মানুষ হলো আল্লাহ পাকের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। তাকে তিনি সবচেয়ে বেশি সম্মান এবং সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী করেছেন। মানব সমাজের অর্ধাংশ নর আর অর্ধাংশ নারী। নর-নারী উভয়ে পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। নর ছাড়া নারী চলতে পারে না আবার নারীকে ছাড়াও নরের চলার উপায় নেই। এদের যে কোন একজনকে বাদ দিয়ে মানব সমাজ শুধু অসম্পূর্ণই নয়, এর অস্তিত্বই অসম্ভব। অতএব মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে ইসলামের ঘোষনা নর ও নারী উভয়ের জন্যেই সমভাবে প্রযোজ্য। মানবিকসম্মান ও মর্যাদার বিচারে পুরুষের তুলনায় হীন ও নীচ মনে করা সম্পূর্ণ জাহেলী ধ্যান-ধারণা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত (সৃষ্টির সেরা) হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তিনি কালামে পাকে ঘোষণা করেছেন, “আমি তো সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম গঠনে।” (সূরা তীন: ৪)।
তিনি আরও বলেছেন, “আমি তো আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, ... ... এবং আমি যাদেরকে সৃষ্টি করেছি তাদের অনেকের উপর এদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।” (সূরা বনী ইসরাঈল: আয়াত ৭০)। এরূপ চিন্তা-ভাবনা ইসলাম স্বীকার করে না। তবে নারী হোক বা পুরুষ হোক, প্রত্যেককেই আল্লাহ্ বলেন: “মু’মিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকর্ম করবে তাকে আমি নিশ্চয়ই পবিত্র জীবন দান করবো এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করবো।” (সূরা নাহল: আয়াত ৯৭)।
অর্থাৎ নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যে যে কেউই উত্তম স্বভাব-চরিত্র ও কাজকর্মের অধিকারী হবে, সেই-ই প্রকৃতপক্ষে সফলকাম হবে। কে নারী আর কে নর, এই প্রশ্ন এক্ষেত্রে একেবারেই অবান্তর। পক্ষান্তরে নারী বা পুরুষ যে-ই নিজের আমলের দ্বারা নিজেকে কলঙ্কিত করবে সে-ই চরমভাবে ব্যর্থ হবে। তামাম দুনিয়ায় সর্বত্র যখন নারী উপেক্ষিত ও নির্যাতিত, সেই সময় আবির্ভূত হন বিশ্বশান্তির মূর্ত প্রতীক হযরত মুহাম্মদ (সা)। তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল মানব সমাজের যাবতীয় আবর্জনা ও কুসংস্কার দূরীভূত করে বিশ্ব মানবতার কল্যাণ সাধন। তিনি দেখতে পেলেন, মানবতার অর্ধেক নারী জাতি চরমভাবে অবহেলিত, নিপীড়িত। তাদের মুক্তি ও কল্যাণের জন্য মহান আল্লাহ বিশ্বনবী (সা) এর উপর ওহী নাযিল করলেন। আল্লাহ পাকের নির্দেশ এবং রাসূলুল্লাহ (সা)এর নির্ভুল হিদায়াত নারীরা শুধু নির্যাতন হতে মুক্তিই পেল না, বরং জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাদের ন্যায্য অধিকারও লাভ করল এবং মর্যাদার শিখরে উন্নীত হলো শুধু কাগজে-কলমেই নয়, বাস্তবেও।
পরিবারের সদস্য হিসেবে নারীর অবস্থান : ইসলাম নারীকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়েছে। মর্যাদা দিয়েছে কন্যা, স্ত্রী, মা, খালা, ফুফু এবং সমাজের সদস্যরূপে।
কন্যারূপে নারী : আরব সমাজে কন্যা সন্তান লাভ করা একটা অপমানের ব্যাপার বলে বিবেচিত হত। নিষ্ঠুর পিতা তাই আপন ঔরসজাত কন্যাকে জীবিত কবর দিয়ে নিস্কৃতি লাভ করতো। রহমতের মূর্ত প্রতীক নবী করীম (সা) এই নিষ্ঠুর আচরণ বরদাশত করতে পারলেন না। এই ব্যাপারে তিনি আল্লাহ্ তা’আলার নিদের্শ কামনা করলেন। ওহী নাযিল হলো: “তোমাদের সন্তানদেরকে দারিদ্রতার ভয়ে হত্যা করো না। তাদের আমিই রিযিক দেই এবং তোমাদেরকেও। নিশ্চয়ই তাদেরকে হত্যা করা মহাপাপ।” (সূরা বনী ইসরাঈল : ৩১)। কালামে পাকের এই নির্দেশ জেনে মু’মিনগণ চমকে উঠলেন এবং কন্যা হত্যার নির্দয় অভ্যাস চিরতরে বর্জন করলেন। নবী করীম (সা) নিজেও বাণী প্রদান করলেন ঃ “যে ব্যক্তি দু’টি কন্যা সন্তানকে লালন-পালন করে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে, কিয়ামতের দিন আমি এবং সেই ব্যক্তি হাতের এই দু’টি আঙ্গুলের ন্যায় পাশাপাশি থাকবো।” (সহীহ মুসলিম)। মহানবী (সা) আরও বলেছেন ঃ “যে ব্যক্তির কন্যা সন্তান হবে, সে যদি তাকে জীবিত কবর না দেয়, তার প্রতি তাচ্ছিল্যমূলক আচরণ না করে এবং নিজের পুত্র সন্তানকে তার উপর প্রাধান্য না দেয়, তাহলে আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।” (সুনান আবু দাউদ)।
স্ত্রীর অবস্থানে নারী : ইসলাম-পূর্ব যুগে আরব সমাজে স্ত্রী হিসেবে নারীর কোন মর্যাদা ছিল না। পুরুষেরা খেয়াল-খুশীমত স্ত্রী গ্রহণ করতো, ইচ্ছামত তাদের বর্জন করতো, তাদের প্রতি যথেচ্ছ ব্যবহার করতো। রাসূলে করীম (সা) তাদেরকে আল্লাহ্র কালাম শুনালেন : “তাহার (নারীর) তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ” (সূরা বাকারা : ১৮৭)। “আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সংগিনীদেরকে, যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও” (সূরা রূম: ২১)। এছাড়া রাসূলুল্লাহ্ (সা) নিজেও বাণী প্রদান করলেন, “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিরাই উত্তম যারা স্ত্রীদের সাথে উত্তম ব্যবহার করে” (তিরমিযী)।
মায়ের অবস্থানে নারী : ইসলাম মা হিসেবে নারীকে যে সম্মান দান করেছে তা অতুলনীয়। রাসূলে করীম (সা) এর আবির্ভাবের পূর্বে তামাম দুনিয়ার মানুষই পিতাকে মাতার চেয়ে বেশি সম্মানের পাত্র বলে মনে করতো এবং মাতার উপর পিতাকে প্রাধান্য দিত। কুরআনের আয়াত নাযিল হলো: “আমি তো মানুষকে তার পিতামাতার প্রতি সদাচরণের নিদের্শ দিয়েছি। জননী সন্তানকে কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করে এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বৎসরে।” (সূরা লুকমান : ১৪)।
“মায়ের পদতলে সন্তানের জান্নাত”।
অর্থনৈতিক অধিকার : ইসলামী শরীয়াতের সীমার মধ্য থেকে অর্থনৈতিক ব্যাপারে শ্রম ও সম্পদ বিনিয়োগের অধিকার রয়েছে নারী-পুরুষ উভয়ের। অতএব একজন নারী ঠিক একজন নরের অনুরূপ সম্পদ অর্জনও করতে পারে এবং তার স্বত্ত¡াধিকারীও হতে পারে। সে যে কোনো হালাল পেশা অবলম্বন করতে পারে। আবার সে তার সম্পত্তি সম্পূর্ণ নিজের আয়ত্তে রাখতে পারে এবং নিজের ইচ্ছানুযায়ী ভোগ-ব্যবহার করতে পারে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের অংশ আছে এবং পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীরও অংশ আছে, তা অল্পই হোক অথবা বেশি, এক নির্ধারিত অংশ।” (সূরা নিসা : ৭)।
বিবাহের নারীর সম্মতি : ইসলামী আইনে বিবাহে নারীর সম্মতি একান্ত প্রয়োজন। ইসলামের বিধান এই যে, নারী বিধবা হোক বা কুমারী হোক, তার সম্মতি ব্যতীত তাকে কেউ বিয়ে দিতে পারে না। খানাসা বিনতে খিজাম আনসারিয়া (রা)-কে তার পিতা তার অনুমতি না নিয়ে বিয়ে দিলেন। তিনি মহানবী (সা) এর নিকট নালিশ করেন। মহানবী এ বিয়ে বাতিল করে দেন (সহীহ বুখারী)। এক নারী মহানবী (সা) এর দরবারে এসে নিবেদন করলো, “আমার পিতা আমাকে বিয়ে দিয়েছেন এতে আমি সন্তুষ্ট নই।” মহানবী (সা) তাকে বললেন, “তোমার ইচ্ছা হলে বিয়ে বহাল রাখতে পারো অতবা বাতিল করেও দিতে পারো।” (ইবন মাজাহ)। তালাক এবং খুলা এর মাধ্যমে বিচ্ছেদের অধিকার : কোন দম্পত্তির যদি পারস্পরিক সহাবস্থান সম্ভব না হয়, তাহলে স্বামী যেরূপ তালাক দিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে, স্ত্রীও তেমনি খুল’আর মাধ্যমে কোর্টের সহায়তায় বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে সক্ষম। তালাক হচ্ছে স্বামীর পক্ষ থেকে সংঘটিত বিবাহ-বিচ্ছেদ। অন্যদিকে খুল’আ হয়ে থাকে স্ত্রীর দাবির ভিত্তিতে। আল্লাহর বাণী : “যদি তাদের উভয়ের আশঙ্কা হয় যে, তারা আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করে চলতে পারবে না এবং তোমরা যদি আশঙ্কা করো যে, তারা আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করে চলতে পারবে না তবে স্ত্রী কোনো কিছুর বিনিময়ে নিস্কৃতি পেতে চাইলে তাতে তাদের কারো কোনো অপরাধ নেই” (সূরা বাকারা : ২২৯)। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, “সাবিত ইবনে কায়েসের স্ত্রী নবী (সা) এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল। আমি সাবিত ইবনে কায়েসের চরিত্র এবং ধর্মপরায়ণতা সম্পর্কে কোনো দোষ দিচ্ছি না। কিন্তু আমি চাই না যে, তার সাথে ঘরÑসংসার করতে গিয়ে আমি ইসলামের সীমা অতিক্রম করে কুফরীর মধ্যে নিপতিত হই। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তোমার স্বামী তোমাকে যে বাগানটি দিয়েছিল তুমি কি তাকে তা ফিরিয়ে দিতে রাজী আছ। তিনি বললেন, হাঁ। রাসূলে করীম (সা) সাবিত ইবনে কায়েসকে বললেন, তুমি বাগানটি গ্রহণ করো এবং তোমার স্ত্রীকে তালাক দাও।” (সহীহ বুখারী)।
অভিন্ন আইন : ইসলামে নারী-পুরুষের মর্যাদা সমান এবং তাদের জন্য অভিন্ন আইন প্রণীত হয়েছে। কুরআন মজীদ ঘোষণা করেছে ঃ “পুরুষ অথবা নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকাজ করলে ও মু’মিন হলে তারা জান্নাতে দাখিল হবে এবং তাদের প্রতি অণু পরিমাণও যুলুম করা হবে না।” (সূরা আন নিসা : ১২৪)। বিচারের ক্ষেত্রে ইসলামে নারী এবং পুরুষের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয়নি। যদি কোন মহিলা কোন পুরুষকে হত্যা করে তাহলে তার জন্য যে শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে, পুরুষের জন্যও একই শাস্তি। রাসূলে করীম (সা) এর জারীকৃত আইনের একটি হচ্ছে “স্ত্রীলোকের হত্যাকারী কোন পুরুষ হলে শাস্তিস্বরূপ তাকে হত্যা করা হবে” (বায়হাকীর সুনানুল কুবরা)।
নারী শিক্ষা : দ্বীনী ও পার্থিব শিক্ষা লাভ করার জন্য নারীকে শুধু অনুমতিই দেয়া হয়নি; বরং পুরুষের শিক্ষাদীক্ষা যেমন আবশ্যকীয় মনে করা হয়েছে, তাদের শিক্ষাদীক্ষাও তদ্রƒপ আবশ্যকীয় মনে করা হয়েছে। নবী করীম (সা) বলেন,
“প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জ্ঞান অর্জন করা ফরয” (ইবনে মাজা)।
রাসূলে করীম (সা) এর জীবদ্দশায় এবং খিলাফতে রাশিদা যুগে নারীদের মান উন্নয়নে আল্লাহ পাকের নিদের্শবালী অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালিত হয়েছিল। নারীদের জন্য এটা এক গৌরবের ইতিহাস। পরিতাপের বিষয়, ইসলাম নারীদের মুক্তি ও মান্নোয়নে যে অবদান রেখেছে, নারীরা তা অবহিত নয়। কুরআন ও হাদীসে তাদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে সকল নির্দেশ রয়েছে তা তারা জানে না। বলা নি®প্রয়োজন, নারীদের এ অজ্ঞতা তাদের অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত হওয়ার অন্যতম কারণ। এ অবস্থা নিরসনকল্পে নারীদের সচেতন হতে হবে। এজন্য ইসলামী জ্ঞান অর্জন করা তাদের জন্য অপরিহার্য। তাদেরকে নিয়মিত কুরআন ও হাদীস অধ্যয়ন করতে হবে, বুঝতে হবে এবং তাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ এবং রাসূলে করীম (সা) কি নির্দেশ দান করেছেন তা অবহিত হতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন