প্রয়োজনীয়তা যাচাই না করেই অনুমোদন দেয়া হয়েছে একের পর এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ১০৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে গত ১১ বছরে ৫৪টি অনুমোদন পেয়েছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষার গুণগত মানের চেয়ে শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণ করেছে বলে অভিযোগ নানা মহলে। হাতে গোনা কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বেশিরভাগের বিরুদ্ধেই সার্টিফিকেট বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। করোনাভাইরাস এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে বড় সড় ধাক্কা দিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি এবং করোনাপরিস্থিতির কারণে আয় কমে যাওয়া, অন্যদিকে চলতি বছরের এইচএসসি, আলিম ও সমমানের পরীক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় শিক্ষার্থী সঙ্কটে পড়েছে বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। শিগগিরই এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হলে পরবর্তী সেমিস্টারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী পাবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এমনিতেই আর্থিক টানাপোড়েনে থাকা অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার উপক্রমও হতে পারে বলে জানিয়েছেন তারা।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে গত ১৮ মার্চ থেকে সবধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গত মে মাস থেকে অনলাইনে ক্লাস শুরু করেছে। ভর্তি ও পরীক্ষাও ভার্চুয়ালি নেয়ার অনুমোদন দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ইউজিসি। তবে করোনায় আর্থিক সঙ্কটে থাকার কারণে সকল শিক্ষার্থী টিউশন ফি পরিশোধ করতে না পারায় বিপাকে পড়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এই অবস্থায় গত ১ জুন থেকে সামার সেমিস্টারে ভর্তি শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে ১ জুলাই থেকে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে নর্থ-সাউথ, ইস্ট ওয়েস্ট, ব্র্যাক, আহসান উল্লাহ, ইউনাইটেড, ইন্ডিপেন্ডেন্টসহ প্রথম সারির কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকিরা শিক্ষার্থী সঙ্কটে পড়েছে। আগের সেমিস্টারে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল তার অর্ধেকও এবার পাচ্ছে না তারা। জানা যায়, প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যায়গুলো মোট আসনের মধ্যে গড়ে ৬০-৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি করতে পেরেছে। এর মধ্যে ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ও ব্র্যাক আসনের কোটা পূরণ হয়েছে। নর্থ-সাউথ ১৩শ, ইউনাইটেড পেয়েছে সাড়ে ৪শ’র মতো শিক্ষার্থী পেয়েছে। আর মধ্যসারির ৫০ শতাংশও পায়নি। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি পেয়েছে ৫শ’ আর বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি পেয়েছে ১৬২ জন শিক্ষার্থী। স্টেট, প্রাইম, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল, ইস্টার্ন, আইইউবিএটি’র মত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী খরায় ভুগছে। এছাড়া নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১০ থেকে ২০জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পেরেছে। কোন কোনটিতে এখনো শিক্ষার্থীই পায়নি।
নতুন সেমিস্টারে শতাধিক শিক্ষার্থীও হয়নি মধ্যসারির এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩০টিরও বেশি। আর নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা আরও খারাপ। পরিচিতি না থাকা, শিক্ষার্থীদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য হয়ে না ওঠায় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনাকালীন সময়ে শিক্ষার্থী টানতে ঘাম ঝরাতে হচ্ছে। কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয় টিউশন ফি কমিয়ে, নানা সুযোগ-সুবিধার কথা বলে শিক্ষার্থীদের ভর্তি হওয়ার জন্য অফার দিচ্ছে। তারপরও শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারছে না নতুন গড়ে উঠা বিশ্ববিদ্যালয়। আর এতে ভবন ভাড়া, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন নিয়ে বিপাকে পড়েছেন এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিবোর্ডের সদস্যরা।
সেন্ট্রাল উইমেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানান, এইচএসসি পরীক্ষা হলে এই সময়ে অনেক শিক্ষার্থী পাওয়া যেতো। এমনিতে পরীক্ষা হয়নি, তার ওপর করোনাপরিস্থিতি চরম সঙ্কটে ফেলেছে। তিনি জানান, যেভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি কমছে তাতে সামনে কি হয় বলা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার ব্রি. জে. মোঃ মাহবুবুল হক বলেন, করোনার প্রভাব সমাজের সর্বশ্রেণির ওপরই পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এর বাইরে না। এই সেমিস্টারে প্রত্যাশা অনুযায়ী শিক্ষার্থী ভর্তি হয়নি। এইচএসসি পরীক্ষা এখনো হয়নি ফলে সামনে আরও বড় প্রভাব পড়বে। সামনে যে সেমিস্টার আছে সেটির আগে পরীক্ষা-রেজাল্ট না হলে একটা সেমিস্টার গেপ হয়ে যাবে। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি সঙ্কট মোকাবেলার।
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভিসি প্রফেসর ড. চৌধুরী মফিজুর রহমান বলেন, আমাদের সেমিস্টার এপ্রিলে শুরু করার সূচি ছিল, করোনায় সেটি পিছিয়ে জুলাইয়ে শুরু হলো। এই সেমিস্টারেই শিক্ষার্থী অনেক কমে গেছে। এইচএসসি পরীক্ষা দেরিতে হলে সামনের সেমিস্টার ফাঁকা যাবে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চরম আর্থিক সঙ্কটে পড়বে। তিনি বলেন, পুরাতন ও যাদের নিজস্ব ক্যাম্পাস আছে তারা হয়তো কোন মতে চলতে পারবে। কিন্তু যারা নতুন, ভবন ভাড়া দিতে হয় তাদের অবস্থা আরও করুন। অনেকেই ভাড়া ও বেতন দিতে পারছে না। সেক্ষেত্রে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো বন্ধও হয়ে যেতে পারে। শিক্ষার্থী ও বিশ^বিদ্যালয়গুলোর আর্থিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন চৌধুরী মফিজুর রহমান।
জানতে চাইলে এসোসিয়েশন অব প্রাইভেট ইউনিভার্সি বাংলাদেশ (এইউপিবি) এর চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন বলেন, ভর্তিতে নতুন (গত ১০-১২ বছরে যেগুলো অনুমোদন পেয়েছে) বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুব একটা সাড়া পাচ্ছে না। পুরাতন ও বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিছুটা ভালো আছে। তবে সামনের দিনে এইচএসসি পরীক্ষার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে জানিয়ে তিনি বলেন, পরীক্ষা ও রেজাল্ট না হলে সামনে শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে না। ফলে আর্থিক সমস্যা এখনই চলছে ভবিষ্যতে আরও প্রকট হবে। বিশেষ করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এদের অবস্থা খুবই খারাপ। আর্থিক সমস্যা সমাধানে সরকারের কাছে ঋণের আবেদন করা হয়েছে জানিয়ে কবির হোসেন বলেন, আমরা বলছি স্বল্প সুদে কিংবা বিনা সুদে ঋণ প্রদানের জন্য দাবি জানিয়েছি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাছে আবেদন করা হয়েছে। তবে এখনো কোন সাড়া পায়নি।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি ও পরীক্ষা নেয়া জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাথে কথা বলে কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। সেটি অনুসরণ করে তারা শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারে। এগুলো বিশ্ববিদ্যালয় চালু রাখার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। এইচএসসি পরীক্ষা না হলে ভর্তি ও আয় বন্ধ হয়ে যাবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, নতুন ভর্তি হবে না, তবে অন্যান্য সেমিস্টারে যারা ভর্তি রয়েছে তাদের ক্লাস চলবে। যখন পরীক্ষা হবে তখন নতুন ভর্তি হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন