নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় পুরুষশূণ্য হয়ে পড়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের থানারকান্দি গ্রাম। গ্রেফতার আতংকে শত শত লোক পালিয়ে বেড়াচ্ছে। নৌকার সমর্থকদের বাড়িঘর ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট সমান তালে চালানো হচ্ছে। উপযুক্ত মেয়েদের পাঠানো হয়েছে অন্যত্র। জমির পাকা ধান কাটতে না পারায় জমিতেই ঝরে নষ্ট হচ্ছে। দাঙ্গা বন্ধে গ্রামে বসানো হয়েছে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প। তারপরও থেমে নেই ভাংচুর আর লুটপাট।
জানা যায়, ৩১ মার্চ সদ্য উপজেলা নির্বাচনের পরদিন সংঘর্ষ হয়। স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউপি চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান আর নৌকার সমর্থক কাউসার মোল্লার সমর্থকদের মধ্যে। নির্বাচনে দোয়াত-কলম প্রতিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী মনিরুজ্জামান মনির বিজয়ী হয়। সংঘর্ষে কাউসার মোল্লার সমর্থকদের ঘর-বাড়ি ভাংচুর, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগ করা হয়। সংঘর্ষের ঘটনায় নবীনগর থানার এসআই জসিম উদ্দিন বাদী হয়ে অজ্ঞাত ১২শ জনকে আসামি দায়ের করে। মামলা হওয়ার পর থেকেই গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কাউসার মোল্লার সমর্থকরা। তাদের অভিযোগ, নৌকার নির্বাচন করায় স্বতন্ত্র প্রার্থী পক্ষের জিল্লুর রহমানের লোকজন তাদের ওপর হামলা চালিয়ে বাড়ি ঘরে ভাংচুর চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। গ্রাম ছাড়া করা হয়েছে। ইউপি চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান ও তাঁর লোকজন এসব ঘটনার নেতৃত্ব দেয়। পুলিশও তাদের হয়ে হয়রানী করছে। গত ১৮ দিন ধরে থানাকান্দি গ্রামের শত শত লোক বাড়ি ছাড়া। গ্রামের নারী ও শিশুরা সন্ধ্যার পর আতংকে থাকে হামলা আর লুটপাটের ভয়ে। জমির পাকা ধান কাটতে পারছে না কাউসার মোল্লার সমর্থকরা। ধান কাটার জন্য চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমানকে এক হাজার টাকা দিয়ে কাগজে তার স্বাক্ষর নিতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ ওঠেছে।
সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কমপক্ষে ৫০টি বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া বাড়িঘর। ঘরের আসবাবপত্র ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। দুই সপ্তাহ আগেই ফসলি মাঠের ধান পেকে কাটার উপযুক্ত হয়েছে। কিন্তু পাকা ফসল কাটতে বাঁধা দেওয়া হচ্ছে। জমিতে ধানের শীষগুলো মাটিতে নুয়ে পড়ে ধান ঝরে পড়ছে। শত শত কানি জমির ধান নষ্ট হওয়ার পথে। পুলিশের ভয়ে ধান কাটার শ্রমিকরা চড়া মূল্যেও গ্রামে আসতে রাজি হচ্ছে না। মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবে কৃষকরা।
থানাকান্দি গ্রামের গ্রামের হেনা বেগম বলেন, রাতে বাড়িতে থাকতে পারিনা। মেয়েদের অন্যত্র সরিয়ে রেখেছি। পুলিশও হুমকি দিতেছে ধরে নিয়ে যাবে। মেরে ফেলবে। ছেলের বিদেশে যাওয়ার টাকাও লুট হয়েছে।
পার্শ্ববর্তী বড়াইল ইউনিয়নের রাধানগর গ্রামে গিয়ে ফসল প্রক্রিয়া করছে গ্রাম ছাড়া আনোয়ারা বেগম। তিনি জানান, চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর নিয়ে জমির ধান কাটতে হয়। কানি পিছু ১ হাজার টাকাও দিতে হয়। চেয়ারম্যান জিল্লুর আর তার ভাই-ভাতিজারা বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করে ঘরে আগুন দিয়েছে। ১৮ দিন ধরে বাড়ি ছাড়া। তিনি ছাড়াও মোস্তাকিম, হোসেন, খোকন, স্বপন ও জহির মিয়ার বাড়ি ও দোকানে হামলা-ভাংচুর হয়েছে। থানাকান্দি ছাড়াও উত্তর লক্ষীপুর, সাতঘরহাটি ও গৌরনগর গ্রাম অশান্ত নির্বাচনোত্তর এই বিরোধে। গত ১৮দিন ধরে শত শত মানুষ বাড়িছাড়া। বৃদ্ধ আসাদ আলী জানান, পুলিশের ভয়ে চার ছেলের কেউই বাড়িতে নেই। পাকা ধান কাটতে পারছি না। কিছুদিনের মধ্যে নদীর জোয়ারে সব ধান পানিতে তলিয়ে যাবে। বৃদ্ধা মজলিশ বেগম জানান, চেয়ারম্যানের লোকজন বাড়িতে ঢুকে লাঠি দিয়ে মেরেছে। ঘর ভাংচুর করা হয়েছে। আরেক বৃদ্ধ আক্তার মিয়া বলেন, নৌকার নির্বাচন করায় জিল্লুর চেয়ারম্যান ও তার লোকজন হামলা চালায়। কৃষ্ণনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জিল্লুর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। থানাকান্দি গ্রামে পুলিশের অস্থায়ী ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা এস. আই. কামাল হোসেন পক্ষপাতিত্বে অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, পরবর্তী দাঙ্গা এড়াতে সার্বক্ষনিক নজর রাখছি। নবীনগর থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) রাজু আহমেদ জানান, পুলিশ নৌকা বা দোয়াত কলম কারো পক্ষেই পক্ষপাতিত্ব করে কাউকে ধরছে না। যারা দাঙ্গায় লিপ্ত ছিল তদন্ত করে তাদেরকেই ধরা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত উভয় পক্ষের ৩০ জনকে আটক করা হয়েছে। নিরাপরাধ কাউকে পুলিশ ধরছে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন