বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় দামুড়হুদায় মাধ্যমিক শিক্ষার পরিবেশ বিঘিত

প্রাইভেট না পড়লে ফেল করানোর হুমকি

প্রকাশের সময় : ২০ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নুরুল আলম বাকু, দামুড়হুদা (চুয়াডাঙ্গা) থেকে
প্রয়োজনীয় শিক্ষক, শ্রেণী কক্ষ ও আসবাবপত্রের অভাবসহ নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও প্রতিকূলতার ফাঁদে পড়ে দামুড়হুদার মাধ্যমিক শিক্ষা বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে। সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সংশ্লিষ্টদের লাগামহীন দুর্নীতির কারণে প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে মেধাহীন হয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের চিন্তায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে অভিভাবক মহল। ঐতিহ্য হারাচ্ছে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। জানা গেছে, দামুড়হুদা উপজেলায় মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ৩৩টি বিদ্যালয়, ১১টি মাদ্রাসা ও বিদ্যালয়ের সাথে কারিগরি বিদ্যালয় ৩টি। এলাকার হাজার হাজার ছেলেমেয়েরা এ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করে। বর্তমানে নানা অনিয়ম, অব্যস্থাপনা ও নানা প্রতিকূলতার ফাঁদে পড়ে দামুড়হুদার মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কারণগুলোর মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের ওপর রাজনৈতিক প্রভাবই সবচেয়ে বেশি দায়ী বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে। একটি বেসরকারি জরিপে দেখা গেছে, গত এক দশকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দলীয় বিবেচনায়। সেক্ষেত্রে এসব পদের বিপরীতে প্রার্থীদের মধ্যে অনেকে পরিক্ষায় ভালো ফলাফলকারী, মেধাবী ও উপযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র টাকা ও দলীয় লবিংয়ের অভাবের কারণে মনোনীত হতে পারেনি। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগকৃত এসব শিক্ষকদের বেশিরভাগই শিক্ষক হিসেবে অনুপোযুক্ত বলে অভিযোগ অনেকের। দলীয় প্রভাব ও টাকার মিনিময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে নীতি নৈতিকতার অভাব। ফলে তাদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা পুঁথিগত বাঁধা, কিছু বিদ্যা ছাড়া মেধা বিকাশে তেমন কিছু অর্জন করতে পারছে না। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ শিক্ষকরা সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ক্লাসে সঠিকভাবে পাঠদানের পরিবর্তে কোচিং করা শিক্ষার্থীদের প্রতি বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েছে। ফলে দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীরা টাকার অভাবে কোচিং করতে না পেরে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছার আগেই ঝরে পড়ছে। এদিকে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়িয়ে ও সাজেশন দিয়ে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পাস করানোর ব্যবস্থা করছেন। এর ফলে শিক্ষার্থীরা পাঠ্য পুস্তকের নির্দিষ্ট কিছু অংশ পড়েই পাস করছে। এতে সমস্ত বই ভালোভাবে পড়ে বিস্তারিত জ্ঞান অর্জনের সুযোগ থেকে দূরে সরিয়ে রেখে ক্রমান্বয়ে তাদেরকে মেধাহীন করে তোলা হচ্ছে। ভালো রেজাল্ট করে পাস করেও উচ্চতর শিক্ষার জন্য দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষায় টিকতে না পেরে ফিরছে স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। ফলে ওই সমস্ত শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের আশার গুড়ে ছাই পড়ছে। এছাড়া দফায় দফায় বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা তো আছেই। এর ফলে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা ভালোভাবে পড়ে ভালো রেজাল্ট করেও মানসিকভাবে স্বস্তি পাচ্ছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবে স্বল্প শিক্ষিত ও দুর্নীতিবাজ লোকেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় তারা দলীয় ছত্রছায়ায় থেকে তাদের ইচ্ছামত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার মান ক্রমেই নি¤œমুখী হচ্ছে। নিয়ম বহির্ভূতভাবে একজন শিক্ষক একই সাথে একাধিক প্রতিষ্ঠান ও একাধিক পদে চাকরি করার কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের কাছ থেকে প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব শিক্ষকরা বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান, প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করেই এসব অনিয়ম করে বলে একাধিক সমর্থিত সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া বিভিন্ন বিদ্যালয়ে ভৌত অবকাঠামোর অভাবে প্রয়োজনীয় শ্রেণী কক্ষ, শিক্ষা উপকরণ ও শিক্ষকের অভাব তো রয়েছেই। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি নির্বাচন ও শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, শিক্ষকদের দলবাজি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ফি আদায়, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে অনৈতিক ও প্রেমঘটিত বিষয়ে উদ্ভূত অস্থির পরিবেশের কারণে লেখাপড়ার পরিবেশ নষ্ট হয়। বিগত কয়েক বছরে উপজেলার নতিপোতা, কার্পাসডাঙ্গা, মদনা, লোকনাথপুর, কুড়ালগাছি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও জগন্নাথপুর মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সভাপতি নির্বাচন, অর্থের বিনিময়ে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থ আদায়কে কেন্দ্র করে বিদ্যালয়ে অস্থির পরিবেশ সৃষ্টির কারণে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন যাবৎ পড়াশুনার ভালো পরিবেশ নেই। কিছুদিন আগে উপজেলার দর্শনা পৌর এলাকার শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মেমনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি উৎসবের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষকদের মধ্যে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ ও চেয়ার তুলালাতুলির মত ঘটনা ঘটে। পরদিন এ খবর স্থানীয় সবকটি পত্রিকাসহ বেশ কয়েকটি জাতীয় প্রক্রিকায় ছাপা হয়। একাধিক অভিভাবক সূত্রে অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষকরা নিজ নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নানাভাবে তাদের কাছে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করে থাকে। তাদের কাছে প্রাইভেট না পড়লে অনেক সময় প্রকাশ্যেই শিক্ষার্থীদের ফেল করানোর হুমকি দেয়া হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের বাড়ির কাছের ভালো শিক্ষক থাকতেও ৩-৪ কিলোমিটার দূর হলেও নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য হয়। লাইব্রেরিকে বলা হয় জ্ঞানের জীবন্ত আধার। সব স্কুলেই লাইব্রেরি, বই ও লাইব্রেরিয়ান থাকলেও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেরই লাইব্রেরির তালা খোলা হয় না দীর্ঘদিন ধরে। যার ফলে তালায় জং ধরে গেছে এমন লাইব্রেরির সংখ্যা অনেক। কোন সময় এসব লাইব্রেরির কথা উঠলে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা লাইব্রেরিতে সময়োপযোগী শিক্ষামূলক কোন বইপত্র না থাকায় এগুলো আর ব্যবহার করা হয় না বলে জানান। বিভিন্ন সময়ে সরকারি বা বেসরকারিভাবে পাওয়া কম্পিউটারগুলো শিক্ষার্থীদের শিক্ষার কাজে সঠিকভাবে ব্যবহার হয় না। এরমধ্যে অনেক কম্পিউটার শিক্ষকদের বাড়িতে নিয়ে রাখার অভিযোগও রয়েছে। আবার অনেক স্কুলে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় এবং সংযোগ থাকলেও অনবরত লোডশেডিংয়ের কারণে এ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেখাপড়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শারীরিক বিকাশের জন্য শরীরচর্চাসহ নানা ধরনের খেলাধুলারও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকা দরকার। কিন্তু বর্তমানে বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই তার উপস্থিতি নেই বললেই চলে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন শিক্ষক বলেন, মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য যে কাজগুলো করা দরকার তা হলো, প্রথমত আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে বিশ্বের মধ্যে উন্নত জাতিতে পরিণত করার স্বার্থে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে স্থানীয় ও জাতীয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় দলীয় রাজনৈতিক নেতরা এসব শিক্ষার্থীদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে তাদেরকে দিয়ে মিছিল, মিটিং, পোস্টারিং ও হরতাল অবরোধের সময় পিকেটিংয়ের মতো অনৈতিক কাজ করিয়ে থাকে যা কারও কাম্য হওয়া উচিৎ নয়। তাই অচিরেই এসর বন্ধ করতে হবে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাবী, সৎ চরিত্র ও যোগ্য প্রার্থীদেরকে নিয়োগ দেয়া, বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হিসেবে শিক্ষিত, সৎ, যোগ্য ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের মনোনীত করা প্রয়োজন। সেই সাথে এলাকার শিক্ষার পরিবেশ ভালো রাখতে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদেরও তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা ও নীতিনৈতিকতার দিকে নজর রাখতে হবে। দামুড়হুদা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বিকাশ কুমার সাহা বলেন, বর্তমানে সব বিদ্যালয়েই মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে ক্লাস নেওয়া হয়। প্রত্যেক স্কুলে একটা করে প্রজেক্টার থাকায় সব ক্লাসে প্রজেক্টরের মাধ্যমে ক্লাস নেওয়া সম্ভব হয় না। বর্তমানে টিফিনের পরে অনেক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যাচ্ছে। তাই বিদ্যালয়ে সরকারিভাবে টিফিনের ব্যবস্থা করা গেলে এ হার কমানো সম্ভব। বর্তমানে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও দু’একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছাড়া এমপিওভুক্ত প্রায় সব বিদ্যালয়েই সরকারিভাবে ভবন নির্মাণের কারণে বর্তমানে অবকাঠামোগত সমস্যা তেমন একটা নেই। তবে বর্তমানে বেঞ্চের সমস্যা রয়েছে। আমরা উপজেলা থেকে গত বছর ও এ বছরও বিভিন্ন বিদ্যালয়ে বেশ কিছু বেঞ্চ দিয়েছি। পরিক্ষার ফলাফলের ব্যাপারে বলেন, বর্তমানে পুরো উপজেলায় বিশেষ করে বোর্ডের পরীক্ষাগুলোর ফলাফল ভালো। ফলাফল আরও ভালো করার জন্য নানাবিধ ব্যবস্থা হাতে নিয়েছি। যেহেতু মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা সুশিক্ষিত জাতি গঠনের দ্বিতীয় ধাপ। উন্নত শিক্ষার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে এ শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। তাই শুধু মাধ্যমিক নয় প্রাথমিক থেকে শুরু করে সকল স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে সকল অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা দূর করে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে বাঙালি জাতিকে বিশ্বের মধ্যে অন্যতম উন্নত জাতিতে পরিণত করার সুব্যবস্থা করবেন বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারের কাছে এমনটাই প্রত্যাশা সচেতন মহলের।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন