তানোর (রাজশাহী) উপজেলা সংবাদদাতা
রাজশাহীর তানোরে আনন্দ স্কুলের ট্রেনিং সমন্বয়কারি টিসি আকতারুজ্জামানের অনিয়ম ও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না বরং প্রতিনিয়ত তা বাড়ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ছোট-খাটো চুরি হলে বলা হয় সিদেল চুরি? তার থেকে বড় হলে বলা হয় পুকুর চুরি? তারও বড় হলে বলা হয় সাগর চুরি? কিন্তু যে চুরির কোনো সীমা পরিসীমা বা মাপজোক নেই তাকে কি বলা হবে? ঠিক এমনি চুরির ঘটনা ঘটে চলেছে আনন্দ স্কুল প্রকল্পে। জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে রস্ক প্রথম ও দ্বিতীয় প্রকল্পের মাধ্যমে ঝরেপড়া শিশুদের স্কুলগামি করে শিক্ষা প্রদানের জন্য মোট ১১৭টি আনন্দ স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয় তার মধ্যে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে ৮টি স্কুল বন্ধ করে দেয়া হলে স্কুলের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১০৯টি। এদিকে প্রকল্পের শুরু থেকেই টিসি আকতারুজ্জামানের বেপরোয়া অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে প্রকল্পের কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে। অপরদিকে টিসির এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হলেও রহস্যজনক কারণে তা আমলে নিচ্ছেন না কর্তৃপক্ষ। ফলে টিসি দিন দিন চরম বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এদিকে টিসির এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর প্রকাশ করায় তিনি চার সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আদালতে চাঁদাবাজির মিথ্যা মামলা করেছেন। আর এই মিথ্যা মামলার খবর ছড়িয়ে পড়লে তানোরে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে শুধুমাত্র ঝড়েপড়া শিশুদের শিক্ষা প্রদানের জন্য আনন্দ স্কুলগুলো পরিচালিত হচ্ছে। তানোরে বর্তমানে ১০৯টি স্কুল চলমান রয়েছে। আনন্দ স্কুলগুলোতে ঝড়েপড়া ৮ থেকে ১৪ বছরের শিশুরা ভর্তি হতে পারবেন। প্রতিটি স্কুলে কমপক্ষে ২৫ জন থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ জন ঝড়েপড়া শিক্ষার্থী থাকা বাধ্যতামূলক। অথচ প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের দেয়া তথ্য মতে তানোর উপজেলায় ঝড়েপড়া মাত্র ৫২ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে তাহলে ১০৯টি স্কুলে ঝড়েপড়া এতো শিক্ষার্থী এলো কোথা থেকে। প্রতিটি স্কুলে গড় ২৫ জন করে শিক্ষার্থী ধরা হলে ১০৯টি স্কুলে ২৭২৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষার্থীদের পোশাক, উপবৃত্তি ও শিক্ষা উপকরণ বাবদ মাথাপিছু বছরে গড়ে প্রায় ১৬৫০ টাকা হলে ২৭২৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য মোট প্রায় ৪৫ লাখ টাকা, ১০৯টি স্কুল ঘর ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে ৪০০ টাকা করে বছরে মোট প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকা, মেরামত বাবদ ঘর প্রতি বছরে ১০০০ টাকা করে মোট এক লাখ ৯ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু টিসি সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের যোগসাজশে খাতা-কলমে ভুয়া শিক্ষার্থী দেখিয়ে বরাদ্দের সিংহভাগ অর্থ লোপাট করে যাচ্ছে। সরেজমিন তদন্ত করলেই এসব অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যাবে। টিসি আকতারুজ্জামান এভাবে শত শত ভূয়া শিক্ষার্থী দেখিয়ে বরাদ্দের অর্থ উত্তোলন ও শিক্ষকদের কিছু দিয়ে বাকিটা তিনি লোপাট করে চলেছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট স্কুল চত্বরে বুথ স্থাপন ও কমিটির সদস্যদের উপস্থিতিতে স্কুল শিক্ষার্থীদের যাবতীয় অনুদানের টাকা প্রদান করার নিয়ম থাকলেও টিসি এসব নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে চলেছেন। এছাড়াও স্কুল পরিচালনা কমিটি বা সিএমসি’র মাধ্যমে সবকিছু পরিচালিত হবার কথা বলা আছে। সিএমসি গঠনের নিয়ম হচ্ছে তিন নারী ও একজন পুরুষ মোট ৪জন অভিভাবকের মধ্যে একজন অভিভাবক সভাপতি, আনন্দ স্কুলের শিক্ষক সদস্য সচিব, সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্য ও একজন পুরুষ সদস্য হবে আনন্দ স্কুল কমিটির সদস্য, সংশ্লিষ্ট আনন্দ স্কুল সংলগ্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্য থেকে একজন তাদের দ্বারা নির্বাচিত হবেন শিক্ষানুরাগী। মোট ৯ জন সদস্য দ্বারা গঠিত কমিটির মাধ্যমে আনন্দ স্কুলের যাবতীয় আর্থিক লেনদেন, শিক্ষার্থীদের উপকরণ, মাসিক ভাতা ও পোশাকসহ যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা বলা আছে। আবার স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে হলে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ও মানসম্মত শ্রেণিকক্ষের কথা বলা আছে। কিন্তু কোথাও গরুর গোয়াল ঘর, কোথাও অব্যবহৃত পরিত্যক্ত ঘর আবার কোথাও মসজিদের উঠানে আনন্দ স্কুলের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এছাড়াও সিএমসি’র সদস্যরাই নিয়মিত স্কুল পরিদর্শন, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করবেন। শিক্ষার্থীদের অর্থ বিতরণে ডিসকর্সমেন্ট সেল্ প্রতিষ্ঠা ও সোনালী ব্যাংকে হিসাব খুলে অনুদান বিতরণের কথা বলা আছে। অস্থায়ী বুথ খুলে অভিভাবকদের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ভাতা বিতরণ করার নির্দেশনা থাকলেও টিসি নিজের ইচ্ছেমত সবকিছু করছে। সোনালী ব্যাংক বৈদেশিক বিনিময় শাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উপজেলা শাখার হিসাব সমন্বয় ও শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ডাটাবেজ থাকতে হবে। কিন্তু তানোরে এসব নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে টিসি আকতারুজ্জামান নিজের খেয়াল-খুশিমত আনন্দ স্কুল পরিচালনা করে লাখ লাখ টাকা আত্মসাত করে চলেছেন বলে একাধিক সূত্র এই খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছে। এ ব্যাপারে আনন্দ স্কুলের টিসি আকতারুজ্জামানের ব্যক্তিগত মুঠোফোনে ০১৭০৬-৩৬২৭৮২ একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও মুঠোফোনে কল গ্রহণ না করায় তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বদিউজ্জামান বলেন, আনন্দ স্কুলের অর্থ অনুদান বিতরণের ক্ষেত্রে তার কোন প্রয়োজন পড়ে না টিসির। এমনকি তাদের কাছে তেমন নির্দেশনাও নাই। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ বলেন, আনন্দ স্কুলের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে একাধিক পত্রিকায় খবর প্রকাশ হয়েছে সেটা আমি জেনেছি। তিনি বলেন, আমি আসার পরে নতুন কোন স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়নি, তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজ- খবর নিয়ে দেখা হবে বলে তিনি জানান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন