বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শৃঙ্খলায় ফেরাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ প্রণয়ন করেছে সরকার। যাদের জন্য এই আইন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ই প্রতিনিয়তই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে আইনকে। অনুমোদন পাওয়া শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অর্ধশত বিশ্ববিদ্যালয়ই আইনের কোন তোয়াক্কা করছে না। বারবার আইন অমান্য করেও শাস্তি না হওয়ায় এসব বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের আইনের উর্ধ্বে মনে করছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে সরকারের কাছে আয়-ব্যয়ের হিসেব দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। রয়েছে একটি নির্দিষ্ট সময় পর স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার। ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারার নিয়োগ দিয়ে পরিচালনা করা, নিয়মিত অর্থ কমিটি ও সিন্ডিকেট সভা করাও বিধান রয়েছে আইনে। কিন্তু হাতে গোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বেশিরভাগই এসব আইন অমান্য করেই পরিচালিত হচ্ছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, বর্তমানে ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন রয়েছে। এরমধ্যে ৯০টি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে জমা দেয়া বাধ্যতামূলক। অথচ কয়েকদফা সময় বেধে দেয়ার পরও বেশিরভাগই তা মানেনি। গত বছরের অডিট রিপোর্ট দেয়ার শেষ সময় ছিল ডিসেম্বর পর্যন্ত। অথচ ফেব্রæয়ারি মাস পর্যন্ত মাত্র ৪১টি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অডিট রিপোর্ট জমা দিয়েছে। বাকি ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয় সেই নির্দেশনাকে আমলেই নেয়নি। এ ব্যাপারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলোর কাছে বারবার তাগিদ দিলেও কাজ হচ্ছে না। এছাড়া যেসব প্রতিবেদন কমিশনে জমা হচ্ছে তাতেও প্রকৃত তথ্য উঠে আসছে না বলে মনে করছে ইউজিসি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, অডিট রিপোর্ট না দেয়া কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের রোগে পরিণত হয়েছে। কারণ বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা কোনো নীতিমালা না মেনে ইচ্ছেমতো অর্থ ব্যয় করে। শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি বাবদ আদায় করা টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা ইচ্ছেমত খরচ করারও অভিযোগ আছে। সম্প্রতি ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা এক্সচেঞ্জ ও লিডারশিপ বিল্ডাপ প্রোগ্রামের নামে ফ্যামিলিসহ ইউরোপের ৬টি দেশ ভ্রমণ করেছেন। এর আগে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ট্রাস্টি বোর্ডের সভা করেছে কানাডাতে। নামিদামি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ রয়েছে। দু’একটির বিরুদ্ধে তদন্তও করেছে দুদক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে ব্যয়ের কারণে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষামানের উন্নয়নে কোনো অর্থ ব্যয় করা হয় না। এ কারণে আয়-ব্যয়ের হিসাব এবং এ সংক্রান্ত নিরীক্ষা প্রতিবেদন মন্ত্রণালয় ও কমিশনে জমা দিতে অনাগ্রহ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। অনিয়ম আড়াল করতেই বছরের পর বছর অডিট রিপোর্ট দিচ্ছে না তারা। আর যারা দিচ্ছেন তারাও দায়সারা। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক স্বচ্ছতা আনতে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। রোগ সারাতে নতুন ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ভাবছে মন্ত্রণালয়। তাই যারা অডিট রিপোর্ট দিচ্ছে না তাদের কড়া সতর্ক বার্তা দেয়া হচ্ছে। এর পরই চ‚ড়ান্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল স‚ত্র জানিয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যে ৪১টি বিশ্ববিদ্যালয় অডিট রিপোর্ট জমা দিয়েছে সেগুলো হলো- বিজিএমইএ, আশা, স্টামফোর্ড, এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্টার্ন, ব্র্যাক, মানারাত, পুন্ডু, মেট্রোপলিটন, সোনারগাঁও, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং, এশিয়া প্যাসেফিক, ইউরোপিয়ান, কানাডিয়ান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, প্রাইম এশিয়া, বিজিসি ট্রাস্ট, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি, এশিয়ান, প্রাইম, উত্তরা, গণ, পিপলস, লিডিং, পোর্টসিটি, হামর্দদ, ড্যাফোডিল, আহসানউল্লাহ, ফেনী, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ, মিলেনিয়ান, নর্থ ওয়েস্টার্ন, সেন্ট্রাল উইমেন্স, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার এন্ড টেকনোলজি, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ বরিশাল এবং নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
অডিট শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, যারা এখনো অডিট রিপোর্ট দেয়নি তাদের কড়া সতর্কমূলক চিঠি দিয়ে জবাব চাওয়া হবে। জবাব সন্তোষজনক না হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়টি মন্ত্রীকে অবহিত করা হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের বলা আছে, যারা অডিট রিপোর্ট দিবে না তাদের বিরুদ্ধে ৪৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী পাঁচ বছরের কারাদন্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান আছে।
স্থায়ী ক্যাম্পাসে নেই ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয়: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুয়ায়ি অনুমোদন পাওয়ার ৭ বছরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। বর্তমানে শিক্ষা কার্যক্রমে থাকা ৯০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৫৩টি অনুমোদন পাওয়ার সময়সীমা ৭ বছরের বেশি। অথচ এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ১৩টি এখন পর্যন্ত স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে পেরেছে। বাকী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ২৫টি স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ করলেও সেখানে যাচ্ছে না। বরং রাজধানীতে বিভিন্ন ভবন, ফ্ল্যাট, বাসা ভাড়া নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। যদিও বিষয়টি নিয়ে প্রতিবছরই চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হয়। এর আগে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে নুরুল ইসলাম নাহিদ বারবার এবিষয়ে হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছিলেন। কিন্তু কোন কিছুইতেই কোন কাজ হয়নি। মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের উচ্চপর্যায়ের একটি বৈঠকে ইউজিসির প্রণীত বেসরকারি বিশ্বদ্যালয়গুলোর সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সম্পূর্ণ ও আংশিক শিক্ষা কার্যক্রম নিজস্ব ও স্থায়ী ক্যাম্পাসে চালু করেছে এমন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা হচ্ছে ১৯টি। ১২টি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষাকার্যক্রম চালু করার ব্যাপারে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।
ইউজিসি সূত্রে জানা যায়, ১২ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় দুই যুগ আগে অনুমোদন পেলেও এখন পর্যন্ত নিজস্ব ও স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়ে তোলেনি। গত ১৬ আগস্ট ওই ১২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটিকে পৃথক চিঠি দিয়ে আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নিজস্ব ক্যাম্পাসে অনুমোদিত শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করতে নির্দেশ দেয়া হয়।
শুধু আর্থিক হিসেব না দেয়া কিংবা স্থায়ী ক্যাম্পাসে না যাওয়াই নয়, অর্থ কমিটি, সিন্ডিকেট সভা না করা, ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারার ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। আইন অনুযায়ি, কেবল চ্যান্সেলর নিযুক্ত বৈধ ভিসিই সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ডিগ্রির সনদে সই করতে পারেন। অথচ বহু বিশ্ববিদ্যালয় চলছে বৈধ ভিসি ছাড়া। ২০১৮ সাল পর্যন্ত অনুমোদন পাওয়া ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২৩টিতে নেই কোন ভিসি। প্রো-ভিসি ছাড়া ৭১টি ও ট্রেজারার ছাড়া পরিচালিত হচ্ছে ৫১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ ওই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদ ছাড়া উচ্চশিক্ষা দানকারী কোনো প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না। কোষাধ্যক্ষ ছাড়া কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা এবং আর্থিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা যায় না। আবার যেখানে ট্রেজারার আছে, সেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের পছন্দের লোক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এভাবে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা অর্থ আত্মসাৎ করছে বোর্ড অব ট্রাস্টি (বিওটি’র) সদস্যরা।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান বলেন, কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে একটিও সিন্ডিকেট, অর্থ কমিটি ও বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভা হয় না। এটি সম্পূর্ণরূপে আইনের লঙ্ঘন। অনেকে উচ্চশিক্ষাকে বিনিয়োগ এবং মুনাফা লাভের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন। কিন্তু এটি মুনাফা লাভের জন্য নয়। তবে বেশকিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের আইন-কানুন যথাযথভাবে পালন করে যাচ্ছে এবং কাক্সিক্ষত শিক্ষা প্রদান করছে। স্থায়ী ক্যাম্পাসের বিষয়ে তিনি বলেন, বারবার বলার পরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাচ্ছে না। তাদের কারণে সম্ভাবনাময় এই সেক্টরের বদনাম হচ্ছে।
যদিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলছেন, আইন কানুন যা করেছে তা যথেষ্ট না। অন্য যেসব সমস্যা আছে তা সমাধান না করে শুধু আইন চাপিয়ে দিতে চায়।
এদিকে সম্প্রতি ইউজিসি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে একটি প্রতিবেদনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে আর্থিক অস্বচ্ছতার অভিযোগ তুলেছে। সংস্থাটি একাডেমিক, প্রশাসনিক অনিয়ম ছাড়াও সার্টিফিকেট বিক্রি সিন্ডিকেটের নামে অর্থ আত্মসাৎ, গবেষণায় খাতের টাকা খরচ না করে আত্মসাতের মতো আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়াসহ ১৬ ধরনের অনিয়ম তুলে ধরেছে। প্রতিবেদনে এসব অনিয়মের জন্য ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য, ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারারকে দায়ী করা হয়।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালনা করতে হলে আর্থিক স্বচ্ছতা অবশ্যই বজায় রাখতে হবে। যারা আইন মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক্ষেত্রে কে প্রভাবশালী কে প্রভাবশালী না এটা মূখ্য না। কারণ কেউ স্বচ্ছতার বাইরে নয়। সবাইকে আইন মানতে হবে।#
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন