মোস্তফা মাজেদ, ঝিনাইদহ থেকে
নিজের সংসারই ঠিকমতো চলে না। তার ওপর ৫টি এতিম মেয়েকে পড়ালেখার খরচ চালাতে হয় দিনমজুর জহির রায়হানকে। মেয়েগুলো পড়াতে নিজে ঘাম ঝরানো পরিশ্রম করলেও তার মনে বিন্দুমাত্র কষ্ট নেই। নিজ ঘরে আশ্রয় দেওয়া এতিম মেয়েদের জন্য তাকে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে যখন মেয়েদের মুখে আব্বু ডাক শোনেন, তখন সারা দিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। বাবা না হয়েও এতিম মেয়েদের এমনই এক ব্যতিক্রম বাবা জহির রায়হান। রং মিস্ত্রি জহির রায়হান ঝিনাইদহ সদর উপজেলার রামনগর গ্রামের কিয়ামুদ্দীন মোল্লার ছেলে। ছোটবেলা থেকেই জহির রায়হান সৃষ্টিশীলতায় বিশ্বাসী। এ কারণে তিনি পরিবেশবান্ধব কাজ করে এলাকায় নজির সৃষ্টি করেছেন। প্রথম দিকে তিনি এলাকাজুড়ে গাছ লাগিয়ে চমক সৃষ্টি করেন। যেখানে জমি, সেখানেই জহিরের গাছ। এমন করে তিনি সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বৃক্ষরোপণ করেন। এরপর দেয়াল লিখনীর মাধ্যমে তিনি সচেতনতা সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করেন। পাখির জন্য গাছে গাছে ভাড় পেতে বাসা তৈরি করা, হাজা মজা পুকুরে মাছ ছেড়ে দরিদ্রদের মাছ খাওয়ার ব্যবস্থা করা জহিরের অন্যতম কল্যাণমূলক কাজ। এখন তার বাইসাইকেলে বই রাখা হয়, যাতে গ্রামের হতদরদ্রি ছেলেমেয়েরা পড়তে পারে। জহিরের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এসব কাজের পাশাপাশি জহিরের অন্যতম মহানুভবতা হচ্ছে এতিম মেয়েদের নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেওয়া এবং তাদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করা। জহির জানান, তার বাড়িতে এখন হালিমা খাতুন, সুমি, জেসমিন ও সিমলা নামে ৫টি মেয়ে রয়েছে। জহির জানান, জেসমিনকে বিয়ে দেয়া হচ্ছিল অষ্টম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায়। খবর পেয়ে তিনি তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। জেসমিন এখন ঝিনাইদহ কেসি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে হিসাব বিজ্ঞানে অনার্স পড়ছেন। নগরবাথান গ্রামে সুমি নামে এক মেয়ের বাবা ইন্তেকাল করলে তার মা অন্যত্র বিয়ে করে চলে যায়। এতিম হয়ে পড়ে সুমি। জহির রায়হান তাকে নিজ বাড়িতে এনে পড়ালেখা করান। সুমি এখন ঝিনাইদহ কেসি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ছে। সে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছিল। হরিণাকুন্ডু উপজেলার যাদবপুর গ্রামের হালিমা খাতুনের বাবা মাদকাসক্ত ছিল। পড়ালেখার পরিবেশ ছিল না। জহিরের মহানুভবতার খবর পেয়ে গ্রামের মানুষ হালিমাকে জহিরের বাড়িতে রেখে যায়। হালিমা নগরবাথান হাইস্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়ছে। হরিণাকুন্ডু উপজেলার হামিরহাটি গ্রামের সিমলাকে নবম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় তারা বাবা-মা বিয়ে দিচ্ছিল। খবর পেয়ে জহির রায়হান তাকে তুলে এনে পড়ালেখা করায়। সিমলা নগরবাথান এমএ খালেক কলেজে পড়ছে। সদর উপজেলার রামনগর গ্রামের শাপলা খাতুনের মা মারা যাওয়ার পর বাবা বিয়ে করে। এ অবস্থায় শাপলা ও তার নানি জহির রায়হানের বাড়িতে চলে আসে। জহির জানান, মেয়েগুলো তাকে বাবা বলে ডাকে। তার নিজের দুই সন্তান। ছেলে সোহাগ অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। মেয়েটি ছোট। মোট তার সন্তানের সংখ্যা ৭। ১০ সদস্যের পরিবার চালাতে কষ্ট হলেও জহিরের মনে কোন দুঃখ নেই। জহির জানান, তাকে নিয়ে পত্রপত্রিকা ও ফেসবুকে লেখালেখি হয়েছে। দেশ-বিদেশের অনেক মানুষ তাকে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। তাকে সবসময় সাহস যুগিয়ে যাচ্ছেন। রামনগর গ্রামের জিল্লুর রহমান জানান, জহিরের কারণে তাদের গ্রামের সুখ্যাতি বেড়েছে। তার কাজগুলো মানুষ শ্রদ্ধা করে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে তাকে সহায়তা করা উচিৎ। তিনি জানান, মানুষ জহিরের জনকল্যাণমূলক কাজ দেখতে রামনগর গ্রামে আসছেন। স্থানীয় কুমড়াবাড়িয়া ইউনয়নের চেয়ারম্যান হায়দার আলী জানান, জহির আমার ইউনিয়নের গর্ব। তার কাজকর্মে এলাকার মানুষ এবং প্রশাসন খুশি। তবে তাকে আমরা খুব বেশি সহায়তা করতে পারি না। সরকারিভাবে তাকে প্রতিষ্ঠা করা দরকার বলে ইউপি চেয়ারম্যান মনে করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন