মুনশী আবদুল মাননান
‘দেশ এগিয়ে যাচ্ছে’, ‘দেশজুড়ে উন্নয়নের জোয়ার বইছে’, ‘মধ্যম আয়ের দেশ হতে খুব বেশি দেরি নেই’ ইত্যাকার কথাবার্তা শুনতে শুনতে রীতিমতো পেরেশান হয়ে পড়েছে দেশের মানুষ। সরকারের তরফে একের পর এক বিপুল ব্যয়সাপেক্ষে বিশাল বিশাল প্রকল্পের ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। সাড়ম্বরে প্রকল্পের পর প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হচ্ছে। কিছু প্রকল্পের কাজ ইতোমধ্যে শুরুও হয়েছে। প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন সময় যা নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে বহু বছর লেগে যাবে সুফল পেতে। তাও যদি নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়, তবেই। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কোনো বড় প্রকল্পই নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। দুই বছর মেয়াদি প্রকল্প ছয় বছরেও শেষ হয়নি, এমন নজিরও রয়েছে। মাঝখান থেকে জনদুর্ভোগ প্রলম্বিত হওয়ার পাশাপাশি প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে অবিশ্বাস্যভাবে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে গৃহীত মেগা প্রকল্পগুলো কবে নাগাদ শেষ হবে, কারো পক্ষেই বলা সম্ভব নয়। এও কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয়, প্রতিটি প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয়ের চেয়ে কত বেশি ব্যয় শেষ পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়াবে। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন সাপেক্ষে উন্নয়নের যে চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে তা চমৎকৃত হওয়ার মতো। আমরাও অস্বীকার করি না, প্রকল্পগুলো ঠিক সময়ে এবং যথাযথ মানসম্পন্নভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশের চিত্র-চারিত্রে একটা ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হবে। মেগা প্রকল্পগুলোর অর্থের একটা বড় অংশের জোগান দেয়া হচ্ছে বা হবে সরকারের কোষাগার থেকে। একে কেউ নেতিবাচক বলে ভাবে না, যদি জনগণের ট্যাক্সের টাকা ন্যায়সঙ্গতভাবে ব্যয় হয় এবং তার সুফল তারা যথাযথ প্রাপ্ত হয়।
সরকার উন্নয়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে, এ কথা সরকারি মহল থেকে বারংবার বলা হচ্ছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রেকর্ড রিজার্ভ, বাম্পার ফসল উৎপাদন, দেশজ শিল্প উৎপাদন, রফতানি আয়, রেমিটেন্স ইত্যাদি নিয়েও সরকারের গর্ব ও অহঙ্কারের শেষ নেই। বলা যায়, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির একটা স্বপ্ন সরকার ছড়িয়ে দিচ্ছে দেশময়। কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতা অনেক ক্ষেত্রেই স্বপ্নের সঙ্গে সঙ্গতি বিধান করছে না। এ প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক ও সঙ্গত যে, এত মেগা প্রকল্পসহ যে শত শত উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত হয়েছে সেগুলোর বাস্তবায়নের জন্য যে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থের প্রয়োজন হবে তার সংস্থান কীভাবে হবে ? নিজস্ব অর্থায়নে এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এমনকি যতটা অর্থায়নের কথা বলা হচ্ছে, ততটাও দেয়া সম্ভব হবে কিনা, নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। বৈদেশিক সহায়তা কি পরিমাণ পাওয়া যাবে তাও বলা যাচ্ছে না। বিদেশি বিনিয়োগ ইতোমধ্যে প্রান্তিক পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে। বিনিয়োগের অনুকূল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, অবকাঠামো সুবিধা ইত্যাদি নিশ্চিত না হলে বিদেশি বিনিয়োগ আশানুপাতে আসবে না। যেমন এখন আসছে না। দেশি বিনিয়োগও নিরুৎসাহের শিকার একই কারণে। এমতাবস্থায়, জনগণের ঘাড়ে ট্যাক্সের বোঝা চাপিয়ে পার পাওয়া যাবে না। এতে বরং জনগণের দুঃখ-দুর্ভোগ ও জীবনযাপনের কষ্ট বাড়বে। রিজার্ভের একের পর এক রেকর্ড ভঙ্গ সব সময় সুস্থ অর্থনীতির পরিচায়ক নয়। পণ্যসহ শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি স্বাভাবিক ও আশাব্যঞ্জক থাকলে রিজাভর্- স্থিতি এত থাকার কথা নয়। এটা ঠিক, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধানসহ বিভিন্ন ফসলের বাম্পার ফলন হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর প্রধান কারণ প্রাকৃতিক আনুকূল্য। ব্যাপকভিত্তিক কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় না ঘটার কারণে ফসল উৎপাদন স্বাভাবিক রয়েছে। এইসঙ্গে নেতিবাচক খবরও আছে। কৃষকরা তাদের ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। তারা যে ফসলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না, সে ফসল ছেড়ে ভিন্ন ফসল আবাদে চলে যাচ্ছে। এখন ধানের ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কৃষকরা কোনো বছরই ধানের ন্যায়সঙ্গত মূল্য পাচ্ছে না। যে মূল্য পাচ্ছে তাতে উৎপাদন খরচও উঠছে না। ফলে তারা ধানের বদলে ভুট্টা, তামাক, শাক-সবজি ইত্যাদি আবাদে ঝুঁকে পড়ছে। এবার বোরো ধানের আবাদ আগের বছরের তুলনায় কম হয়েছে। এ গেল একদিক। অন্যদিক হলো, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুবির্পাকে এক বছর যদি খাদ্যশস্যের আবাদ ব্যাহত হয় বা মার খায় তবে খাদ্য মজুদ মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। বিনিয়োগ বন্ধ্যত্বের কারণে শিল্পবিকাশ থমকে আছে। সবচেয়ে বড় শিল্প খাত গার্মেন্টের অবস্থা ভালো নয়। ইতোমধ্যে শত শত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এবং আরও শত শত বন্ধ হওয়ার পথে। এ খাতে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে এবং আরো হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হওয়ার পথে। পাট, চিনি, বস্ত্র, চামড়া ইত্যাদি সব শিল্পের অবস্থাই নি¤œমুখী। স্বভাবতই উৎপাদন হ্রাসমান। রফতানিতে নেতিবাচক অবস্থা বিদ্যমান। রফতানি আ্যয় আগামীতে বাড়বে, এমন সম্ভাবনা কম। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম বড় উৎস জনশক্তি রফতানিতেও চলছে ভাটার টান। আয় ক্রমাগত কমছে। রাজস্ব আয়ও অধ:মুখী। এবার রাজস্ব আদায়লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।
এই বাস্তবতা যে বার্তা দিচ্ছে, তা অত্যন্ত বিচলনযোগ্য। আগামীতে অর্থনীতি আরো নাজুক অবস্থার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হতে পারে। জনগণের জীবনযাত্রা আরো কঠিন ও দুর্বহ হয়ে পড়তে পারে। বিনিয়োগ ও শিল্পবিকাশের অভাবে নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে না; উল্টো অনেকেই কর্ম হারিয়ে বেকারের খাতায় নাম লেখাচ্ছে। কোটি কোটি মানুষ এমনিতেই বেকার। তার ওপর প্রতি বছর ২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। এদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য হু হু করে বাড়ছে। বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। চালের দামে কতকটা স্থিতিশীলতা বিরাজ করলেও অন্যান্য প্রতিটি জিনিসের দামই ক্রমবর্ধমান। দেশের কিছুসংখ্যক মানুষ আর্থিক দিক দিয়ে ভালো অবস্থায় থাকলেও আমজনতার আর্থিক অবস্থা ক্রমাবনতিশীল। তাদের অবস্থা নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এই আমজনতাই সরকারের রাজস্ব আয়ের প্রধান অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির দাম দফায় দফায় বাড়িয়ে তাদের পকেট শূন্য করা হচ্ছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও দীর্ঘ বিলম্বে যতটা দাম কমানো হয়েছে, আমজনতার তাতে কোনো লাভ হয়নি, সরকার তেল নিয়ে ব্যবসা করেছে এবং এখনো করছে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হলে পরিবহন ভাড়া অনেক কমতো, পণ্য উৎপাদন ও পণ্যমূল্যে তার ইতিবাচক প্রভাব প্রতিফলিত হতো। আমজনতাকে কার্যত ‘কামধেনু’ হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে। অর্থের দরকার পড়লে তাদের পকেটে হাত চালানো হচ্ছে। প্রতি বছরই নানাভাবে কর-শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। আগামী বাজেটেও কর-শুল্ক বাড়ানোর বড় রকমের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরের জন্য সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা বাজেট প্রস্তাবনা প্রস্তুত করা হয়েছে। বাজেটে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। বাজেটের প্রায় ৬০ শতাংশের অর্থায়নের দায় রাজস্ব বিভাগের পক্ষে মেটানো যে কঠিন তা বোঝার জন্য অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই। সাধারণ ওয়াকিবহাল মানুষও বোঝে, এই অর্থ যোগান দেয়া অসম্ভব। তার পরও এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বোঝাই যায়, কর-শুল্কের একটা বিরাট বোঝা আমজনতার ঘাড়ে চাপাতে যাচ্ছে।
এক খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, আগামী অর্থ বছরের বাজেটে এনবিআর আগের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে নতুন পথে হাঁটার ছক তৈরি করেছে। এর আগ পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের প্রধান খাত ছিল প্রত্যক্ষ কর বা আয়কর। প্রস্তাবিত বাজেটে পরোক্ষ কর বা ভ্যাটের ওপর নির্ভরতা স্থির করা হয়েছে। ভ্যাটের আওতা ও হার বাড়ানো হচ্ছে। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন সাপেক্ষে এই অর্থ তুলে আনা হবে। এনবিআর’র সূত্র মতে, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের দোকানও ভ্যাটের আওতায় আসছে। উচ্চ আয়ের ব্যবসা- প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অনলাইনে ভ্যাট আদায় বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। বিপণন কেন্দ্রে ইলেকট্রিক ক্যাশ রেজিস্টার মেশিনের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। তৃণমূল পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের হিসাব সংরক্ষণে আগ্রহী করতে কৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে। প্রকৃত বিক্রীর ওপর সর্বত্র ভ্যাট প্রদানের নিয়ম করা হচ্ছে। স্থাবর সম্পত্তি, ইজারা, অধিকার সুবিধা অর্জন, লাইসেন্স পারমিটসহ আমদানি, উৎপাদন, ব্যবসায়ী পর্যায়ে পণ্য ও সেবার অধিকাংশ খাতে ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। হোটেল-রেঁস্তোরাসহ সব ধরনের খাবারের দোকান, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত গুঁড়ো দুধ, সব ধরনের মসলা, বিস্কুট, চকোলেট, আচার, চাটনি, সস ও সব ধরনের ফলের জুসের ওপর ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, ভূমি উন্নয়ন সংস্থা, সোনা সবরহাকারী, বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থা, অন লাইনে বিক্রীর পণ্য, চেইনশপ, জমি নিবন্ধন, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, বেসরকারি মেডিক্যাল ও প্রকৌশল কলেজের ওপর ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। জানা গেছে, এই সব প্রস্তাবনা এনবিআর বাজেটের সঙ্গে সংযুক্ত করবে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তর পর।
আগামী অর্থ বছর থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে আছে। ব্যবসায়ীরা নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে আপত্তিও জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে দুটি চিঠি দিয়েছেন। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কোনো সিদ্ধান্ত বা মতামত এখানো জানা যায়নি। তবে খুব শিগগিরই জানা যাবে, এমনটিই ধারণা করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো দ্বিতীয় চিঠিতে বলেছে, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়িত হলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তারা ক্ষতির শিকার হতে পারে। এ আশঙ্কা ছাড়াও ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের অসন্তোষ ও ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে কোনো মহল রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টাও করতে পারে। আশঙ্কার এই প্রেক্ষিতে সংগঠনটি ১৫ শতাংশের পরিবর্তে হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য ‘প্যাকেজ’ পদ্ধতির ভ্যাট প্রথা পুনর্বহালসহ যৌথ কমিটির সাত দফা সুপারিশ বাস্তবায়নের তাকিদ দিয়েছে। প্রথম চিঠিতে এফবিসিসিআই’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, নতুন ভ্যাট আইনের অধীনে মোট বিক্রয় মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হবে। এতে রেয়াত গ্রহণে অসমর্থ ৮৫ শতাংশ করদাতা বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভ্যাট ব্যবস্থা আবগারী শুল্কে পরিণত হবে। যৌথ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী মূল্য সংযোজিত অংশের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হলে ভ্যাট ব্যবস্থা সহজ ও গতিশলী হবে, ভ্যাট নেটওয়ার্ক বাড়বে এবং আয় বেশী হবে। স্মরণ করা যেতে পারে। ২০১২ সালে আইনটি পাস হলেও ব্যবসায়ীদের বিরোধিতার কারণে তা কার্যকর হতে পারেনি। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যবসায়ীদের দাবির প্রেক্ষিতে একটি উচ্চ পর্যায়ের যৌথ কমিটি গঠিত হয়। যৌথ কমিটি সাত দফা সুপারিশ প্রদান করে। ১৫ শতাংশের বদলে হ্রাসকৃত হারে কিংবা বহুস্তর ভ্যাট ব্যবস্থা রাখা, টার্নওভার ভ্যাটের হার শিথিল করা, ব্যবসায়ীদের দায় তাদের আত্মীয়দের ঘাড়ে না দেয়াসহ সাতটি বিষয়ে সরকার ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের মধ্যে ঐকমত্য হয়। কিন্তু এসব সুপারিশ অর্থ মন্ত্রণালয় গ্রহণ করছে না বলে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ। এর মধ্যেই অর্থমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, সব ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট রেখেই ভ্যাট আইন কার্যকর হবে।
নতুন ভ্যাট আইনে পণ্য ও সেবার ওপর উচ্চ মূল্যে ভ্যাট আরোপের যে ব্যবস্থা রয়েছে তা কার্যকর হলে পণ্যমূল্য বাড়তে পারে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়তে পারে এবং এ নিয়ে জন ক্ষোভ সৃষ্টি হতে পারে, এসব আশংকা শুধু ব্যবসায়ীদের নয় অনেকেরই। স্বয়ং এনবিআর এ ব্যাপারে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে যেখানে বলা হয়েছে, নতুন ভ্যাট আইনের বাস্তবায়ন হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পেয়ে মূল্যস্ফীতি দেখা দেবে। কারণ, এতে গৃহস্থালি ব্যয় বেড়ে সার্বিক জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। এ আইনের কারণে সরকারী প্রকল্পের ব্যয় বাড়বে। বাড়বে ব্যবসা পরিচালনা ব্যয় ও কোন কোন খাতে কিভাবে ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য বাড়বে তার কিছু উদাহরণ প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, বিদ্যুৎ বিলের সংকুচিত ভিত্তিমূল্যে ৫ শতাংশ ভ্যাট আছে। নতুন আইন অনুযায়ী বিদ্যুৎ বিলের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসবে। এতে গৃহস্থালি ও শিল্পের অর্থনৈতিক ব্যয় বাড়বে। বর্তমানে বিদ্যুৎ বিলসহ ২০ ধরনের সেবার ওপর সংকুচিত ভিত্তিমূল্যে বিভিন্ন হারে (২ থেকে ১০ শতাংশ) ভ্যাট আরোপ করা আছে। নতুন আইনে এসব খাতে অভিন্ন ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপিত হলে ওই সব পণ্য ও সেবার পেছনে ক্রেতার খরচ অনেক বাড়বে। এছাড়া নতুন আইনে আগে ভ্যাট অব্যাহতি ছিল এমন ১ হাজার ৯৭৩টি পণ্যে-ভ্যাট বসবে। ফলে এসব পণ্য বাড়তি দামে কিনতে হবে। এনবিআর’র বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সব মিলিয়ে ট্যারিফ আইনের ৭৪ দশমিক ৪ ভাগ পণ্যে সরাসরি ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে ৮৫টি পণ্যের ওপর এখন ট্রারিফ মূল্য ধরে ভ্যাট আরোপ করা আছে। অত:পর এদের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপিত হলে এদের দামও বাড়বে। সবচেয়ে বেশী বাড়বে রডের দাম। এখন একটন রডে ৪১২ টাকা ৫০ পয়সা ভ্যাট দিতে হয়। নতুন আইনে রেয়াতের পরও বর্তমান বাজার দরে ভ্যাট দিতে হবে ৩ হাজার ২২৯ টাকা। অর্থাৎ টন প্রতি বাড়বে ২ হাজার ৮১৬ টাকা। এতে সরকারী-বেসরকারী সব পর্যায়ের নির্মাণ ব্যয় বাড়বে। ইট-বালুর ওপর ২৩ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। সেক্ষেত্রে নির্মাণ ব্যয় কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, আন্দাজ করা কঠিন নয়। নির্মাণ সামগ্রীর ওপর এই চড়া হারে ভ্যাট আরোপে বেসরকারী আবাসন শিল্পখাত বিপর্যয়ে বাড়বে। অন্যদিকে সকল সরকারী উন্নয়ন প্রকল্পে বাজেট বৃদ্ধি পাবে। সকল পণ্য ও সেবার ওপর এই উচ্চ ভ্যাট আরোপের প্রতিক্রিয়া-পরিণতি ভয়াবহ হওয়ার আশংকাই প্রবল। কারো অজানা নেই, পরোক্ষ কর বা ভ্যাট মূলত: ক্রেতা-ভোক্তাদেরই বহন করতে হয়। ক্রেতা-ভোক্তার প্রায় সবাই সাধারণ মানুষ। বাজেটের ভ্যাট ছক এবং ভ্যাট আইন বাস্তবায়িত করতে গেলে সাধারণ মানুষের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়বে। তাদের জীবনযাত্রার ব্যয়-বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কষ্ট-দুর্ভোগ-যাতনার কোনো শেষ থাকবে না। স্বভাবতই তাদের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাবে। সে ক্ষেত্রে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যও অনর্জিত থেকে যাবে। আর রাজস্ব আয়ে ঘাটতি হলে বাজেট বাস্তবায়ন হবে অসম্ভব। এর ফলে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নও মুখ থুবড়ে পরতে পারে এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে ভ্যাট সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন