সোনালী আঁশ পাট ও আখের পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে নরসিংদীতে ধান চাষ। সরকারি খাতায় ধান চাষের এরিয়া বৃদ্ধি পেলেও জেলার ৬ টি উপজেলায় ধান চাষ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে।
দিনদিন উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, ব্যয় অনুযায়ী আয় না হওয়া, বিভিন্ন ভ্যারাইটির ফলন কমে যাওয়ায় উৎপাদন ঘাটতি, মাটির উর্বরতা হ্রাস, নিম্নভ‚মি ধানের মাঠ ইট পাথরের নিচে চাপা পড়া, অপরিকল্পিত নগরায়ন, গোচারণ ভূমি না থাকায় গবাদি পশুর সংখ্যা হ্রাস, জৈব সারের পরিবর্তে রাসায়নিক সারের ব্যবহার, জলাশয় ভরাট, বিদেশে চাকরি এবং মিল ফ্যাক্টরি সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ক্ষেত মজুরের সংখ্যা হ্রাস সর্বোপরি ধান চাষে প্রত্যক্ষ ভর্তুকি প্রত্যাহারের কারণে ধান চাষ এখন পাট চাষের মতোই একটি অলাভজনক খাতে পরিণত হতে চলছে। অলাভজনক হয়ে যাওয়ায় পাট চাষ যেমন বিলুপ্ত প্রায়। আগামী এক দশকে ধান চাষের এরিয়া কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছ।
অতীতকাল থেকে পাটের মতই নরসিংদী ছিল ধান চাষের জন্য বিখ্যাত। জেলা শহরসহ সর্বত্র ছিল সবুজ ধানের শত শত মাঠ। নরসিংদীতে উৎপাদিত ধান স্থানীয় চাহিদা মিটিয়েও রাজধানী ঢাকার ৪০ ভাগ চাহিদা পূরণ করতো। আশির দশকে এরশাদ সরকার বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ধানের উপর থেকে প্রত্যক্ষ ভর্তুকি প্রত্যাহার করে নেয়। এর পরেই ধান চাষে অধোদশা দেখা দেয়। ১৯৮৪ সালে তৎকালীন মহাকুমাকে জেলায় উন্নীত করার পর থেকে শুরু হয় অপরিকল্পিত মিল ফ্যাক্টরি স্থাপন, অপরিকল্পিত নগরায়ন।
নরসিংদী সমস্ত মাঠের দিকে তাকালে শুধু ধান আর ধান ছাড়া আর কিছুই দেখা যেত না, সেখানে এখন শুধু বড় বড় বিল্ডিং আর মিল ফ্যাক্টরি ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব তীরের দীর্ঘ ৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ৪ কিলোমিটার প্রস্থ চরের নিম্নভূমিতে ব্যাপকহারে ধান চাষ করা হতো। এই দীর্ঘ চর এখন ভূমিখেকোদের সাইন বোর্ডের দখলে। নরসিংদী সদর উপজেলার মধ্যে থেকে আড়াই হাজার পর্যন্ত ধানের মাঠে এখন শুধু দালানকোঠা আর মিল ফ্যাক্টরিতে ভরে গেছে। নরসিংদী জেলা শহর সংলগ্ন হাজিপুর, পুরান পাড়া, দাসপাড়া, বিলাসদী, ভাগদী, বাসাইল, সাহেপ্রতাপ, দগরিয়া, শালিধা, কামারগাঁও, শিবপুরের ভারতেরকান্দি, কামারগাঁও পলাশে শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব তীরসহ জেলার বিভিন্ন এলাকা বহুসংখ্যক ধানের মাঠ এখন অপরিকল্পিত দালান কোঠা বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা এবং অপরিকল্পিত মিল ফ্যাক্টরির দখলিভূত হয়ে ধান চাষ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কমে গেছে শতশত হেক্টর জমির ধান চাষাবাদ। মনোহরদী, বেলাব, রায়পুরাসহ বিভিন্ন এলাকায় যেসব জমিতে ধানের চাষাবাদ হয় তাতেও ফলন কমে গেছে অর্ধেকের চেয়েও বেশি। বোরো মৌসুমে যেসব ভ্যারাইটি ধান চাষাবাদ হয় এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে উফশী জাতের ব্রি-২৮ ও ২৯। শতকরা ৮০ ভাগ জমিতেই এই জনপ্রিয় দুটি ভ্যারাইটি চাষাবাদ হয়ে থাকে। ভ্যারাইটি দুইটি উদ্ভাবনের সময় ফলন হয়েছ বিঘা প্রতি ৩০ থেকে ৩৫ মণ পর্যন্ত। কিন্তু গত দশকাধিককালে ফলন আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। এখন বিঘা প্রতি ১০ থেকে ১২ মণের বেশি ফলন হচ্ছে না।
কৃষকরা জানিয়েছন, ধানের ফলন যে দিন দিন কমে যাচ্ছে তা সাধারণ কৃষকরা আমলে নিচ্ছে না। এসব সাধারণ কৃষকরা বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করে না। পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী তারা যুগ যুগ ধরে তাদের নিজেদের খোরাকের জন্য নিজেদের জমিতে ধান চাষাবাদ করে আসছে। বছরে খেয়ে দেয়ে যাবে সে হচ্ছে তা বাজারে বিক্রি করে দিয়েছ। চাষাবাদ লাভজনক হচ্ছে, না লোকসান হচ্ছে সে দিক নিয়ে তারা ভাবছে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন