ইফতেখার আহমেদ টিপু
রোয়ানু নামের প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় ২১ মে শনিবার দেশের উপকূলীয় এলাকায় তান্ডব চালিয়েছে। পাঁচ ঘণ্টা ধরে ১০০ কিলোমিটার বেগে ঝড় ও বৃষ্টির তা-ব কেড়ে নিয়েছে অন্তত ২৬ জনের প্রাণ। জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ভেসে গেছে ফসলের মাঠ, মাছের ঘের। ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিপুল বাড়িঘর ও গাছপালা।
বঙ্গোসাগরে সৃষ্ট রোয়ানু নামের ঘূর্ণিঝড়টি ২১ মে শনিবার রাত ৮টা নাগাদ স্থল নি¤œচাপে পরিণত হয় এবং খাগড়াছড়ি দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরামের দিকে চলে যায়। ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতিবেগ সবচেয়ে বেশি ছিল পতেঙ্গায়। গতি ছিল ১২৮ কিলোমিটার। ২০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের ‘রোয়ানু’ ৭০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে তা-ব সৃষ্টি করে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দেশজুড়ে শনিবার ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়। যেসব এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের তা-ব অনুভূত হয়েছে সেসব এলাকার জনজীবন পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে পড়ে। উপকূলবর্তী এলাকাগুলো দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে। বৈদ্যুতিক তার ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্বাভাবিকের চেয়ে তিন চার ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের বেশির ভাগ বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গাছপালা উপড়ে এবং পাহাড় ধসেও সৃষ্টি হয় বিপর্যস্ত অবস্থা।
ঘূর্ণিঝড়ের পূর্ব প্রস্তুতি থাকায় এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার সক্ষমতা বাড়ায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশেই রোধ করা সম্ভব হয়েছে। তারপরও রোয়ানু উপকূলীয় অঞ্চলে ফসল, গাছপালা ও বাড়িঘরের যে ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়েছে তা বিপুল। যে ২৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে তাদের কেউ কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার সময় ঘূর্ণিঝড়ের তা-বের মুখে পড়েন। ঘূর্ণিঝড়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এক জাতীয় ট্র্যাজেডি। ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত উপকূলীয় এলাকায় মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বহু এলাকায় খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে ভুগছে দুর্গত মানুষ। প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করলেও তা চাহিদার তুলনায় কম। এ সংকট মোকাবেলায় ত্রাণ তৎপরতা জোরদারের উদ্যোগ নিতে হবে। সমাজের সম্পন্ন যারা তাদেরও বাড়াতে হবে সহানুভূতির হাত।
দুর্বিষহ অবস্থায় কক্সবাজার, কুয়াকাটাসহ উপকূলবর্তী নিচু এলাকার পানিবন্দী লাখ লাখ মানুষ। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ধানসহ উঠতি ফসলের। ভেসে গেছে ঘেরগুলোর শত কোটি টাকার মাছ। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুতে শুধু চট্টগ্রাম মহানগর ও উপকূলীয় এলাকার ১০৪টি ইউনিয়নের ৪ লাখ ৮৩ হাজার ৮৬ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর মধ্যে সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৮১ হাজার ৪১১ জন মানুষ। আর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৪ লাখ ১ হাজার ৬৭৫ জন মানুষ। বাঁশখালী উপজেলায় সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ১০ হাজার পরিবার এবং আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪২ হাজার পরিবার। এ ছাড়া ১০ বাড়িঘর সম্পূর্ণভাবে এবং ১২ হাজার বাড়িঘর আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখানে ১০০ একর ফসলি জমি সম্পূর্ণভাবে এবং ১২৫০ একর আংশিকভাবে নষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া ১৩ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ৩টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ে বাঁশখালীতে ২০ কিলোমিটার রাস্তা ও ৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণভাবে এবং ৫০ কিলোমিটার রাস্তা ও ১৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আনোয়ারা উপকূলের ৫ হাজার পরিবার সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত এবং ২ হাজার ৮০০ পরিবার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্পূর্ণভাবে ভেসে গেছে প্রায় ২০০ বাড়িঘর ও আংশিক ক্ষতি হয়েছে ২ হাজার ৫০০ বাড়িঘর। ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ১০০ একর এবং আংশিক ক্ষতি হয়েছে ৩৫০ একর জমি। এখানে তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দুটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ৬ কিলোমিটার রাস্তা ও ৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ এবং ২০ কিলোমিটার রাস্তা ও ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সন্দ্বীপে রোয়ানুতে ৭ হাজার ৯১২টি পরিবার সম্পূর্ণ ও ৪৮০৫টি পরিবার আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। সম্পূর্ণভাবে বাড়িঘর ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৮ হাজার এবং আংশিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৫ হাজার। এ ছাড়া ১৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ২টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আংশিকভাবে ক্ষতি হয়েছে। সন্দ্বীপের প্রায় ১৭ কিলোমিটার রাস্তা ও ১১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর তা-বে দুর্গতদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হবে, ফসলহানির কারণে সারা বছর অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে হবে। রোয়ানুর কারণে হাজার হাজার পরিবার গৃহহারা, দুই লাখেরও বেশি মানুষ পানিবন্দি। অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। কেউ কেউ ত্রাণশিবিরেও উঠেছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকেই অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। অবিলম্বে দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
ষ লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক নবরাজ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন