(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
১৫. রমাদান ইবাদাতের সওয়াব বহুগুণ বাড়ানোর মাস
অন্যান্য মাসের তুলনায় রমাদান মাসের ইবাদাতের সওয়াব অনেক বেশি। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি এ মাসে নফল ইবাদাত করলো, সে যেন অন্য মাসের ফরয ইবাদাত পালন করলো। আর যে এ মাসে একটি ফরয পালন করলো, সে যেন অন্য মাসের ৭০টি ফরয ইবাদাত করলো’। অর্থাৎ- অন্য মাসে একটি ফরয ইবাদাতে যে সওয়াব, এ মাসে তা নফল দ্বারাই পাওয়া যায়। আর অন্য মাসের ৭০টি ফরযের সওয়াব এ মাসের একটি ফরয দ্বারা অর্জন করা যায়।’ [বায়হাকি শুয়াবুল ঈমান]
১৬. রমাদান জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা রমাদান মাসের প্রত্যেক দিবস ও রজনীতে অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। আর প্রত্যেক মুমিন বান্দার একটি করে দু‘আ অবশ্যই কবুল করেন।’ [মুসনাদে আহমদ, হাদীস-৭৪৫০, মুসনাদে বাযযার, হাদীস ৯৬২]
১৭. রমাদান জান্নাতগুলোর দরজা খোলা ও জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধের মাস
আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “রমাদান মাসের শুভাগমন উপলক্ষে জান্নাতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়।” [সহীহ বুখারী, হাদীস -১৮৯৮ (১/২৫৫), সহীহ মুসলিম, হাদীস, ১০৭৯ (১/৩৪৬) ]
১৮. রমাদান লাইলাতুল কদরের মাস
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ হতে মুসলিম উম্মাহর জন্য রমাদান মাসে আরেকটি বিশেষ দান হলো, এক হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম রজনী লাইলাতুল কদর। এই রজনী এত মর্যাদাপূর্ণ যে, এক হাজার মাস ইবাদাত করলেও যে সওয়াব হতে পারে, লাইলাতুল কদরের ইবাদাতে তার চেয়ে বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। তাই এই রাতের কল্যাণ হতে বঞ্চিত হওয়া চরম দূর্ভাগ্যের বিষয়। আল্লাহ তা’আলা এ রাত সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন, ‘‘কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।’’ [সূরা কদর : ৪]
১৯. রমাদান ইতিকাফ করার মাস
ই‘তিকাফ অর্থ অবস্থান করা। অর্থাৎ মানুষদের থেকে পৃথক হয়ে সালাত, সিয়াম, কুরআন তিলাওয়াত, দু‘আ, ইসতিগফার ও অন্যান্য ইবাদাতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার সান্নিধ্যে একাকী কিছু সময় যাপন করা। এ ইবাদাতের এত মর্যাদা যে, প্রত্যেক রমাদানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমাদানের শেষ দশ দিন নিজে এবং তাঁর সাহাবীগণ ই‘তিকাফ করতেন। আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, ‘‘প্রত্যেক রমাদানেই তিনি শেষ দশ দিন ই‘তিকাফ করতেন। কিন্তু জীবনের শেষ রমাদানে তিনি ইতিকাফ করেছিলেন বিশ দিন।’’ [সহীহ আলবুখারী : ২০৪৪]
২০. রমাদান মাসে উমরা আদায় করা হাজ্জ করার সমতুল্য
রমাদান মাসে একটি উমরা করলে একটি হাজ্জ আদায়ের সমান সাওয়াব হয়। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘রমাদান মাসে উমরা করা আমার সাথে হাজ্জ আদায় করার সমতুল্য।’ [সহীহ আলবুখারী : ১৮৬৩]
২১. রমাদানে সিয়াম পালন বছরের দশমাস সিয়াম পালন তুল্য
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি রমাদান মাসে সিয়াম পালন করল- রমাদানের এক মাস সিয়াম পালন দশ মাস সিয়াম পালনের সমতুল্য। আর ঈদুল ফিতরের পর (শাওয়াল মাসের) ছয় দিন সিয়াম পালন যেন গোটা বছরের সিয়াম পালন হয়ে গেল।” [আহমাদ : ২১৯০৬]
২২. রমাদান ফিতরা আদায়ের মাস
এ মাসে সিয়ামের ত্রুটি-বিচ্যুতি পূরণার্থে ফিতরাহ দেয়া আবশ্যক। ইবনে উমর রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, ‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের সালাত আদায়ের পুর্বে ফিতরাহ আদায় করার আদেশ দিলেন।’’ [সহীহ আল-বুখারী : ১৫০৩]
২৩. রমাদান দান-খয়রাতের মাস
এ মাসে বেশি বেশি দান-সাদাকাহ করার জন্য চেষ্টা করতে হবে। ইয়াতীম, বিধবা ও গরীব মিসকীনদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া ও বেশি বেশি দান খয়রাত করা। হিসাব করে এ মাসে যাকাত দেয়া উত্তম। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ মাসে বেশি বেশি দান খয়রাত করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিঅল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল আর রমাদানে তাঁর এ দানশীলতা আরো বেড়ে যেত।’’ [সহীহ আল-বুখারী : ১৯০২]
২৪. রমাদান তাকওয়া অর্জনের মাস
তাকওয়া এমন একটি গুণ, যা বান্দাহকে আল্লাহর ভয়ে যাবতীয় পাপকাজ থেকে বিরত রাখে এবং তাঁর আদেশ মানতে বাধ্য করে। আর রমাদান মাস তাকওয়া নামক গুণটি অর্জন করার এক বিশেষ মৌসুম। কুরআনে এসেছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে করে তোমরা এর মাধ্যমে তাকওয়া অবলম্বন করতে পারো।’’ [সূরা আলবাকারাহ : ১৮৩]
২৫. রমাদান দু‘আ কবুলের মাস
রমাদান মাসে দু‘আ কবুল করা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘রমাদান মাসে প্রত্যেক মুসলমান আল্লাহর সমীপে যে দু‘আ করে থাকে, তা কবুল করা হয়।’ [মুসনাদ আহমাদ : ২/২৫৪]
২৬. রমাদান রাইয়ান নামক জান্নাত লাভের মাস
রমাদানের সিয়ামপালনকারীর আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো, জান্নাতের রাইয়ান নামক দরজাটি তাদের জন্য নির্দিষ্ট। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, বেহেশতে রাইয়ান নামক একটি দরজা আছে। কিয়ামতের দিন এটি দিয়ে সিয়ামপালনকারীরা প্রবেশ করবে। সিয়ামপালনকারী ছাড়া আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (কিয়ামতের দিন সিয়ামপালনকারীকে ডেকে) বলা হবে, সিয়ামপালনকারীরা কোথায়? তখন তারা উঠে দাঁড়াবে। তারা ছাড়া আর একজন লোকও সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। তাদের প্রবেশের পরই তা বন্ধ করে দেয়া হবে, যাতে ওই দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে না পারে।’ [রোখারি : ১৭৬১]
২৭. রমাদান ধৈর্য ও সবরের মাস
রমাদানে ঈমানদার ব্যক্তিরা খাওয়া দাওয়া, বিয়ে-শাদি ও অন্য সব আচার-আচরণে ধৈর্য ও সবরের এত বেশি অনুশীলন করেন, তা অন্য কোনো মাসে বা অন্য কোনো পর্বে করেন না। এমনিভাবে সিয়াম পালন করে যে ধৈর্যের প্রমাণ দেওয়া হয়, তা অন্য কোনো ইবাদতে পাওয়া যায় না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, ‘‘ধৈর্যশীলদের তো বিনা হিসাবে পুরস্কার দেওয়া হবে।’’ [সূরা জুমার : ১০]
২৮. রমাদান বদর যুদ্ধের মাস
আল্লাহর মুমিন বান্দাদের কাছে রমাদান বিজয়ের মাস। দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ রমাদান মুসলমানরা মদিনার দক্ষিণে বদরের প্রান্তরে প্রথম যুদ্ধে বিজয় লাভ করে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার সাহাবিরা মক্কার কাফিরদের দীর্ঘ ১৩ বছরের অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ পেতে মদিনায় হিজরত করার পর প্রায় নয়টি রমাদান পেয়েছিলেন। মদিনায় হিজরত করার দুই বছরের মাথায় কাফিরদের সঙ্গে রমাদান মাসে যে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়, তা হচ্ছে বদর যুদ্ধ। এ যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৬২৪ সালে। এ যুদ্ধে মাত্র ৩১৩ জন মুসলিম মুজাহিদ মক্কার এক হাজার কাফির সেনার মোকাবেলায় মহান আল্লাহর সরাসরি মদদে বিজয় লাভ করে। বদরযুদ্ধে আবু জাহেল, উতবা, শায়বাসহ মোট ৭০ জন কাফির নিহত হয়। আরো ৭০ জন কাফির মুজাহিদদের হাতে বন্দি হয়। অন্যদিকে ১৪ জন মুসলিম মুজাহিদ বীরবিক্রমে লড়াই করে শাহাদাতের গৌরব অর্জন করেন। বন্দিদের সঙ্গে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ক্ষমাসুলভ আচরণ দেখে মুগ্ধ হয়ে পরবর্তী সময় অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন