জামালউদ্দিন বারী
প্রকৃত কবিরা দেশকালের গ-ি পেরিয়ে মহাকাল ও মহাদেশের অবারিত স্বীমায় সমহিমায় টিকে থাকেন। কবির একটি দেশ, নিজস্ব ভাষা এবং লোকজ ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার থাকে। প্রাচীন ভারতীয় পুরাণের কবি বাল্মিকী থেকে শুরু করে এ সময়ের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি আল মাহমুদ পর্যন্ত এর কোনো ব্যত্যয় দেখা যায়নি। এ কারণে প্রায় প্রতিটি দেশ ও জাতির মধ্যেই নিজস্ব কবিদের নিয়ে জাতিগত গৌরব ও আত্মপরিচয়ের একটি ঐতিহাসিক ঐতিহ্য আছে। একটি জাতির ভাষা ও সাহিত্যের হাজার বছরের ইতিহাসে অনেক কবি-সাহিত্যিকের জন্ম হলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় মূলত একজনকেই জাতীয় কবি বা সাহিত্যিকের মর্যাদায় অভিষিক্ত করা হয়। ইরানে ফেরদৌসীর পাশাপাশি রুমি, সাদি, ওমর খৈয়াম, রুদাকি অনেক মহাকবির জন্ম হলেও শাহনামার বদৌলতে মহাকবি ফেরদৌসীকেই জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়া হয়। এর অর্থ এই নয় যে, অন্য কবিরা গৌণ বা ছোট। দেশের কোনো কবিকে জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত করার সাথে জাতির রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক বিবর্তনের একটি নিবিড় সম্পর্ক থাকে। যে কারণে ফেরদৌসী ইরানের জাতীয় কবি, রবীন্দ্রনাথ ভারতের জাতীয় কবি, ইকবাল পাকিস্তানের জাতীয় কবি, শেকসপিয়র ইংল্যান্ডের জাতীয় কবি, হুইটম্যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় কবি, খোশাল খান খাট্টক আফগানিস্তানের জাতীয় কবি, মাহমুদ দারবিশ প্যালেস্টাইনের জাতীয় কবি ঠিক একই কারণে কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। যদিও কালোত্তীর্ণ সব কবির কবিতা ও শিল্পীর শিল্পকর্ম বিশ্বের সব মানুষের সম্পদ। তথাপি জাতীয় কবির কবিতা ও সাহিত্যকর্ম জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক- বিবর্তনের ইতিহাসকে ধারণ করে থাকে। অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতে জন্মগ্রহণকারী আল্লামা ইকবালের কবিতা ‘সারা জাঁহাসে আচ্ছা, হিন্দুস্তাঁ হামারা’ ভারতের অন্যতম জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হলেও ইকবাল ভারতের নন, পাকিস্তানের জাতীয় কবি। আবার ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে রচিত রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে আমরা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করলেও আমাদের জাতীয় কবি রবীন্দ্রনাথ নন, নজরুল ইসলাম। ঔপনিবেশিক শোষণের নিগড় থেকে বেরিয়ে এসে শোষণ-বৈষম্যহীন একটি সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল কবি নজরুলের স্বপ্ন ও সাধনা। নজরুলের প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের মধ্যে এক বিরলপ্রজ সাযুজ্যের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। তার কবিতা ও গানে যেভাবে অবিভক্ত বাংলার হিন্দু-মুসলমানের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকার ও সম্প্রীতির মেলবন্ধন ঘটেছে চর্যাগীতিকার কবিদের থেকে শুরু করে অদ্যাবধি আর কোনো বাঙালি কবির মধ্যে এমন মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্বাক্ষর পাওয়া যায়নি। জাতির এক চরম ক্রান্তিকালে হিন্দু ও মুসলমানের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ভাবাবেগ তুলে ধরার এমন কৃতিত্ব একমাত্র নজরুলের।
বাংলা ভাষাভাষী হিন্দু-মুসলমানদের একটি অবিভক্ত রাষ্ট্র গঠনের ব্যর্থতা এখন একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনার বিষয়। বিংশ শতকের একেবারে শুরুতে যারা পূর্ববাংলা ও আসামকে নিয়ে একটি আলাদা প্রদেশ গঠনের প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন তারাই সাতচল্লিশে অনেকটা নীরবেই বাংলার দ্বি-খ-ন মেনে নিয়েছিল। ভিন্নভাবে বলা যায়, বাংলার হিন্দু-মুসলমানের মনোজগতে বিদ্বেষের দেয়াল সৃষ্টিতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছিল, আলাদা রাষ্ট্র গঠন ছাড়া তা থেকে উত্তরণের আর কোনো পথ হয়তো খোলা ছিল না। প্রথমত : বৃহৎ ভারত থেকে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পূর্ববাংলার মুসলমানদের পাকিস্তানে যোগ দেয়া, দ্বিতীয়ত : দুই দশকের মধ্যেই পাকিস্তানের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হতে একটি রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে একটি স্বতন্ত্র জাতি রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের মধ্যেই এই বাংলার মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঘটেছে। যদিও নজরুল কখনো খ-িত স্বাধীনতা প্রত্যাশা করেননি। তিনি একটি ঔপনিবেশিক শোষণমুক্ত সৌভ্রাতৃত্বের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূলে ছিল তার সাচ্চা ইমানদারি মুসলমানিত্ব। যুগের অগ্রবর্তী অনন্য প্রতিভাবান মহৎ মানুষদের বেশির ভাগই স্ব-কালে এবং স্বদেশে ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়ে বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হতে দেখা গেছে। নজরুল এর অন্যতম দৃষ্টান্ত। আমার কৈফিয়ত কবিতায় নজরুল নিজেই তার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছিলেন।
‘মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘মোল্লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’,
‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!
ফতোয়া দিলাম- কাফের কাজী ও,/ যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!
‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!
হিন্দুরা ভাবে, ‘পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’
আনকোরা যত নন্ভায়োলেন্ট নন্-কো’র দলও নন্ খুশী।
‘ভায়োলেন্সের ভায়োলিন্’ নাকি আমি, বিপ্লবী-মন তুষি!
‘এটা অহিংস’, বিপ্লবী ভাবে,/‘নয় চর্কার গান কেন গা’বে?’
গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পাতি-রাম ভাবে কন্ফুসি!
স্বরাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের আঙ্কুশী’
শক্তিশালী প্রতিবাদী লেখনীর কারণে ব্রিটিশরাজের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন নজরুল। সেই সাথে ভারতের সব ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তো বটেই সংকীর্ণ রাজনৈতিক মতাদর্শপুষ্ট রাজনৈতিক পক্ষ থেকেও আক্রমণের শিকার হয়েছেন নজরুল। তার লেখনী একই সাথে অসাধু মোল্লা, ধর্মনিরপেক্ষ ও তথাকথিত প্রগতিবাদীদের বিরুদ্ধে সমানভাবে সক্রিয় ছিল। যখন নজরুলের লেখা ঈদের গান, ইসলামী গজল, হামদ-না-ত ছাড়া মুসলমানের উৎসব জমে না, তখনো একশ্রেণীর মোল্লা তাকে ‘কাফের’ ফতোয়া দিয়েছিল। যিনি নিজে জাতিকে ইসলামের পুনর্জাগরণের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, ধর্মের জন্য শহীদ হতে প্রস্তুত ছিলেন, তিনি আবার সাম্যবাদের গান-কবিতার পাশাপাশি হিন্দুদের জন্য অসংখ্য শ্যামা সংগীতও লিখেছেন। আবার তথাকথিত মডারেট মুসলমানদের কেউ কেউ যখন হিন্দুদের সাথে সুর মিলিয়ে ঈদুল আজহায় পশু কোরবানির বিরুদ্ধে কথা বলছিল, মৌলভী তরিকুল আলম নামে একজন যখন পত্রিকায় লেখা প্রবন্ধে কোরবানিতে অকারণে পশু হত্যা করা হয় বলে দাবি করলেন কাজী নজরুল তার প্রতিবাদ করে লিখেছেনÑ ‘কোরবানী’ কবিতায়Ñ ‘ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন/দুর্বল! ভীরু! চুপ রহো, খামখা ক্ষুব্ধ মন।’
ভারত ভাগ হয়ে যাওয়ায় ব্রিটিশ ভারতের আইসিএস অফিসার এবং সুসাহিত্যিক অন্নদা শঙ্কর রায়ের মধ্যে যে আক্ষেপ জন্ম নিয়েছিল নিজের লেখা (খুকুও খোকা) ছড়ায় তা তিনি প্রকাশ করেছেন এভাবেÑ “তেলের শিশি ভাঙল বলে, খুকুর প‘রে রাগ কর/তোমরা যেসব বুড়ো খোকা- ভারত ভেঙে ভাগ কর! তার বেলা?”। অন্যদিকে দেশ ভাগের পর নজরুলকে নিয়ে অন্নদাশঙ্করের প্রতিক্রিয়া ছিল এ রকমÑ ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে/ভাগ হয়নিকো নজরুল/এই ভুলটুকু বেঁচে থাক/ বাঙালি বলতে একজনই আছে, দুর্গতি তাঁর ঘুঁচে যাক।” সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক পরিবেশে অসাম্প্রদায়িক নজরুল ইসলাম দুর্গতির মধ্যে পড়তে বাধ্য, প্রাজ্ঞ সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় ভালোভাবেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। স্বাধিকার ও উদার মানবতাবাদী আদর্শের কারণে ব্রিটিশরাজের কারাভোগ থেকে শুরু করে প্রায় শত বছর পেরিয়ে এসে নজরুল এখনো সাম্প্রদায়িক হীনম্মন্যতা ও রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার। গত ২৫ মে বাংলাদেশের জাতীয় কবির ১১৭তম জন্মদিনের রাষ্ট্রীয় আয়োজনে অংশ নিতে আসা নজরুলের উত্তরসূরি (নাতনি)রাও নজরুলের আদর্শ থেকে বিচ্যুতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের পাঠ্যক্রম থেকে নজরুলের অধিকাংশ লেখা বর্তমান সরকার বাদ দিয়েছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন। শুধু নজরুলের রচনাই নয়, ইসলামী মূল্যবোধ সম্পৃক্ত অধিকাংশ কবিতা, গল্প-রচনাই পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
চিরতরে অসুস্থ হওয়ার আগে ১৯৪০ সালে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে কবি নজরুল বলেছিলেন, “মুসলমানরা যে একদিন দুনিয়াজোড়া বাদশাহী করতে সমর্থ হয়েছিল সে তাদের ইমানের বলে। আজ আমরা ইমান হারিয়ে ফেলেছি। ইমানের অর্থ ‘পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ’। ভারতে রাজা-বাদশাদের দ্বারা ইসলাম জারি হয়নি। আর মানুষের মঙ্গলের বিধান করেছেন আউলিয়া, পীর-বুজুর্গান। সারা ভারতে হাজার হাজার মাজার কেন্দ্র করে আজো সেই শান্তির কথা আমরা শুনতে পাই। আমি মাওলানা আকরম খাঁ ও মৌলবি ফজলুল হক সাহেবকে বলেছিলাম যে, আসুন আপনারা সমস্ত ত্যাগ করে হজরত ওমর (রা.) ও আবুবকরের (রা.) আদর্শ সামনে রেখে সমাজে লাগি, আমি আমার সব কিছু ছেড়ে কওমের খেদমতে লাগতে রাজি আছি।” এর আগে ১৯৩২ সালের ৫ ও ৬ নভেম্বরে সিরাজগঞ্জের নাট্য ভবনে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলনের সভাপতি হিসেবে প্রদত্ত কবি নজরুলের অভিভাষণটি ‘তরুণের সাধনা’ নামে নিবন্ধাকারে ছাপা হয়। এই নিবন্ধের শেষ প্যারায় নজরুল লিখেছেনÑ ‘আমরা চাই সিদ্দিকের সাচ্চাই, ওমরের শৌর্য ও মহানুভবতা, আলীর যুলফিকার, হাসান-হোসেনের ত্যাগ ও সহনশীলতা। আমরা চাই খালেদ-মূসা, তারেকের তরবারি, বেলালের প্রেম। এসব গুণ যদি আমরা অর্জন করতে পারি, তবে জগতে যাহারা আজ অপরাজেয়, তাহাদের সহিত আমাদের নামও সসম্মানে উচ্চারিত হবে। তিনি ইসলামের মহানবীর খলিফা ও সাহাবায়ে কেরামের মতো অনুকরণীয় মুসলিম নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন, এই লক্ষ্য অর্জনে সবকিছু ত্যাগ করতেও প্রস্তুত ছিলেন। এটিই হচ্ছে নজরুল চেতনার স্বরূপ। একজন নজরুল গবেষক আক্ষেপ করে লিখেছেন, “কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। অথচ এ ভূ-খ- থেকে তাঁর ওপর কোনো প্রামাণ্য জীবনী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। এ দুঃখের কথা কাকে বলব? ত্রিশ বছর বয়সে সেই ১৯২৯ সালেই তিনি পেয়েছিলেন ‘বাঙালির জাতীয় কবি’ অভিধা। এ বিষয় সকল তথ্যের সন্ধান মিললেও মাত্র চল্লিশ বছর আগে তাকে যখন স্বাধীন দেশটির ‘জাতীয় কবি’ ঘোষণা করা হয়, সে বিষয়ক তথ্যের বড় অভাব। সে অভাব পূরণে এগিয়ে আসার মানুষের বড় সংকট। তাঁকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান চলে, কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির বর্তমান সময়ে তাঁকে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ওয়েবসাইট নেই। ভিনভাষী একজন মানুষ আমার কবিকে অনলাইনে পড়তে চাইলে তার জন্য কোনো ব্যবস্থা আমরা করিনি।”
রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি শোষণমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদ্রষ্টা ও অগ্রনায়করা এ কারণেই জাতীয় চেতনার প্রতীক হিসেবে নজরুলকেই বেছে নিয়েছিলেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা থেকে অসুস্থ কবি নজরুল ইসলামকে ঢাকায় এনে জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত করার মধ্য দিয়ে এক মহান কর্তব্য পালন করেছিলেন। ১৯৭৬ সালের ২৭ আগস্ট কবি নজরুলের ইন্তেকালে পুরো জাতি শোকে-শ্রদ্ধায় মুহ্যমান হয়েছিল। তখন দেশে একটি রাজনৈতিক ক্রান্তিকালেও সেদিন নজরুলের জানাজা এবং শোকর্যালিতে হাজার হাজার মানুষের ঢল নেমেছিল। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সায়েম এবং তৎকালীন উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমানসহ তিন বাহিনীর প্রধানসহ ঊর্ধ্বতন সামরিক-বেসামরিক কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে নজরুলকে সমাহিত করার মধ্য দিয়ে নজরুলের প্রতি জাতীয় দায়িত্বের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়েছিল। ১৯৭৯ সালের ২৫ মে কবি নজরুলের ৮০তম জন্মবার্ষিকীর র্যালিতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ, ঢাকার মেয়রসহ দেশের বিশিষ্ট নাগরিক এবং হাজার হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে শহীদ জিয়া বার বার কবি নজরুলের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সামরিক বাহিনীর কতিপয় বিশৃঙ্খল সদস্যের গুলিতে নিহত হওয়ার মাত্র চার দিন আগে নজরুলের ৮২তম জন্মদিনের বাণীতে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে কবি নজরুলের স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার নেতৃত্বে নজরুলের ৮০তম জন্মদিন যতটা গুরুত্ব ও মর্যাদার সাথে পালিত হয়েছিল। জিয়ার মৃত্যুর পর নজরুলের সেই জন্মদিন এতটা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও গুরুত্ব আর কেউ দিতে পারেনি। এমনকি ১৯৯৯ সালে জাতীয় কবির জন্ম শতবর্ষের অনুষ্ঠানমালাও তৎকালীন সরকারের কাছ থেকে যথাযোগ্য গুরুত্ব ও মর্যাদা পায়নি। কবি নজরুল ইসলাম এক বিস্ময়কর সাহিত্য প্রতিভার নাম। তার সৃষ্টির সৌন্দর্য, মানবতা, সাম্য ও শান্তির বিশ্বজনীন অমিয় বাণী নজরুলকে বিশ্ব নাগরিকতায় উত্তীর্ণ করলেও আমরা তা অনুধাবনেও যেন ব্যর্থ হচ্ছি। ‘নজরুলের হাজার গানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালি আন্দোলিত হয়। তাকে নিয়ে বিদেশি কবি প্রভাবিত হন, বিদেশি গবেষক শতবর্ষ পূর্বের প্রাচ্য কবির সাহিত্যে শতবর্ষ পরের পাশ্চাত্য জীবনের অনুরণন দেখেন। আমরা কেন আমাদের কবিকে সেই উচ্চতায় দেখার যোগ্যতা অর্জন করি না!’ নতুন প্রজন্মের নজরুল ভক্তরা এই প্রশ্নের জবাবদিহিতা দাবি করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে ¯œাতক (সম্মান) পাস করতে হলে ১৮০০ নম্বরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, সেখানে ১৯২১ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নজরুল বিষয়ক পাঠ্য ছিল মাত্র ১৬.৪ নম্বরের। অর্থাৎ নজরুল সম্পর্কে কিছু না পড়ে বা না লিখেও একজন ছাত্র বাংলা সাহিত্যে অনার্স পাস করতে পারে। সম্প্রতি এখানে ১০০ নম্বরের নজরুল পাঠ্য কোর্স যোগ করেই যেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের সব দায়িত্ব শেষ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নামমাত্র একটি নজরুল গবেষণা কেন্দ্র থাকলেও এই কেন্দ্রের গবেষণা কখনো দৃশ্যমান হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৮টি গবেষণা কেন্দ্রের মধ্যে সাহিত্য-সামাজিক গবেষণা সম্পর্কিত ১৫টি কেন্দ্রের মধ্যে নজরুল গবেষণাকেন্দ্র একটি। এই কেন্দ্রের বাজেট বরাদ্দও অন্য যে কোনো গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ে কম। ২০১০ সালের এক রিপোর্টে দেখা যায়, ২০০৯ সালে নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মাত্র ৭৫ হাজার টাকা বাজেট বরাদ্দ দিলেও গোবিন্দ দেব দর্শন গবেষণা কেন্দ্রের জন্য বাজেট বরাদ্দ ছিল ৩ লাখ টাকা। এ থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে নজরুলের গুরুত্ব কতটা তা বোঝা যায়। পাকিস্তানের শাসকরা এক সময় রবীন্দ্র সাহিত্যের ওপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল। এ দেশের মানুষ তা সহজভাবে মেনে নেয়নি। তবে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে নজরুলকে নানাভাবে অবহেলা করা হলেও এদেশের গণমাধ্যম, তথাকথিত সুশীল সমাজসহ জাতীয়ভাবে রবীন্দ্র বন্দনার আতিশয্য বেড়েই চলেছে। সেই সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতাও বেড়ে চলেছে।
আমার কৈফিয়ত কবিতার শেষ দুই লাইনে নজরুল লিখেছেন, ‘প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস/ যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ।’ এভাবেই গণমানুষের অধিকার রক্ষার সংগ্রামে নজরুলের কবিতা হয়ে ওঠে প্রেরণার অগ্নি মশাল। আমরা যখন একটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও সর্বগ্রাসী সামাজিক-নৈতিক অবক্ষয়ের সম্মুখীন হচ্ছি তখন নজরুলের সাম্য চেতনা এবং সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বজ্র নির্ঘোষ প্রতিবাদ জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যেতে পারে। তবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাষকরা যেমন নজরুলের লেখনীকে ভয় পেয়ে তার বই বাজেয়াপ্ত করে তাকে জেলে ভরেছিল, ঠিক একইভাবে একালের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দুর্বত্তায়িত শাসকরাও নিজেদের কায়েমি স্বার্থের প্রতিকূল আদর্শিক শক্তি বিবেচনা করে নজরুলকে নির্বাসনে পাঠাতে চায়? আমাদের সরকার এবং সব রাজনৈতিক পক্ষ নজরুলকে যেভাবে এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিশ্ববিদ্যালয় ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড যেভাবে নজরুলের ইসলামিক মূলোবোধ সম্পৃক্ত লেখাগুলো পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দিচ্ছে তাতে স্বাভাবিকভাবেই এই সন্দেহ জাগতে পারে। বিদ্রোহী কবির ভাষায় ‘বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির’ আত্মজাগরণের প্রতিভু নজরুলের বিরুদ্ধে যত ষড়যন্ত্রই হোক, এ দেশের গণমানুষের চেতনা থেকে নজরুলকে মুছে ফেলা অসম্ভব।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন