শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অভ্যন্তরীণ

ধানে কৃষক সর্বস্বান্ত বাজারে গেলে দাম মিলছে না উঠছে না উৎপাদন খরচ

প্রকাশের সময় : ২৬ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শফিকুল ইসলাম বেবু, কুড়িগ্রাম থেকে

সরকারি ঘোষণার পর ১৮ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়নি। বেশির ভাগ জায়গায় কৃষকদের তালিকাই প্রস্তুত হয়নি। অথচ ধান কাটা প্রায় শেষ পর্যায়ে। ধান কাটা ও মাড়াইয়ের জন্য শ্রমিকের মজুরি, বাকিতে নেয়া সেচ-সারের দাম, সংসারের খরচ ও ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হবে কৃষককে। এর সবই হবে ধান বিক্রির পয়সায়। কিন্তু ঘোষণা দিলেও সরকারি পর্যায়ে সংগ্রহ অভিযান শুরু না হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। ধান নিয়ে বাজারে গেলে দাম মিলছে না। বাজারে বর্তমানে ধানের যা দাম, তাতে লাভ তো দূরের কথা, উৎপাদন খরচই উঠছে না। বিঘাপ্রতি লোকসান হচ্ছে দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। কিন্তু পাওনাদারের চাপের কারণে কম দামেই ধান বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের। কৃষকদের এই অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছে ফড়িয়া ও দালালরা। কম দামে কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে গোলা ভরছে তারা। কৃষকরা বলছেন, সরকারের লোকজন যখন সংগ্রহ অভিযান শুরু করবে, তখন কৃষকের কাছে আর বিক্রির জন্য ধানই থাকবে না। ফলে কৃষকের আর লাভের মুখ দেখা হবে না। উৎপাদনের সঙ্গে যোগ না থাকলেও লাভের পুরোটাই পকেটে ভরবে ফড়িয়া-দালালরা। সংগ্রহ অভিযান শুরু না হওয়া এবং ধানের কম দাম প্রসঙ্গে খাদ্য বিভাগ বলেছে, বাজারে এখনো গত বছরের চাল আছে। নতুন করে চাহিদাও বাড়েনি। ধানের দাম না বাড়ার পেছনে এটাও একটা কারণ। আর এখন যেসব ধান হাটে আসছে সেগুলো ভেজা। তাতে আর্দ্রতার পরিমাণ ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ। ভেজা ধানের দাম স্বাভাবিক কারণেই কম হচ্ছে। আর ভেজা ধান কিনে গুদামজাত করা হলে সরকারি গুদামে বর্তমানে যেসব খাদ্যপণ্য মজুদ রয়েছে তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ কারণে এখনো ধান সংগ্রহ শুরু করা হয়নি। আর এটা শুধু এবারই নয়, প্রতিবার একটু দেরিতে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ধান সংগ্রহ শুরু করা হয়। এ ছাড়া বোরো ধান-চাল সংগ্রহে দীর্ঘ সময় পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত, এবার বোরো মৌসুমে সরকার কৃষকের কাছ থেকে ২৩ টাকা কেজি দরে ধান এবং ৩২ টাকা কেজি দরে চাল সংগ্রহের ঘোষণা দিয়েছে। ৫ মে থেকে শুরু হয়ে সংগ্রহ অভিযান চলার কথা ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। গত ২৪ এপ্রিল খাদ্য মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্ত হয়। সরকারি হিসাবে এবার প্রতি কেজি বোরো ধান উৎপাদনে কৃষক পর্যায়ে খরচ হয়েছে ২০ টাকা ৭০ পয়সা। কুড়িগ্রাম খাদ্য বিভাগ সূত্র জানায়, এবার বোরো মৌসুমে ১৬ হাজার ১৩৫ মেট্রিক টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এরমধ্যে কুড়িগ্রাম সদরে ২ হাজার২০ মেট্রিক টন, উলিপুরে ৩ হাজার ২৭ মে,টন, চিলমারীতে ৯০৮ মে,টন, রৌমারীতৈ ১হাজার ৪৩৮ মে,টন, রাজিবপুরে ৩৬৪ মে,টন, ভূরুঙ্গামারীতে ২ হাজার ১৪৮ মে,টন, নাগেশ্বরীতে ৩ হাজার ২৪৭ মে,টন, ফুলবাড়ীতে ১ হাজার ২৮৭ মে,টন, রাজারহাটে ১হাজার ৬৯৬ মে,টন সংগ্রহ করা হবে। একজন কৃষক সর্বোচ্চ তিন মেট্রিক টন ধান সরবরাহ করতে পারবেন। এ বছরই প্রথম সরবরাহ করা ধানের মূল্য কৃষকদের নিজ নিজ ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে পরিশোধ করা হবে। কুড়িগ্রামের বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে এবং কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সংগ্রহ অভিযান শুরু না হওয়ায় ধানের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। দাম পড়ে যাওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে কৃষকদের। এ সুযোগ নিচ্ছে ফড়িয়া-দালালরা। কম দামে ধান কিনতে তারা গ্রাম চষে বেড়াচ্ছে। আর কোনো উপায় না পেয়ে অসহায় কৃষক বাধ্য হয়ে তাদের কাছে ধান বিক্রি করে দিচ্ছেন। ধানের দাম কেমন জানতে চাইলে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের কৃষক কায়সার আলী বললেন, ‘এখন ধান কাটিয়া ফাসি গেইছি বাহে। সব ট্যাকা এত দিন জমিত নাগাছি। পানিঅলা (শ্যালো মেশিন মালিক) ঘাড়ের ওপর বসি আছে। কিন্তু হাটত ধানের যে দাম কয়, পানির ট্যাকা কী দিমো, আর মুই কী নেইম? এখন তো দেকছং মরা ছাড়া উপাই নাই।’ কুড়িগ্রামের বিভিন্ন গ্রামের কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত মৌসুমের চেয়ে এবার প্রতি জাতের ধান তারা কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ এবার উৎপাদন খরচ গতবারের তুলনায় বিঘপ্রতি প্রায় ৩ হাজার টাকা বেশি হয়েছে। মোগলবাসা ইউনিয়নের নয়ারহাটা গ্রামের কৃষক হোসেন আলী জানান, এক বিঘা জমিতে ধান লাগানো থেকে শুরু করে কাটা, মাড়াই ও জমির মালিককে বর্গা বাবদ টাকা দেয়া পর্যন্ত তার প্রায় ১৩ হাজার ৬০ টাকা খরচ হয়েছে। প্রতি বিঘায় সর্বোচ্চ ২০ মণ হারে ফলন হয়েছে। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী প্রতি মণ ধান বিআর-২৮ বিক্রি করতে হচ্ছে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা দরে। অর্থাৎ প্রতি বিঘায় তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। এ অবস্থা এই উপজেলার প্রায় সব কৃষকেরই। সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের ঘনশ্যামপুর গ্রামের কৃষক দবির উদ্দিন, বাদশা মিয়া, নওশাদ ব্যাপারী, আব্দুল ওহাব, ওসমান আলী, হযরত আলীসহ একাধিক কৃষক জানান, যাত্রাপুরে বিআর-২৮, ২৯ হাইব্রীড-৫২ ধান বেশি চাষ হয়ছে। প্রতি বিঘায় ফলন হয়েছে ১৮ থেকে ২০ মণ। বর্তমানে বিআর-২৮, ২৯ প্রতি মণ ৫০০-৫৫০ টাকা, হাইব্রীড-৫২ প্রতিমণ ৪৫০-৪৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা উৎপাদন খরচের চেয়ে কম। রাজারহাট উপজেলার ফরকেরহাটে কাঁচা ধান নিয়ে হাটে এসেছে কৃষকরা। সেখানে হাইব্রীড ধান মণপ্রতি ৪০০-৪৫০টাকা, বিআর ২৮ বা ২৯ জাতের ধান ৫২৫ টাকা দরে বেচাকেনা হচ্ছে। উপজেলার বালাকান্দি গ্রামের কৃষক দুলাল মিয়া বলেন, ‘সার, ওষুধ ও শ্রমিক খরচ করে ধান লাগিয়ে হাটে এসে দাম পাচ্ছি না। ধান কাটা বাবদ কৃষি শ্রমিকের খরচ দেয়ার জন্য কয়েক মণ ধান এনে বিপদে পড়েছি। আর ধান শুকিয়ে সরাসরি খাদ্য বিভাগের কাছে বিক্রি করার সুযোগ নেই। সেখানে গেলে ফরিয়া দালালদের ধরতে হয়। কারণ এক বস্তা ধান কেনার আগে সেখানে ১৬ রকমের পরীক্ষা করা হয়। দালালকে কমিশন না দিলে শুকনা ধানও ভেজা হয়ে যায়। কমিশন দিলে সবই ঠিক থাকে। তার চেয়ে ভালো আমরা হাটেই বিক্রি করি।’ কুড়িগ্রাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আশ্রাফুজ্জামান জানান, জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে কৃষকদের তালিকা তৈরির পর আরো নানা আনুষ্ঠানিকতা শেষে সংগ্রহ অভিযান শুরুর প্রস্তুতি চলছে। কুড়িগ্রামে এ আনুষ্ঠানিকতা শেষের দিকে। শিগগিরই পুরোদমে সংগ্রহ অভিযান শুরু করা যাবে। কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনা হবে। তবে ১৪ শতাংশ আর্দ্রতা আছে, এমন ধান-চালই কেনা হবে। আর শর্ত মোতাবেক মোট ১৬ ধরনের পরীক্ষার পরই ধান-চাল কেনা হবে। তবে ধান কেনার বিষয়ে ফড়িয়া-দালালদের সঙ্গে খাদ্য বিভাগের কোনো সম্পর্ক নেই। সরকার নির্ধারিত দরকে স্বাগত জানালেও খুশি নয় কুড়িগ্রামের কৃষকরা। তারা বলছে, প্রান্তিক কৃষকদের কাছ থেকে আরো ১৫ দিন আগে ধান কেনা শুরু করলে ন্যায্য মূল্য পেত কৃষক। দেরিতে ক্রয় অভিযান শুরু করায় দলীয় নেতাকর্মী ও ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটই লাভবান হবে। কৃষক রহিম উদ্দিন জানান, চাষিরা যখন ধান বিক্রি করে দেয় তখন সরকার ধান-চাল কেনার ঘোষণা দেয়। প্রতিবছরই একই সময় সরকার এ কার্যক্রম ঘোষণা করে। এতে কৃষকদের বেশি লোকসান গুনতে হয়। আর লাভবান হয় চাতাল ব্যবসায়ীরা। জেলা চালকল মালিক সমিতির সভাপতি ও জেলা ধান ক্রয় কমিটির সদস্য মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম টুকু বলেন, প্রকৃত ও কার্ডধারী কৃষকরা ধৈর্যসহকারে নিয়ম মানলে তারা বেশ লাভবান হবে। কুড়িগ্রাম জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মকবুল হোসেন জানান, ১৯৯৯ সাল থেকে কুড়িগ্রাম খাদ্যে উদ্বৃত্ত জেলা। এবারও কুড়িগ্রাম জেলা খাদ্যে উদ্বৃত্ত হবে। ১লাখ ৯ হাজার হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৪লাখ ৭৯ হাজার ৬০০মে,টন চাল উৎপন্ন হবে। প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহের ব্যাপারে তিনি জানান উপজেলা পর্যায়ে প্রকৃত কৃষকের তালিকার কাজ শেষ পর্যায়ে। স্বল্প সময়ের মধ্যে কৃষকের তালিকা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেয়া হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
জুলকার নাঈম ২৬ মে, ২০১৬, ১০:২৫ এএম says : 0
এটা সরকারকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখান।কৃষি প্রধান অর্থনীতির দেশে এসব কি হচ্ছে।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন