বিশ্ব জুড়ে শিল্প বিপ্লব পরপর তিনটি হয়ে গেল। কিন্তু আমাদের দেশে কোনো শিল্প বিপ্লবই তেমন প্রভাব ফেলতে পারে নাই। তবে তৈরী পোশাক শিল্প বাংলাদেশে শিল্পে বিপ্লব এনেছে। আগামীতে বিশ্বে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশে নতুন ও যুব শিল্প উদ্যোক্তাগণ আইটি খাতকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের টার্গেট করেছে। আশা ও চেষ্টা উভয়ই ভালো। ধীরে ধীরে পা পা করে আমাদের আইটি খাত বেশ অগ্রসর হচ্ছে। রফতানিতে বড় অংশীদার হচ্ছে। তাই তরুণ উদ্যোক্তাগণ আইটি খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে। তবে আমাদের তৈরী পোশাক শিল্প খাত কিন্তু বসে নেই। ধীরে ধীরে বেশ একটি মজবুত অবস্থানে তৈরী পোশাক শিল্প খাত পৌঁছে যাচ্ছে। তৈরী পোশাক শিল্প খাত তথা বস্ত্রখাতের সার্বিক উন্নতির উপর এ দেশের অর্থনৈতিক বিপ্লবের অগ্রগতি নির্ভর করছে। তাই বস্ত্রখাতের উন্নতি বিধান আমাদের মৌলিক কাজ। স্পিনিং, ইউভিং ও ডাইং এই তিনটি খাতের সার্বিক উন্নয়ন আগামী দিনের তৈরী পোশাক শিল্পের মূল চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করবে।
বাংলাদেশের গার্মেন্ট পণ্যের বড় বাজার ইউরোপ ও আমেরিকার বাইরে নতুন বাজারে রফতানিতে বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এক দশক ধরে চেষ্টার পর এসব বাজারে রফতানি বাড়ছে। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) এসব দেশে পূর্বের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে গার্মেন্ট রফতানি বেড়েছে ৩৬ শতাংশেরও বেশি। আলোচ্য সময়ে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের গার্মেন্ট রফতানিতে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ১৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এর মধ্যে ইউরোপে প্রায় ১০ শতাংশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রায় ১৯ শতাংশ। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো’র (ইপিবি) হালনাগাদ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে এ তথ্য জানা গেছে। গতানুগতিক বাজারের বাইরে নতুন বাজারে রফতানি প্রবৃদ্ধিকে সরকার ও উদ্যোক্তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল হিসেবে দেখছেন এ খাতের রফতানিকারকরা। ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রেতারা এখন দর কমানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ফলে এ দুটি বাজারের বাইরে আমরা নজর বাড়িয়েছি। অন্যদিকে গত কয়েক বছরে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের সংস্কারের বিষয়ে ইতিবাচক বার্তা গিয়েছে। এছাড়া চীনে উৎপাদন মূল্য বেড়ে যাওয়ায় তারা ক্রেতাদের সঙ্গে দরে মেলাতে পারছে না। ফলে তাদের ছেড়ে দেওয়া ক্রেতাদের (নতুন বাজারের) কিছু অংশ বাংলাদেশে আসছে।
ইউরোপ ও আমেরিকা অঞ্চলের বাইরের দেশগুলোই মূলত বাংলাদেশের জন্য নতুন বাজার হিসেবে পরিচিত। এসব বাজারে রফতানির ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকেও বিশেষ প্রণোদনার অংশ হিসেবে রফতানি মূল্যের উপর তিন শতাংশ হারে নগদ সহায়তা দিয়ে থাকে।
নতুন বাজারের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, চিলি, চীন, ভারত, জাপান, কোরিয়া, মেক্সিকো, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্কসহ আরো কয়েকটি দেশ রয়েছে। এ দেশগুলোতে গত ছয় মাসে বাংলাদেশ রফতানি করেছে ২৮৯ কোটি ৬৩ লাখ ডলারের গার্মেন্টস পণ্য। এটি আলোচ্য সময়ে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের রফতানিকৃত গার্মেন্টসের প্রায় ১৭ শতাংশ। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে গার্মেন্টস পণ্য রফতানির পরিমাণ ছিল ২১২ কোটি ৬৩ লাখ ডলার, যা ছিল মোট রফতানিকৃত গার্মেন্টসের ১৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ। নতুন বাজারের মধ্যে গত ছয় মাসে সবচেয়ে বেশি রফতানি হয়েছে জাপানে। দেশটিতে আলোচ্য সময়ে ৫৪ কোটি ৭২ লাখ ডলারের পোশাক পণ্য রফতানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি। রফতানিকারকরা বলছেন, এ ধারা অব্যাহত থাকলে দেশটিতে চলতি বছর নাগাদ গার্মেন্টস রফতানি ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে। অন্যদিকে আলোচ্য সময়ে রফতানি বৃদ্ধির হারে শীর্ষে রয়েছে প্রতিবেশী ভারত। আলোচ্য সময়ে প্রতিবেশী এই দেশটিতে গার্মেন্টস রফতানি বেড়েছে ১৪৩ শতাংশ। রফতানির পরিমাণ ২৭ কোটি ডলার। অন্যদিকে আলোচ্য সময়ে নতুন বাজারের মধ্যে রফতানি কমে যাওয়া একমাত্র দেশ হলো তুরস্ক। দেশটিতে পূর্বের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১১ কোটি ডলারে।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ছয় মাসে অস্ট্রেলিয়ায় গার্মেন্টস রফতানি বেড়েছে ১৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ, ব্রাজিলে ১৫ শতাংশ, চিলিতে ৫৬ শতাংশ, চীনে ৬১ শতাংশ, কোরিয়ায় ৫৬ শতাংশ, মেক্সিকো, ৩৯ শতাংশ, রাশিয়ায় ২১, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৫৬ ও অন্যান্য দেশ মিলিয়ে ১৯ শতাংশ রফতানি বেড়েছে। রফতানিকারকরা জানিয়েছেন, নতুন বাজারের মধ্যে ব্রাজিল, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক বাদে অন্য দেশগুলোতে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়।
উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য করণীয়: ১) দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা আসছে তৈরী পোশাক শিল্প খাত থেকে। বস্ত্র খাতসহ তৈরী পোশাক শিল্পে কর্মে নিয়োজিত শ্রমিক সংখ্যা ৪০ লাখের অধিক। নারীর সংখ্যা অধিক। এত বেশী নারী শ্রমিক বাংলাদেশের কোন খাতে নেই। তৈরী পোশাক শিল্পের নতুন এই বাজার স¤প্রসারণ করতে হবে। নতুন নতুন আরও বাজার সৃষ্টির জন্য সরকারী বেসরকারীভাবে উদ্যোগ, চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। এই জন্য উল্লিখিত দেশসমূহে প্রতি বছরে একটি করে তৈরী পোশাক শিল্পের মেলা করতে হবে। নতুন নতুন দেশে আমাদের পোশাকেরকদরকে বেশি করে উপস্থাপনের মাধ্যমে ক্রেতাদের নিকট মেলে ধরতে হবে। দ্বিপাক্ষিক সফরের মাধ্যমে তৈরী পোশাক শিল্পের বাজার স¤প্রসারণের উদ্যোগ আরও বেশি করে নিতে হবে।
২) ভারত, চীন আমাদের আগামী দিনের জন্য তৈরী পোশাক শিল্পের সবচেয়ে বড় বাজার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এখন থেকে ভারত ও চীনকে টার্গেট করে বেশ কিছু কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিগত ছয় মাসে ভারতে তৈরী পোশাক রফতানি হয়েছে ২৭ কোটি মার্কিন ডলার সম মূল্যের। এই দুই দেশে আমাদের রফতানিকে কয়েকগণ বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে কাজ করা উচিত। এই দুই দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক ঘাটতি কমানোর জন্য তৈরী পোশাক খাতই একমাত্র প্রধান ভরসা।
৩) ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, রাশিয়া, ও তুরস্কে আমরা শুল্ক মুক্তভাবে পোশাক রফতানি করতে পারছি না। উল্লিখিত দেশসমূহে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া গেলে আমাদের রফতানি দ্বিগুণ ছাড়িয়ে যাবে। সরকারিভাবে শুল্কমুক্ত সুবিধা লাভের জন্য আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করা দরকার।
৪) তুরস্ক আমাদের বন্ধুপ্রতিম মুসলিম রাষ্ট্র। রাজনৈতিক কারণে তুরস্কের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সবচেয়ে উত্তম হওয়া উচিত। কিন্তু নানা কারণে আমাদের সম্পর্কের কিছুটা ভাটা লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু বেশ কিছূ দিন পূর্বে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের সহযোগিতার হাত যেভাবে তুরস্ক এগিয়ে দিয়েছে, তা বেশ লক্ষণীয়। আমাদেরকে তুরস্কের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তাতে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটবে। সম্পর্ক যত বেশি ভালো হবে, ব্যবসাও তত বেশি ভালো হবে। এখনও আমরা তুরস্কে শুল্কমুক্ত রফতানির সুযোগ পাচ্ছি না। শুল্কমুক্ত রফতানি তুরস্কে করতে পারলে আমাদের তৈরী পোশাকসহ অন্যান্য রফতানি কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে সরকারকে দেখতে হবে। তুরস্কের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বেশ জোরদার করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে তুরস্কে রাষ্ট্রীয় সফর করা প্রয়োজন। বিশেষ করে তুরস্ক, কাতার, কুয়েত, সৌদি আরব, মালয়েশিয়ার সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করা জরুরি। তৈরী পোশাক ছাড়াও জনশক্তি রফতানিতে উল্লিখিত দেশসমূহ বেশ ভালো ভূমিকা রাখতে পারে।
৫) ভারত ও চীন ছাড়া জাপানকে আমরা আমাদের তৈরী পোশাক শিল্প রফতানিতে তৃতীয় দেশ হিসাবে টার্গেট পরিকল্পনায় রাখতে পারি। তৈরী পোশাক শিল্প মালিক ও ইপিবিকে জাপানে শিল্প প্রদর্শনীর আয়োজনের ব্যবস্থা করা দরকার। জাপানে আমাদের দূতাবাসের বাণিজ্যিক কর্মকর্তার তৎপরতা কয়েকগুণ বৃদ্ধি করতে হবে। বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের একটি রফতানি উদ্যোক্তাদের বিশেষ একটি সফর জাপানে দ্রæত করা প্রয়োজন। উক্ত সফরে তৈরী পোশাকের ক্রেতাদের সঙ্গে সেমিনার ও দ্বিপাক্ষিক আলোচনা বৈঠকের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাছাড়া জাপান আমাদের দূতাবাসে একটি স্থায়ী তৈরী পোশাক শিল্পের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। উক্ত প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের প্রতিটি সিজনের তৈরী পোশাকসমূহ প্রদর্শন করা যেতে পারে। তাতে জাপানের ক্রেতাগণ সহজে বাংলাদেশের তৈরী পোশাকের নমুনা দেখে জাপানে বসে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্প মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে। সহজে রফতানি আদেশ ও স্থাপন করতে পারবে। জাপান ভারত ও চীন এই তিন দেশে আমাদের কূটনৈতিক মিশন অফিসে তৈরী পোশাকসহ অন্যান্য রফতানি যোগ্য পণ্যের এক একটি স্থায়ী রফতানিমুখী পণ্যের প্রদর্শনী স্থাপন করা যেতে পারে। ইপিবি এই ক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণ করে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করে আদেশ প্রদান করা জাতীয় স্বার্থে খুবই জরুরি। এই ক্ষেত্রে এফবিসিসিআইসহ সকল বাণিজ্যিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসা উচিত।
লেখক: সাবেক সহসভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি.
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন