, সকল নৈতিক দাবি আদায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় থেকে যুক্ত হয়েছেন বিভিন্ন কাজে।
এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কখনো তাকে বানিয়েছে শিবির, কখনো আখ্যা দিয়েছে জঙ্গি হিসেবে, কখনো বা যুদ্ধাপরাধী কিংবা এজেন্ট নামে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়ানো হয়েছে তাকে নিয়ে করা নানা ব্যাঙ্গ চিত্র, কুৎসা রটনাও ছিল না কম। তবে এর কোন কিছুকে পাত্তা না দিয়ে নুরুল হক নুর সাধারণ ছাত্ররা যে দাবিতে তাকে সমর্থন ও সাহস যুগিয়েছে এগিয়ে গেছেন তা নিয়ে। নুরের নেতৃত্বে কোটা সংস্কার আন্দোলনের দাবি মেনে নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্যদিকে নুরুল হককে নিয়ে ছাত্রলীগের অপপ্রচারও তার প্রতি শিক্ষার্থীদের সমর্থন বাড়াতে সাহায্য করে। সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনের দু’দিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নুরুকে সমর্থন দেয়ার শিবিরের একটি ভূয়া বিবৃতি তার জনপ্রিয়তা কমাতে পারেনি। নুরুকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন গণমাধ্যমেও চালানো হয় অপপ্রচার।
দীর্ঘ ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত হওয়া ডাকসু নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ উঠলেও থামানো যায়নি নুরুল হক নুরের বিজয়। ছাত্রলীগের প্রার্থীকে প্রায় ২ হাজার ভোটে পরাজিত করে ভিপি নির্বাচিত হন পটুয়াখালির গলাচিপা উপজেলার চর বিশ্বাস ইউনিয়নের এ সন্তান। প্রথমে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে নুরুল হককে মেনে না নেয়া হবে না উল্লেখ করে সংগঠনটির পক্ষ থেকে আন্দোলন করা হলেও পরবর্তীতে নুরুল হকের সাথে ডাকসুতে কাজ করার কথা জানায় ছাত্রলীগ। নির্বাচিত হওয়ার পরও ডাকসুতে শপথ নেবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহের তৈরী হয়েছে। তবে নুরুল হক বলছেন, একমাত্র যাদের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন সে শিক্ষার্থীরা চাইলেই তিনি ডাকসুতে শপথ নেবো। সাধারণ শিক্ষার্থীরা যদি মনে করে আমার ডাকসুতে শপথ নিয়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া উচিত তাহলে তা করবো, অথবা তারা যদি মনে করে শপথ না নিয়ে পুনঃনির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখা উচিত তাহলে আমি তাই করব। তবে ডাকসুর সাবেক নেতা ও বিশ্লেষকরা বলছেন শপথ না নিলেও নুরুল হক নুরই থাকছেন ডাকসুর ভিপি। ডাকসু গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটির প্রধান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের শিক্ষক ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান বলেন, ডাকসু নেতাদের শপথের কথা কোথাও লেখা নেই। দায়িত্বগ্রহণ অনুষ্ঠান হয়। ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আমার সময়ে ডাকসুতে শপথ গ্রহণ বা দায়িত্ব হস্তান্তরের মত কিছু হয়নি। তবে আমরা একটি বড় করে অভিষেক অনুষ্ঠান করেছিলাম যেখানে সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো।###
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন