আবদুল আউয়াল ঠাকুর
ষাটের দশকে প্রাথমিকে কঁচিকথা বইয়ে কবি কাদের নেওয়াজ লিখিত ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ নামে একটি কবিতা ছিল। কবিতাটির শেষাংশে লেখা ছিল “আজ হতে চির উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির...”। কবিতার বিষয়বস্তু ছিল, স¤্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্রকে গৃহশিক্ষকের পায়ে অজুর পানি ঢালতে দেখে ফেলেছিলেন স¤্রাট নিজে। পরে স¤্রাট শিক্ষকের কাছে এলে শিক্ষক ভেবেছিলেন তার আর নিস্তার নেই। তিনি খানিকটা ভয়ও পেয়েছিলেন। অবশ্য স¤্রাট ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন কেন তার পুত্র নিজ হতে পানি ঢেলে শিক্ষকের পা ধুয়ে দিলেন না, এজন্য। স¤্রাটের এহেন আচরণে শিক্ষক স¤্রাটের ভূয়সী প্রশংসা এবং সেই সাথে স¤্রাটের যোগ্যতা ও ব্যক্তিত্বের প্রশংসা করে শিক্ষক স¤্রাটকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, “সত্যিই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর”। বর্তমান সময়ে যেসব পাঠ্যবই রয়েছে সেসব পাঠ্যবইয়ে এ ধরনের কোনো কবিতা বা গল্প অন্তর্ভুক্ত থাকলে হয়তো নানা প্রশ্ন উঠে যেত। সে আলোচনা আজকের বিষয় নয়। নারায়ণগঞ্জের একজন প্রধান শিক্ষক এখন আলোচনার তুঙ্গে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ রাজনৈতিক অঙ্গনেও এখন এ আলোচনা খানিকটা জায়গা জুড়ে নিয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, কোনটি সত্য কোনটি অসত্য কার্যত তা যাচাই করার অবস্থাও বোধকরি নেই। এটা মানতেই হবে, কখনো কখনো এরকম অবস্থা হয় অথবা সৃষ্টি করা হয়। একে গোয়েবলসীয় প্রচারণাই বলা হোক আর জনমত গঠনের প্রচেষ্টাই বলা হোক বাস্তবতা হচ্ছে, এ অবস্থা নানা কারণে হয়ে উঠতে পারে। চূড়ান্ত বিবেচনায় এটা হচ্ছে নৈরাজ্যের চিত্র। যে বিষয় নিয়ে চলমান আলোচনার সূত্রপাত সেখানকার বাস্তবতা কি ছিল সেটি এখন আর হয়তো বিবেচনাতেই নেয়া যাচ্ছে না। বলে রাখা ভালো, গত কিছু দিনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে বেশ কিছু বড় ধরনের অনিয়মের প্রতিকার হয়েছে। সরকারি নানা কড়াকড়ির কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন কে কোথায় বেড়াতে যাচ্ছে, কার কোথায় বিয়ে হচ্ছে, কে কাকে পছন্দ করছে সেগুলোই প্রধান উপজীব্য হয়ে উঠেছে। অনেকটা প্রেম পরিচয়ের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। এর নানা বিপত্তির খবরও প্রকাশিত হচ্ছে। সঙ্গতভাবেই এটা বোঝা যায়, এ ধরনের মাধ্যমে প্রকাশিত সবকিছুই তথ্যনির্ভর নয়। সে যাইহোক, আলোচ্য শিক্ষকের প্রসঙ্গও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণেই অত্যধিক গুরুত্ব পেয়েছে। বর্তমানে আলোচনার শীর্ষে অবস্থান করছে। কোনো শিক্ষকের কানে ধরা বা গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া এই প্রথম কিনা অথবা এই একটিমাত্র ঘটনা কিনা সেটা জানার জন্য কোনো গবেষণার প্রয়োজন নেই। গত কিছু দিনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই দেশে পুরনো এবং প্রতিষ্ঠিত বিএম কলেজসহ যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলদের গায়ের জামা ছিঁড়ে অপমান করে বের করে দেয়া হয়েছে তার সচিত্র ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকারি ছাত্র সংগঠনের সাথে বনিবনা না হওয়াতেই তাদের সরকার কর্তৃক মনোনীত শিক্ষকদেরই এরূপ হেনস্থা হতে হয়েছে। এমনকি সাম্প্রতিক রিপোর্টে এও বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কোনো শিক্ষকের দ্বারা কোনো শিক্ষার্থীর শ্লীলতাহানি হলেও ওই শিক্ষকের রাজনৈতিক বিবেচনাকে সামনে নিয়েই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এমনও বলা হয়েছে, তদবিরই এখন ভিসি নিয়োগের মাপকাঠি। কার্যত গোটা দেশে যেভাবে নির্লজ্জ দলীয়করণ ও একটি বিশেষ শ্রেণীকে প্রশ্রয় দেয়ার প্রবণতা কার্যকর সে বিবেচনাতেই আলোচ্য ঘটনার বিশ্লেষণ জরুরি।
শিক্ষকের মর্যাদার বিষয়টি খুবই জরুরি আলোচনার দাবি রাখে। শিক্ষাকে যদি জাতির মেরুদ- মনে করা হয় তাহলে শিক্ষকরা হচ্ছেন সেই মেরুদ- তৈরির কারিগর। গোটা বিষয়কে যদি মানবদেহের সাথে মিলিয়ে দেখা যায় তাহলে রাজনীতিবিদরা যেহেতু সমাজ পরিচালনা করেন তারা হচ্ছেন সমাজের মাথা। আর মাথাকে যে ঊর্ধ্বে তুলে ধরছে সে হচ্ছে মেরুদ-। পে-স্কেল বা বেতন নির্ধারণে শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতন যাই দেয়া হোক না কেন, শিক্ষাহীন সমাজ অচল। তাই শিক্ষককে অবহেলার কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষা বলতে প্রকৃত অর্থে সুশিক্ষাকেই বোঝানো হয়। বর্তমান সময়ে সেই মানের শিক্ষার যে মারাত্মক অভাব রয়েছে সে কথা দায়িত্বশীলদের মুখ থেকেও মাঝে-মধ্যে শোনা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহল আমাদের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বহুদিন আগে থেকেই। শুধু গণটোকাটুকি বা প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ই নয়, সার্বিকভাবে শিক্ষার মানের যে অবনতি হয়েছে তা মেধামননের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। দেশে ভুয়া ডক্টরেট পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। নকল করে ছবি বানানো হচ্ছে। আবার সেই ছবি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে। নকল প্রকাশনার ছড়াছড়ি। যাই হোক, দেশে শিক্ষার মান কাক্সিক্ষত না হলে এবং শিক্ষা গ্রহণের সময়ে মানসম্মত শিক্ষা দেয়া না গেলে সারা জীবনই তার অভাব থেকে যায়। সে কারণেই হয়তো দেশের আমলাতন্ত্রে দক্ষতা-যোগ্যতার সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। এটি মূলত যোগ্য শিক্ষক এবং শিক্ষামানের বড় ধরনের শূন্যতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। দেশে শিক্ষক না আমলাতন্ত্র ক্ষমতাবান দুঃখজনক হলেও এ বিতর্কও কিছু দিন আগে শোনা গেছে। শিক্ষা যে একটি ব্রত, এখন বোধহয় সে বিবেচনায় কেউ শিক্ষাকে দেখছে না। বরং শিক্ষাকে চলমান চাকরি-বাকরির বিবেচনাতেই দেখা হচ্ছে। বাস্তবতা যদিও এটাই যে, শিক্ষক আর অন্য দশজন একই বাজার থেকে চাল কিনে খান, তাই তাকে ভিন্নভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষককে সে কারণেই জীবনমানের বিষয়টিতে নজর রাখতে হয়। এখানেই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে। দেশে শিক্ষার মানোন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হলে শিক্ষকের মান-মর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষাঙ্গনকেও কেবল শিক্ষার জন্যই উন্মুক্ত রাখতে হবে। এটা বলা কষ্টকর, চলমান প্রবণতা প্রকৃতপক্ষে কতটা মানসম্মত শিক্ষার অনুকূলে রয়েছে। ইতোমধ্যেই পাঠক্রম নিয়ে দেশের ইসলামী সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলনরতরা ঘোরতর প্রতিবাদ করছেন। সেই সাথে জাতীয় ঐতিহ্য অনুরূপ পাঠক্রম নির্ধারণের দাবি জানিয়ে আসছেন। এ কথা বোধকরি নতুন করে আলোচনার অপেক্ষা রাখে না যে, শিক্ষার মান না থাকলে শিক্ষকেরও মান থাকে না। সাধারণ কথায় বলা বলা হয় যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান। আবার কেউ খারাপ কিছু করলেও পিতা গালি থেকে বাদ পড়েন না। অনুরূপভাবে কর্মক্ষেত্রে বা অন্যত্র কোথাও যোগ্যতার পরিচয় দিলে তার প্রাথমিক স্কুল থেকে উচ্চতর ডিগ্রির প্রতিষ্ঠানের নাম-ধামও প্রকাশিত হয়। কখনো কখনো শিক্ষকের নামও আলোচনায় উঠে আসে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা একজন শিক্ষকের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তার একটি শোনা প্রসঙ্গ প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় তুলে ধরছি। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ঢাকা কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় কলেজের বিদ্যমান নানা অসঙ্গতির সূত্র ধরেই নাম শুনেছি অধ্যক্ষ জালাল স্যারের। তিনি এ কলেজের দায়িত্ব পালন করেছেন সাবেক পাকিস্তান আমলে। পাকিস্তানের শেষ দিনগুলোতে ছাত্র আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখনও ঢাকা কলেজের দেয়ালে কোন পোস্টার লাগানো যেত না। একদিন নাকি তার ব্যত্যয় হয়েছিল। তখন অধ্যক্ষ সংশ্লিষ্ট সংগঠনের ছাত্রদের ডেকেছিলেন। তাদের মতামত শোনার পর তিনি কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্রদের জন্য আলাদা নোটিশ বোর্ডের ব্যবস্থা করেছিলেন যেখানে শিক্ষার্থীরা এসব পোস্টার সাঁটাতে পারত। এটি আলোচনার বিষয় নয়। শুনেছি একদিন নাকি তাকে না জানিয়ে সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর কী কারণে ঢাকা কলেজে গিয়েছিলেন তার সাথে দেখা করতে। গভর্নর তার অফিস রুমের গেটে দাঁড়িয়ে থাকলেও তিনি তাকে প্রবেশের অনুমতি দেননি। জবাবে নাকি তিনি বলেছিলেন, এ ধরনের কারো আসার কথা আমার জানা নেই। গভর্নরও নাকি প্রবেশ না করে চলে গিয়েছিলেন। আর এ জন্য অধ্যক্ষের কোনো বদলি বা তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বিষয়টি এ কারণে উল্লেখ করলাম, আজ যখন শিক্ষাঙ্গনের নানা নৈরাজ্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তখন অবশ্যই ভেবে দেখা দরকার আমরা কোথায় কী হারিয়েছি এবং সংকটের প্রকৃত কারণ কী? এই আলোচনার মূলে নারায়ণগঞ্জের যে শিক্ষক সে প্রসঙ্গে আসা যাক। নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিফাত হাসান আলোচ্য এই শিক্ষকের বক্তব্যের অন্যতম অভিযোগকারী। দশম শ্রেণীর বাণিজ্য বিভাগের এই শিক্ষার্থী দৈনিক ইনকিলাবের সাথে সাক্ষাৎকারে বলেছে, গত ৮ তারিখ রোববার দশম শ্রেণীর চতুর্থ পিরিয়ডে ইংরেজি শিক্ষক উত্তম স্যারের ক্লাস চলছিল। অনেক ছাত্রছাত্রী থাকায় হই-চই চলছিল। এ সময়ে আনুমানিক দুপুর সাড়ে ১২টায় হেডস্যার শ্যামলকান্তি ভক্ত উত্তেজিত হয়ে রুমে ঢুকলেন। প্রথমে মেয়েদের পাশে গিয়ে বললেন তোরা অমানুষ। শিক্ষার যোগ্যতা অর্জন করবি কীভাবে? ছেলেদের পাশে গিয়ে বললেন তোরা অমানুষ, মানুষ হবি কীভাবে? তোরা নাপাক তোদের আল্লাহও নাপাক। এই ছাত্রটি তার সাক্ষাৎকারে জানিয়েছে, এ নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন ক্লাস শিক্ষকও। সেই সাথে একজন ছাত্রীও। পরবর্তী ঘটনাও সবার জানা। এরপর মারপিটের ঘটনা ঘটেছে। আলোচ্য শিক্ষার্থী প্রধান শিক্ষকের মার খেয়ে অজ্ঞান হয়েছে। এরপর পরিস্থিতির নতুন মোড় নেয়। পরিস্থিতি সম্পর্কে স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান বলেছেন, শ্যামলকান্তি ভক্ত ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করেছেন। আমি সংসদ সদস্য হয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছি। তিনি আরো বলেছেন, আমি কোনো শিক্ষকের বিচার করিনি। আমি একজন ইসলামের কটূক্তিকারীর বিচার করেছি। ধর্ম অবমাননার দায়ে এলাকাবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষকের শাস্তি হয়েছে। এটি যদি অন্যায় হয়ে থাকে, সাজারযোগ্য অপরাধ হয়ে থাকে, এতে যদি ফাঁসিও হয় আমি মাথা পেতে নেব। আমি ক্ষমা চাইব না। তিনি জানিয়েছেন, পরিস্থিতি উপলব্ধি করে তিনি স্বেচ্ছায় কান ধরে উঠবোস করেন। এরপর জনতা শান্ত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার সাথে সাথেই শিক্ষক শ্যামলকান্তিকে পুলিশ প্রহরায় হাসপাতালে পাঠিয়ে দেই। কারণ সে গুরুতর আহত অবস্থায় ছিল। এরপরের খবর হচ্ছে, আলোচ্য প্রধান শিক্ষক একটি মোবাইল ফোনে সংসদ সদস্যের কাছে তার তিন মেয়ের বিয়ে ও প্রতিবন্ধী মেয়ের চিকিৎসার জন্য এক কোটি টাকা চেয়েছেন। ইতোমধ্যে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হলে সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রীও শ্যামলকান্তির পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং সেই সাথে শাস্তিও দাবি করেছেন। আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এই শিক্ষককে দেখতে গেলে তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পায়ে জড়িয়ে ধরেছেন। তাকে দেখে এসে মন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় লজ্জা থাকলে সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান সংসদ অধিবেশনে আসবেন না। হ্যাঁ এ কথা ঠিক সেলিম ওসমান সরকারি দলের নয় বরং সরকারের মিত্র জাতীয় পার্টির এমপি। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের একজন মন্ত্রী লজ্জার যে প্রসঙ্গ তুলেছেন এটা সত্যিই লজ্জার বিষয়। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সব মহল যখন ২০১৪ সালের অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও দুর্নীতি-দুবর্ৃৃত্তায়নের অভিযোগ উত্থাপন করছে সরকারের বিরুদ্ধে তখন কি তাদের কোনো লজ্জাবোধের জন্ম হয়েছে? হঠাৎ করে শ্যামলকান্তির এ ঘটনায় লজ্জার প্রসঙ্গ উঠল কেন? কার্যত যদি লজ্জার কোনো বিষয় থেকে থাকে তা তো শ্যামলকান্তির থাকার কথা। যিনি পায়ে পড়তে পারেন তিনি কানেও যে ধরতে পারেন তাতে সন্দেহ করার কিছু নেই। দুটোই একজন শিক্ষক এবং শিক্ষক সমাজের জন্য লজ্জাজনক। তার চেয়েও লজ্জার টাকা চাওয়া। এখানে এটাও বলা দরকার, একজন প্রধান শিক্ষকের নির্দয়ভাবে ছাত্র পেটানো কতটা সুস্থতার লক্ষণ সে বিবেচনাও জরুরি।
বিবিসির সাথে আলোচনাতেও আল্লাহ সম্পর্কে মন্তব্যের সত্যতা রয়েছে। মূল ঘটনাটি ঘটেছে ছাত্রদের সাথে। যারা এ ঘটনাকে অন্যভাবে দেখতে চান তাদের বিবেচনায় রাখা দরকার নিতান্তই খামাখা এ ধরনের বিষয় ওঠার কোনো সুযোগ নেই। সে কারণেই বিবেচ্য একজন প্রধান শিক্ষক হিসেবে তিনি কতটা যোগ্য? এদেশে অনেক নামিদামি শিক্ষকের কথা বলা যাবে যারা ধর্ম বিশ্বাসে একেবারেই নাস্তিক। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের এমন শিক্ষক রয়েছেন যাদেরকে তাদের যোগ্যতার জন্য দলমত নির্বিশেষে সবাই শ্রদ্ধা করেন। কই তাদের নিয়ে তো কখনই কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। ধর্ম বিশ্বাসকে যদি একান্ত নিজস্ব বলেও বিবেচনা করা যায় তা হলেও এ কথা স্বীকার করতে হবে, কাউকে আঘাত করার শিক্ষা কোথাও নেই, সে বিবেচনাতেও প্রধান শিক্ষকের বক্তব্য বিবেচ্য। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। একবার হজরত শেখ সাদী (র.)-কে বাদশাহ নাকি বলেছিলেন, আমি বিড়ালকে বশ মানিয়েছি। বিড়ালের মাথায় বাতি রেখে আমি লিখতে পারি। কথাটা পরখ করার জন্য হজরত শেখ সাদী (র.) একদিন একটি ইঁদুর সাথে নিয়ে রাজদরবারে প্রবেশ করলেন। যথারীতি তিনি বাদশাহকে ক্ষমতা দেখানোর আহ্বান জানালেন এবং ইঁদুর ছেড়ে ছেড়ে দিলেন সঙ্গে সঙ্গে বাদশাহর সব কেরামতি উধাও হয়ে গেল। বাস্তবত ইদানীং যে প্রবণতা চলছে তার মূলে কে বা কারা রয়েছেন তা পরিষ্কার না হলেও বোধকরি এক ধরনের নার্ভ টেস্টিং চলছে। যে বিচার করা হয়েছে বলে প্রকাশিত হয়েছে প্রকৃতপক্ষে সেটি কোনো বিচার কিনা সেটা দেখার দায়িত্ব ইতোমধ্যেই উচ্চতর আদালত নিয়েছেন। বিচার নিয়ে কথা বলার কোনো ইচ্ছা নেই। এটা পরিষ্কার যে, প্রকৃতই এটা কোনো বিচার নয়। একে গ্রাম্য ভাষায় বলা যায়, মুখরক্ষার বিচার। হতে পারে স্থানীয় সংসদ সদস্য সেটাই করে সব পক্ষকে সন্তুষ্ট করতে চেয়েছেন। সে যাই হোক। হঠাৎ করে একজন প্রধান শিক্ষক সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন না। ছাত্রদের সাথে কাক্সিক্ষত সম্পর্কের কোনো অবনতি এর আগে হয়েছে এমন কোনো নজিরও নেই। তাহলে এবার ঘটল কেন? বোধকরি একজন প্রধান শিক্ষক হিসেবে এটাই তার সবচেয়ে বড় অদক্ষতা। যেখানে তার বিরোধ মেটানোর কথা সেখানে তিনি নিজেই বড় ধরনের বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। সরকার অনেকটা একরোখা হয়েই তাকে আবার একই পদে নিয়োগ দিয়েছেন। এতে তার বিরুদ্ধে সৃষ্ট অসন্তোষের অবসান হয়েছে, না বৃদ্ধি পাচ্ছে বোধকরি তা দেখার দায়িত্বও সংশ্লিষ্টদের।
ইসলামে শিক্ষকের মর্যাদা অনেক বেশি। অনেকেই মনে করেন পিতামাতার পরেই মর্যাদার দিক থেকে শিক্ষককে দেখা হয়। ইসলামে জ্ঞান অর্জনকে আবশ্যকীয় বলা হয়েছে। মহাপবিত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর রাসূলের কাছে প্রথম যে অহি নাজিল করেছেন তার প্রথম শব্দই হচ্ছে ‘পড়’। জানতে হলে পড়তে হবে। পড়তে হলে শিক্ষকের প্রয়োজন। পিতাকে শিক্ষকের সাথে আর শিক্ষককে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পিতার সাথে তুলনা করা হয়। দুজনই অভিভাবক। একজন পরিবারে অন্যজন স্কুলে। যারা বিশ্বাস করেন তারা মনে করেন মহান আল্লাহ হচ্ছেন এই পৃথিবীর ¯্রষ্টা ও পরিচালক। একজন মুসলিম ছাত্রের মনে সে শিক্ষাই থাকার কথা। একজন প্রধান শিক্ষক হিসেবে কঁচি মনে আঘাত লাগতে পারে এমন কোনো আলোচনা করা তার আওতাভুক্ত নয়। এটা সবারই মনে রাখা দরকার, বিশ্বাস ও অনূভূতিতে আঘাত করা কোনো বিবেচনাতেই কাম্য নয়। হতে পারে ইদানীং হয়তো এটা একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। কোনো সভ্য শিক্ষিত দেশের শিক্ষক এমনটা করতে পারেন না। কারণ তার দায়িত্ব হচ্ছে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানদান করা। শিক্ষকের মর্যাদা সমাজে আচরিত শিষ্টাচারবহির্ভূত কোনো ব্যাপার নয়। অবশ্যই একজন শিক্ষকের লাঞ্ছিত হওয়া সভ্যতার নজির নয়। আবার একজন শিক্ষক যখন তার দায়-দায়িত্ব ভুলে যান সেটাও কোনো বিবেচনাতেই কাম্য হতে পারে না। সমাজে শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধির প্রধান দায়িত্ব শিক্ষকদেরই। সামাজিক শক্তি তাতে কেবল প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করে। শিক্ষা এবং শিক্ষক সংক্রান্ত সব ধরনের অবাঞ্ছিত ঘটনার মূল কারণ অনুসন্ধান করে তা নিরসনে সংশ্লিষ্টরা আন্তরিক হবেন, এটাই সময়ের দাবি।
awalthakur@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন