মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

তৃণমূলের বিশাল বিজয় : মুসলমানদের ভাগ্যে পরিবর্তন আসবে কি ?

প্রকাশের সময় : ২৮ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুনশী আবদুল মাননান : পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের মধ্যে দিয়ে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। এর আগে ২০১১ সালের নির্বাচনে তৃণমূল প্রথমবারের মতো ক্ষমতাসীন হয়। সাধারণত দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রিয়তা নানা কারণে হ্রাস পায়। তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। তৃণমূলের জনপ্রিয়তা বিগত পাঁচ বছরে হ্রাস তো পায়ইনি, উল্টো বেড়েছে। ২০১১ সালের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের আসন সংখ্যা ছিল ১৮৪টি। এবার ২৭টি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১১টি। পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভায় মোট আসন সংখ্যা ২৯৪। দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল দুই-তৃতীয়াংশ আসনের চেয়েও ১৫টি আসন বেশি পেয়েছে। দুই-তৃতীয়াংশ আসনের জন্য প্রয়োজন ১৯৬টি আসন। একতরফা বা নিরঙ্কুশ বিজয় বলতে যা বুঝায়, তৃণমূল এবার সেরকম বিশাল বিজয়ই অর্জন করেছে।
নির্বাচন-পূর্ব বিভিন্ন জরিপ এমনকি বুথফেরত জরিপে এটা ঘুণাক্ষরেও বোঝা যায়নি যে, তৃণমূল এত বড় বিজয় পাবে। কোনো কোনো তরফে এমন ধারণা প্রকাশ করা হয়েছিল, তৃণমূল এবার জোর একটা ধাক্কা খেতে পারে। তার বদলে ক্ষমতায় এসে যেতে পারে বামফ্রন্ট-কংগ্রেস জোট। কোনো কোনো তরফে আবার এরূপ ধারণা দেয়া হয়েছিল, বামফ্রন্ট-কংগ্রেস জোট ও তৃণমূলের বিজয়ের সম্ভাবনা ফিফটি-ফিফটি। দুয়ের মধ্যে যে কেউ স্বল্প ব্যবধানে বিজয়লাভ করতে পারে। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিতের পর দেখা যাচ্ছে, কোনো পূর্ব ধারণা ও ভবিষ্যৎ-বাণীই কাজে আসেনি। মমতা ব্যানার্জি অবশ্য শুরু থেকেই বলে আসছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের জনগণ উন্নয়নের পক্ষেই রায় ঘোষণা করবে। তৃণমূল গত পাঁচ বছরে যে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাÐ চালিয়েছে, তাতে তার বিজয় অপধারিত। জনগণ আরও বেশি ভোট ও আসনে তাকে বিজয়ী করবে। বাস্তবে মমতার কথাই সত্য হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের জনগণ তাদের শাসনের জন্য, রাজ্যের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য তৃণমূলকেই বেছে নিয়েছে।
তৃণমূলের বিজয় ও ক্ষমতায় ফিরে আসা সহজ ছিল না। প্রতিপক্ষ কোনো বিবেচনাতেই দুর্বল বা হেলাফেলা করার মতো ছিল না। পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় ছিল এমন দুটি দলের জোট এবং কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে লড়াই করেই তাকে বিজয় ছিনিয়ে আনতে হয়েছে। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত একটানা ২০ বছর এবং ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর মোট ২৫ বছর রাজ্য শাসন করে কংগ্রেস। ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। ক্ষমতায় আসে সিপিএমের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট। বামফ্রন্ট ২০১১ সাল পর্যন্ত মোট ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকে। পশ্চিমবঙ্গে এই দুই দলেরই জনভিত্তি আছে। তারা যখন দুয়ে মিলে জোট করে তখন কারো মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, বামফ্রন্ট-কংগ্রেস জোট জিতেও যেতে পারে। অন্যদিকে কেন্দ্র ক্ষমতাসীন বিজেপি কম লড়াকু অবস্থানে ছিল না। দলটি পশ্চিমবঙ্গে বড় বড় জনসভা করে। দুই প্রতিপক্ষই তৃণমূলের বিরুদ্ধে ছিল সোচ্চার। তৃণমূলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, ক্ষমতার অপব্যবহার ও ব্যর্থতার বড় বড় ফিরিস্তি তারা দিয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুই ফল দেয়নি। নির্বাচনের চ‚ড়ান্ত ফলাফলে দেখা গেছে, তৃণমূল যেখানে পেয়েছে ২১১টি আসন সেখানে বামফ্রন্ট পেয়েছে ৩২টি আসন। গত নির্বাচনে পেয়েছিল ৪০টি আসন। কংগ্রেস পেয়েছে ৪২টি আসন। গত নির্বাচনে পেয়েছিল ৪০টি আসন। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি গত নির্বাচনে ১টি আসন না পেলেও এবার পেয়েছে ৩টি আসন। বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গে দলটি খাতা খুলতে পেরেছে। অনেকেরই এমন আশঙ্কা ছিল বৈকি, তৃণমূলবিরোধী ব্যাপক প্রচারণার ফলে শহুরে ভোটাররা তৃণমূল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। এ আশঙ্কাও ফলবতী হয়নি। মহানগর কলকাতার সব আসনই পেয়েছে তৃণমূল। প্রশ্ন উঠতে পারে, শক্ত প্রতিপক্ষ এবং তাদের তৃণমূলবিরোধী তুমুল প্রচার-প্রচারণার পরও দলটি এমন অবিস্মরণীয় বিজয় কীভাবে অর্জন করল, অনেকের ধারণা, মমতা ব্যানার্জির ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব, তার নিষ্ঠা, সততা এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়ার বিরল ক্ষমতা এ বিজয়ে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। পর্যবেক্ষকরা এটা লক্ষ্য করে থাকবেন, মমতা আগাপাছতলা একজন রাজনীতিক। রাজনীতিই তার ধ্যান-জ্ঞান। রাজনীতির প্রতি তার একনিষ্ঠ পক্ষপাতিত্ব ও নির্ভরতার কারণ সম্ভবত এই যে, রাজনীতিই জনসেবা ও জনকল্যাণের সবচেয়ে বড় অবলম্বন বলে তিনি বিশ্বাস করেন। এই বিশ্বাস থেকেই রাজ্যের উন্নয়নে ও জনকল্যাণে তিনি বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি শিল্পায়ন ও যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়ন নানা ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করেন। এতে উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যাতায়াত ক্ষেত্রে মসৃণতা বৃদ্ধি পায়। কর্মসংস্থানও বাড়ে। বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটে এবং বিদ্যুৎ-উদ্বৃত্ত রাজ্য হিসেবে পরিগণিত হয় পশ্চিমবঙ্গ। শহরই নয়, গ্রামে-গঞ্জেও স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় অগ্রাধিকার প্রদান করেন। আরো একটি বিশেষ প্রকল্প তিনি গ্রহণ করেন, যা উচ্চ প্রশংসায় অর্জন করে। তিনি গরীব ও প্রান্তিক মানুষের জন্য ন্যূনতম মূল্যে চাল সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। যারা হত দরিদ্র এবং যাদের আয়-রোজগার কম তারা দুই টাকা রুপি করে প্রতিকেজি চাল পেয়ে উপকৃত হয়। তিনি গণবণ্টন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটান যার সুফল জনগণ ভালোভাবেই লাভ করে। এছাড়াও তার সিভিল ভলান্টিয়ার নিয়োগে অনেক বেকার তরুণ-তরুণী কাজের সুযোগ পায়। কন্যাশ্রী প্রকল্পে মেয়েরা আর্থিক সুবিধা লাভ করে। সবুজসাথী প্রকল্পের আওতায় বিনামূল্যে সাইকেল পায় অনেকে। এছাড়া প্রাথমিক স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য জুতা ও গরীব ছেলেমেয়েদের জন্য বিনামূল্যে বইখাতা প্রদান করা হয়। মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জীনদের জন্য ভাতাসহ বাউল-কীর্ত্তনীয়াদের জন্য আর্থিক সহায়তা দান করা হয়। বিগত পাঁচ বছরে মমতা সরকারের উন্নয়ন ও সেবামূলক এসব কর্মকাÐে তার ও তার দলের জনপ্রিয়তা স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পায়। বিরোধীপক্ষের অভিযোগ, অনুযোগ ও প্রচারণা খুব কার্যকর না হওয়ার কারণ মূলত এখানেই নিহিত। পশ্চিমবঙ্গের জনগণ কংগ্রেসের শাসন দেখেছে, বামফ্রন্টের শাসন দেখেছে, তৃণমূলের শাসনও পাঁচ বছর দেখেছে। তারা এই তিন দলের শাসনের তুলনামূলক পর্যালোচনা করেই তৃণমূলকে শ্রেয় হিসেবে গণ্য করেছে। বস্তুত ভোটচিত্রে তারই প্রতিফলন ঘটেছে ।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেভাবে মূল্যায়ন-পর্যালোচনায় আসেনি। সেটা হলো, পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু মুসলিম ভোটাররা প্রধানত তৃণমূলকেই সমর্থন করেছে ও ভোট দিয়েছে। মুসলিম ভোট তৃণমূলের বিজয়কে শুধু ত্বরান্বিতই করেনি, নিশ্চিতও করেছে। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার অন্তত ৩০ শতাংশ মুসলমান। মোট ভোটার সংখ্যার নিরিখে হিসাব করলে মুসলিম ভোটার সংখ্যাও সামান্য কমবেশী ৩০ শতাংশই হওয়ার কথা। এর বৃহদাংশই তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে। মুসলিম ভোটাররা কংগ্রেস, বামফ্রন্ট এমন কি বিজেপিকেও ভোট দিয়েছে। তবে এই দলগুলো ভোট পেয়েছে অনেক কম। এ প্রসঙ্গে জেনে রাখা দরকার, স্বাধীনতার পর থেকে মুসলমান সংখ্যালঘু ভোটাররা যে দলকে অধিক সংখ্যায় সমর্থন করছে, ভোট দিয়েছে, সেই দলই ক্ষমতায় এসেছে। কংগ্রেস যতদিন ক্ষমতায় ছিল ততদিন মুসলিম ভোটারদের বেশীরভাগই কংগ্রেসকে সমর্থন করেছে। কিন্তু যখন এ সমর্থন তারা প্রত্যাহার করেছে, তখনই কংগ্রেস ক্ষমতা থেকে বিদায় হয়ে গেছে। ক্ষমতায় এসেছে বামফ্রন্ট। বাম ফ্রন্টের বিজয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল মুসলিম ভোটারদের। নির্বাচনের পর নির্বাচনে বামফ্রন্ট বিজয়ী করছে। প্রতি নির্বাচনেই তাকে ভোট দিয়েছে মুসলমানরা। অতঃপর ২০১১ সালে মুসলিম ভোটাররা বামফ্রন্টের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তৃণমূলমুখী হলে বামফ্রন্ট ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। ক্ষমতার অঙ্গনে প্রবেশ করেছে তৃণমূল। এবারও তৃণমূলকে ক্ষমতায় ধরে রাখার জন্য মুসলিম ভোটাররাই প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।
এটা পশ্চিমবঙ্গের একটি অনিবার্য ও ঐতিহাসিক বাস্তবতা। এই বাস্তবতা অস্বীকার বা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম জনসংখ্যা কখনোই এমন ছিল না যে, ভোটের রাজনীতিতে তাদের উপেক্ষা করা যায়। বরং বরাবরই দেখা গেছে, তারা নির্বাচনের জয়-পরাজয়ের নির্ণায়ক হিসেবে পরিগণিত হয়েছে বা ভূমিকা পালন করেছে। অনেক গণতান্ত্রিক দেশেই সংখ্যালঘুরা সুনির্দিষ্ট একটি ভোটব্যাংক হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। এই ভোট ব্যাংক যে দলের পক্ষে যায়, সে দলই বিজয় অর্জন করে। এটা সবচেয়ে বেশী লক্ষ্য করা যায় সেই সব দেশে, যেসব দেশে সংখ্যালঘু ভোটার বেশী, নিদেন পক্ষে ১০ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে বরাবরই সংখ্যালঘু মুসলিম ভোটার সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশী। সুতরাং কেবল অতীতে নয়, ভবিষ্যতেও ক্ষমতার নির্ধারক হিসেবে মুসলিম ভোটারদের ভূমিকা এই রাজ্যে অব্যাহত থাকবে, এটা স্বভাবতই ধরে নেয়া যায়।
এখন এই প্রশ্ন যুক্তিসঙ্গতভাবেই সামনে আসতে পারে , যারা বিগত প্রায় ৭০ বছর ধরে নির্বাচনে নির্ধারক ভূমিকা পালন করে আসছে, পশ্চিমবঙ্গের সেই মুসলিম সংখ্যালঘুরা এত পশ্চাদপদ, অবেহলিত, উপেক্ষিত ও বঞ্চিত কেন? এই প্রশ্নের একটি মাত্র উত্তরই হতে পারে এবং তা হলো, যে সব দল মুসলিম সমর্থন ও ভোটে ক্ষমতায় এসেছে তারা কেউই মুসলমানদের উন্নয়ন-অগ্রগতির কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তাদের মানবিক নাগরিক ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা করেনি। প্রয়োজনে তাদের ব্যবহার করেছে এবং অত্যন্ত সচেতনভাবে দূরে সরিয়ে রেখেছে। তাদের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করেনি, সুবিচার করেনি। কার্যত, করেছে প্রতারণা।
মুসলমানরা তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটানোর জন্য, নাগরিক হিসাবে সমঅধিকার ও সমআচরণ লাভের জন্য কংগ্রেসের পর বামফ্রন্ট এবং বামফ্রন্টের পর তৃণমূলে আস্থা স্থাপন করেছে। তৃণমূল কি তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে? গত পাঁচ বছরে তৃণমূল যে মুসলমানদের জন্য খুব বেশি কিছু করেছে তা বলা যাবে না। প্রকৃতপক্ষে পূর্ব ধারাই অব্যাহত আছে। ব্যতিক্রম এটুকু যে, মমতা সরকার মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জন্য সামান্য কিছু ভাতার ব্যবস্থা করেছে এবং মাদ্রাসা উন্নয়নে কিছুটা কাজ করেছে। মমতা নিজে মুসলমানদের সঙ্গে মেশার চেষ্টা করেছেন এর বাইরে জনহিতকর বিশেষ করে গরীব ও প্রান্তিক লোকদের জন্য যে সব কর্মসূচি নেয়া হয়েছে তাতে মুসলমানদের মধ্যে কিছু লোক সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছে। পশ্চাদপদ মুসলিম সংখ্যালঘুদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য বিশেষ বা আলাদা কোনো কর্মসূচি লক্ষ্য করা যায়নি। এ জন্য মুসলমানদের মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও তারা তৃণমূলকে আরো সুযোগ দিতে চেয়েছে।
সবাই জানা, ‘অসাম্প্রদায়িক’ দল হিসেবে পরিচিত কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে ২৫ বছর ক্ষমতায় থাকলেও মুসলমানদের কোনো উন্নতি হয়নি। বরং ১৯৪৭ সালে তাদের যে অবস্থা ছিল, কংগ্রেস শাসনামলে সে অবস্থার ব্যাপক অবনতি হয়। জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ হলেও সরকারী চাকরিতে তাদের সংখ্যা ছিল ২ শতাংশের কম। অন্যান্য নজির এখানে আমরা ইচ্ছা করেই উল্লেখ করছি না। ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে মুসলমানরা আশা করেছিল, বামফ্রন্টকে সমর্থন করলে হয়তো তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। তাদের দুর্ভাগ্য সেটা হয়নি। ৩৪ বছর বামফ্রন্ট রাজ্য শাসন করলেও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবস্থান ওই দুই শতাংশের নীচেই থেকে যায়। ২০১১ সালে দৃশ্যমান এই চিত্রের কোনো পরিবর্তন তৃণমূলের পাঁচ বছরেও দেখা যায়নি। এখনও মুসলমানরা চাকরির ক্ষেত্রে দুই শতাংশের সীমা অতিক্রম করতে পারেনি।
বেশ কয়েক বছর আগে বিচারপতি রাজিন্দর সাচারের নেতৃত্বে অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও পরিসংখ্যানবিদদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির উদ্দেশ্য ছিল, ভারতীয় মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষাগত অবস্থান নিরূপণ করা। ওই কমিটি ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার পর যে রিপোর্ট পেশ করে তা কেবল ভারত জুড়ে নয়, বিশ্বজুড়েই আলোড়ন সৃষ্টি করে। রিপোর্টে দেখা যায়, নি¤œবর্ণের তফসিলি জাতি, উপজাতি এমনকি দলিতদের চেয়েও মুসলিমদের অবস্থা শোচনীয়। দেখা যায়, চাকরি ক্ষেত্রে সব রাজ্যেই মুসলমানদের অবস্থান অত্যন্ত নগণ্য। চাকরিতে হিস্যা সবচেয়ে কম পশ্চিম বঙ্গে। কিছুদিন আগে কলকাতায় এক অনুকষ্ঠানে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন জানান, রাজ্যের দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষের সিংহভাগই মুসলমান। জীবনযাপনের নিরিখে তারা অসামঞ্জস্যভাবে দরিদ্র ও বঞ্চিত। সম্প্রতি কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে এসেছিলেন বিচারপতি রাজিন্দর সাচার। সেখানে তিনি দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করেন. সাচার কমিটির রিপোর্টে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের যে চিত্র উঠে আসে তা এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে। কোনো সরকারই মুসলমানদের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে কোন পদক্ষেপ নেয়নি।
এই যখন পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের প্রকৃত অবস্থা, তখন তৃণমূলের আগামী পাঁচ বছরের শাসনামলে তাদের এই অবস্থার আদৌ কি কোনো পরিবর্তন হবে? তাদের মানবিক, নাগরিক ও সাংবিধানিক অধিকার এবং সুযোগ-সুবিধা কি প্রতিষ্ঠিত হবে? হবে কিনা আমরা জানি না। তবে এটা বলতে পারি, জনগণের ৩০ শতাশংকে উপেক্ষা-অবহেলা করে, বঞ্চনার মধ্যে রেখে পশ্চিমবঙ্গের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি কখনোই আসবে না। তার বৃহত্তর স্বার্থেই সংখ্যালঘু মুসলমানদের উন্নয়ন ও প্রতিষ্ঠার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন