যমুনা বিধৌত উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার সিরাজগঞ্জের তাঁত সমৃদ্ধ এলাকা এখন খটখট শব্ধে মুখরিত। পবিত্র ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে এ অঞ্চলের তাঁতিরা কোমড় বেঁধে নেমে পড়েছেন। রাতদিন কাজ করেও কুলিয়ে ওঠতে পারছে না। অবসর বা বিশ্রাম তদের এখন নেই বললেই চলে। সিরাজগঞ্জের ৯টি উপজেলা জুড়েই কমবেশী তাঁত কারখানা রয়েছে। তম্মধ্যে চৌহালী, বেলকুচি, এনায়েতপুর, শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া অন্যতম। ঐতিহ্যবাহী শাহজাদপুর ও বেলকুচি তাঁতপণ্যের হাটে কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হয়। তাই দেশজুড়ে এজেলার তাঁত পণ্যের খ্যাতি ও চাহিদা রয়েছে।
রমজানের শুরুতেই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে সিরাজগঞ্জের তাঁতপল্লীগুলো। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শ্রমিকরা পাওয়ারলুম-হস্তচালিত তাঁতে নিখুঁতভাবে তৈরি করছে জামদানী, সুতি কাতান, সুতি জামদানী, সিল্ক শাড়ি, সেট, বেনারসি, শেড শাড়ি, থ্রিপিস ও হরেক রকমের লুঙ্গি ও গামছা। আবার কাপড়ের উপর প্রিন্ট এবং রঙ তুলির আঁচড়ে এবং হাতে করছে নান্দনিক ও মনোমুগ্ধকর নকশা। সিরাজগঞ্জের তৈরি শাড়ি-লুঙ্গি-গামছা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিক্রি হচ্ছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে। তবে প্রতিনিয়তই রং-সুতাসহ উপকরণের দাম বৃদ্ধি পেলেও খুব একটা বাড়ছে না তৈরি কাপড়ের দাম। তাই লোকসানের শঙ্কায় তাঁতিরা।
সরকার কর্তৃক সম্পাদিত তাঁত শুমারি ২০০৩ অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ৫ লাখাধিক হস্তচালিত তাঁত রয়েছে তন্মধ্যে সিরাজগঞ্জ জেলাতে রয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজারের অধিক। সিরাজগঞ্জে তাঁতি পরিবারের সংখ্যা প্রায় ১৪,৮৭০ এবং তাঁতের সংখ্যা ১ লাখ ৩৫ হাজারের অধিক। প্রতিবছর এ জেলায় হস্তচালিত তাঁত থেকে প্রায় ২৩ কোটি মিটার বস্ত্র উৎপাদিত হয়। এ শিল্প সিরাজগঞ্জের প্রায় ৩ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঈদকে ঘিরে সিরাজগঞ্জ সদর, বেলকুচি, চৌহালী, এনায়েতপুর শাহজাদপুর, কাজিপুর, উল্লাপাড়া, রায়গঞ্জ, তাড়াশ ও সলঙ্গার তাঁত কারখানাগুলোয় দিনরাত খটখট শব্দ। নারী-পুরুষদের কেউবা নাটাই গুড়িয়ে সুতা কাটছে, নলিতে সুতা কাটছে, কেউবা কাপড় ছেটে কাপড় গুছিয়ে রাখছে। সবমিলিয়ে শ্রমিকদের যেন দম ফেলানোর ফুসরত নেই।
এ অঞ্চলের তৈরি কাপড় দেশের নামি দামি ব্যান্ডের শো-রুমে যাচ্ছে। স্ট্যান্ডার্ড, আমানত শাহ্, ফজর আলী, বৈঠক, বোখারী, মেমোরী, বাবা, পাকিজা, ফাইভ স্টার, অনুসন্ধান, বসুন্ধরা, আড়ংসহ দেশের বড় বড় কোম্পানিগুলো এখানে শো রুম আছে। কোম্পানিগুলো অফ সিজনে তাদের দেয়া ডিজাইনে তাঁতিদের কাছ থেকে হাজার হাজার পিস শাড়ি-লুঙ্গি-গামছা কম মূল্যে কিনে মজুদ করে রাখেন। পরে সিজনের সময় নিজেদের লেভেল লাগিয়ে দ্বিগুন দামে দেশের বিভিন্ন স্থানের পাশাপাশি সৌদি আরব, দুবাই, ভারতসহ বিশ্বের দেশে দেশে রপ্তানি করছে। এছাড়াও তাঁতিরা তাদের উৎপাদিত তাঁত পণ্য জেলার এনায়েতপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ নিউমার্কেট ও টাঙ্গাইলের করটিয়ায় কাপড়ের হাটেও বিক্রি করছেন।
এসব হাট থেকে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকার কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তবে তাঁতিদের অভিযোগ প্রতিনিয়তই রংসুতাসহ তাঁতের উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে তুলনায় কাপড়ের দাম বৃদ্ধি না পাওয়া তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে সময়মত শ্রমিকদের মজুরি ও রং-সুতার দাম, ব্যাংক লোন পরিশোধের জন্য অল্পদামেই তাদের কাপড় বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এ অবস্থায় তাঁত শিল্পকে রক্ষা করতে রং-সুতার দাম নির্ধারণসহ স্বল্পসুদে ঋণের দাবি জানিয়েছেন তাঁতিরা।
সিরাজগঞ্জের তাঁত শ্রমিকরা জানান, আমাদের কোন বোনাস নেই। কাজ করলে মালিকরা টাকা দেয় না করলে কোন টাকা পাই না। তাই পরিবার-পরিজন নিয়ে যেন ভালভাবে ঈদ কাটানোর জন্য একটু বেশি কাজ করছি। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হচ্ছে। তা ছাড়া রমজান মাসে খরচ একটু বেশি হয় তাই প্ররিশ্রম বেশি করতে হচ্ছে।
অপরদিকে তাঁত মালিকরা জানান, বাঙালি নারীদের চাহিদা মোতাবেক বিভিন্ন নান্দনিক ডিজাইনের রুচিসম্মত শাড়ি তৈরি হচ্ছে। উৎপাদিত শাড়ি ৩শ’ থেকে ১০ হাজার টাকায় পাইকারী বিক্রি হলেও রং-সুতার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন খরচের সাথে বিক্রয় মূল্যের সমন্বয় না হওয়ায় তাঁতিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট আবু ইউসুফ সুর্য্য জানান, তাঁত শিল্পের সাথে সিরাজগঞ্জের অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত। দেশিয় তাঁত শিল্প রক্ষায় সরকারকে তাঁতিদের ঋণসহ রং-সুতায় ভুর্তুকি দিতে হবে। পাশাপাশি দেশে যেসব তাঁতপণ্য উৎপাদন হয় সেগুলো যাতে বাইরের দেশে অবৈধভাবে যেতে না পারে সেজন্য সরকারকে কঠোর হতে হবে। তাহলে তাঁতশিল্পের প্রসার ঘটবে। উৎপাদিত শাড়ি-লুঙ্গি গামছা দেশের বাইরে রপ্তানি করে মুনাফা অর্জন সম্ভব। পাশাপাশি অবৈধপথে ভারত থেকে কমদামী শাড়ি আসা বন্ধ করতে হবে। তাহলেই তাঁত শিল্প সমৃদ্ধ হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন