শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

আমাদের যাত্রা হলো শুরু...এবং...স্মৃতিচারণ

প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রুহুল আমীন খান
১৯৮৬ সালের ৪ জুন দৈনিক ইনকিলাব আত্মপ্রকাশ করে। প্রত্যেক মহৎ কাজের একটা ব্যাকগ্রাউন্ড থাকে। ইনকিলাবেরও আছে তেমন একটা সমৃদ্ধ ব্যাকগ্রাউন্ড। তখন ইরান-ইরাক যুদ্ধ চলছে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে, যুক্তরাজ্যসহ পাশ্চাত্য দুনিয়ার সমর্থন যেমন ছিল সাদ্দাম হোসেনের প্রতি তেমনি আরব জাহানের রাজপুরুষরাও সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছিলেন তাকে। তার কারণও ছিল সুস্পষ্ট। ইরানের অবিসংবাদিত আধ্যাত্মিক নেতা আয়াতুল্লা খোমেনীর নেতৃত্বে যে মহাবিপ্লব শুরু হয়েছিল ইরানের সীমান্ত অতিক্রম করে তার দোলা লেগেছিল ঐ অঞ্চলের সব দেশে। সে বিপ্লবের বিস্তার তাদের দেশেও ঘটতে পারে এ শঙ্কায় তারা শঙ্কিত হয়েছিলেন এবং সাদ্দামের নেতৃত্বে তা প্রতিরোধে তৎপর হয়েছিলেন। এ সময়ই ঐতিহাসিক বাগদাদ নগরীতে আহ্বান করা হয় পপুলার ইসলামী কনফারেন্স। বিশ্বের ৮৪টি দেশের বিশিষ্ট ইসলামী স্কলার, আলেম- উলামা, পীর-মাশায়েখদের দাওয়াত দেয়া হয় এই ঐতিহাসিক কনফারেন্সে। এতে প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন, দক্ষ সংগঠক ও রাজনীতিবিদ মাওলানা এমএ মান্নানের মাধ্যমে বাংলাদেশের ২২ জনকে দাওয়াত দেয়া হয়। যার মধ্যে ছারছীনার পীর ছাহেব হযরত মাওলানা শাহ্্ আবুজাফর মো. ছালেহসহ স্বনামধন্য অনেকেই ছিলেন এবং এই লেখকও ছিলেন। আমাদের থাকার স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিল বাগদাদের সুবিখ্যাত হোটেল আল-রশিদে। সেখানেই বসেই ছারছীনার পীর ছাহেব-মাওলানা হুজুর (মাওলানা এমএ মান্নান) কে বললেন, ইসলাম ও মুসলমানদের কথা তুলে ধরার জন্য একটি দৈনিক পত্রিকার প্রয়োজনীয়তা আমি তীব্রভাবে অনুভব করছি। আমি ফকীর-মানুষ, এমন একটি দৈনিক প্রকাশের সাধ্য আমার নেই। আল্লাহপাক আপনাকে সে সাধ্য ও ক্ষমতা দান করেছেন, আপনি এ অভাব পূরণ করুন, একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করুন। মাওলা হুজুর সম্মতি প্রকাশ করলেন। গাউসুল আজম বড়পীর ছাহেব হযরত আবদুল কাদির জিলানী (রহ.) এর মাজার শরীফে ও দরবারে বসে এ জন্য দোয়া ও মুনাজাত করা হল। সেখান থেকে ফেরার পথে মক্কা ও মদীনা শরীফে ওমরা আদায় ও জিয়ারত করারও সৌভাগ্য হল আমাদের এবং পবিত্র হারামাইন শরীফাইনেও দোয়া হল।
আরও একটি ঘটনা মাওলানা হুজুরকে পত্রিকা প্রকাশে প্রাণিত করেছিল। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলিতে এ সময়ে অনুষ্ঠিত হয় একটি আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলন। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠকদের নেতাদের দাওয়াত দেয়া হয় এ সম্মেলনে। মাদরাসা শিক্ষকদের অবিসংবাদিত নেতা মাওলানা এমএ মান্নানও দাওয়াত পান। মাওলানা হুজুর ত্রিপলিতে বসে বাংলাদেশের সরকারি- বেসরকারি শিক্ষক সংগঠনসমূহের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সংগে ঘনিষ্ঠভাবে আলাপ-আলোচনার সুযোগ লাভ করেন। শিক্ষক নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশে শিক্ষা আন্দোলনকে জোরদার করা- তথা শিক্ষার সার্বিক উন্নয়ন, শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, শিক্ষার্থী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের উন্নয়নের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেন। তারা একমত হন, নিজ নিজ সংগঠন বহাল রেখে সাবর্জনীন দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষে একটি শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন গঠন করার। পরবর্তীতে তা গঠন করা হয়েছিল। সে অন্য কথা। তবে শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয় বিশেষভাবে তুলে ধরার জন্যও একটি পত্রিকার আবশ্যকীয়তার বিষয়টিও মাওলানা হুজুরের চিন্তায় যোগ হয়।
মাওলানা এমএ মান্নান ছিলেন মাদরাসা শিক্ষকদের অবিসংবাদিত নেতা। তিনি মাদরাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী লোক। মাদরাসায় সুনামের সাথে শিক্ষকতা করেছেন দীর্ঘদিন। সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেও মাদরাসা শিক্ষকদের ভুলে যাননি। তাদের সাথে সর্বদা সম্পৃক্ত থেকেছেন। পাকিস্তানি শাসনামলেও তিনি মাদরাসা শিক্ষকদের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরেছেন প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনে। আদায় করে এনেছেন বেশ কিছু দাবি-দাওয়া। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরে তিনি এই সংগঠনের হাল ধরেন শক্ত হাতে। আলিয়া ধারার মাদরাসা শিক্ষকদের ঐক্যবদ্ধ করেন এই সংগঠনের পতাকাতলে। সম্মেলন, মহাসম্মেলন করে করে তাদের উজ্জীবিত করে তোলেন, করে তোলেন অধিকার সচেতন। আন্দোলনকে করেন বেগবান। মুসলিম জাহানে একে পরিচিত করে তোলেন। আরব জাহানের সাথে তার ঘনিষ্ঠতাকেও কাজে লাগান। বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন নব প্রাণ লাভ করে তার বিস্ময়কর নেতৃত্বে। তিনি জমিয়াত নেতৃবৃন্দের সভায়ও পেশ করেন পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্তের কথা। তারা এ ব্যাপারে মাওলানা হুজুরকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
মাওলানা হুজুর পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত তো নিয়েছিলেন বাগদাদ শরীফের সেই কনফারেন্স থেকেই, এবার তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করতে থাকেন। তার একটা বিশেষ গুণ ছিল, আটঘাট বেঁধে কাজে হাত দেয়া। প্রথমে চিন্তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কর্মসূচি নির্ধারণ, তারপর তা বাস্তবায়নে সর্বশক্তি নিয়োগ।  মাওলানা হুজুরের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল ছাত্র জীবন থেকেই। লেখা-লেখি, সাংবাদিকতা, সম্পাদনার কাজের সাথে আমার সম্পৃক্ততার কথা তিনি জানতেন। আমি তখন দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র ছারছীনা দারুচ্ছুন্নাত আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলাম। সেখান থেকে তিনি আমাকে নিয়ে এলেন ঢাকায়। দায়িত্ব দিলেন পত্রিকা প্রকাশের প্রাথমিক কাজগুলো সম্পাদনের।
মাওলানা হুজুর চাইছিলেন ভাড়াটে ছাপাখানায় নয়, নিজস্ব ছাপাখানায় ছাপা হবে, ভাড়াটে বাড়িতে নয়, পত্রিকার নিজস্ব বাড়ির ঠিকানা থেকে ইনকিলাব আত্মপ্রকাশ করবে, যাতে নিয়মিত প্রকাশে কোন বাধা-বিঘœ না ঘটে। আল্লাহর মেহেরবাণীতে সুন্দর একটা জায়গাও পাওয়া গেল, কেনা হল, দৈনিক ইত্তেফাক ভবনের পাশে ২/১ আর কে মিশন রোডে নির্মাণ শুরু হল সুরম্য ইনকিলাব ভবন। প্রথমে ভারত থেকে আমদানি করা হবে ওরিয়েন্ট মেশিন। অর্ডার দেয়া হল কোম্পানিকে। সে মোতাবেক গজ মেশিনের নমুনায় মেশিন তৈরি হল কোম্পানির হরিয়ানার কারখানায়। হুজুরের সাথে আমিও গেলাম দিল্লীতে। জিয়ারত করলাম হযরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়া, হযরত শাহ আবদুল আজিজ (রহ.)সহ দিল্লী ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাস্থিত পীর, ওলী-আউলিয়াদের মাজার। এরপর দিল্লী থেকে গেলাম হরিয়ানায়। আমাদের দেখানো হল ইনকিলাবের জন্য প্রস্তুত করা প্রিন্টিং মেশিনের ইউনিটগুলো এবং ঢাকায় চালানোর উদ্দেশ্যে বাক্সবন্দি করা হল।
এরপর শুরু হল সাংবাদিক ও অন্যান্য কর্মচারীদের নিয়োগের পালা। মাওলানা হুজুর ঢাকার সমমনা প্রখ্যাত সাংবাদিকদের সাথে অনেক আলাপ করলেন, মতবিনিময় করলেন, তাদের থেকে মূল্যবান পরামর্শ নিলেন। খন্দকার আবদুল হামিদ, সানাউল্লাহ নূরী, আখতারুল আলম, একে এম মহিউদ্দিন, আসাফুদ্দৌলা রেজা প্রমুখ এদের মধ্যে অন্যতম।
সম্পাদক নিয়োগের ব্যাপারে যখন চিন্তাভাবনা ও খোঁজাখুঁজি চলছিল তখন অনেক অভিজ্ঞজন পরামর্শ দিলেন, মাওলানা হুজুরের জ্যৈষ্ঠপুত্র এ এম এম বাহাউদ্দীনকে সম্পাদক হিসাবে নিয়োগের। বয়সে নবীন হলেও প্রজ্ঞা-পা-িত্য, দার্শনিক সুলভ বিশ্বদৃষ্টি, নিষ্ঠা ও আদর্শে অবিচলতায় ইতোমধ্যে তিনি পরিচিত জনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। মাওলানা হুজুর অনেক ভেবে-চিন্তে শুভানুধ্যায়ীদের এ প্রস্তাব গ্রহণ করলেন এবং নিয়োগ দিলেন। ধীরস্থির মস্তিষ্কের অধিকারী, সময় অনুবর্তিতা ও নিয়মে নিষ্ঠাবান অভিজ্ঞ সাংবাদিক একে এম মহিউদ্দীকে নিয়োগ দেয়া হল মহাসম্পাদক হিসাবে। মাওলা কবি রুহুল আমীনখানকে নির্বাহী সম্পাদক হিসাবে, ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক অধ্যাপক আবদুল গফুরকে ফিচার সম্পাদক হিসাবে। মফিজ উদ্দীন আহমাদ, হাফিজ উদ্দীন আহমদ, কথা-সাহিত্যিক ইউসুফ শরীফ, মাওলানা খালেদ সাইফুল্লা সিদ্দীকীকে সহকারী সম্পাদক হিসাবে নিয়োগ প্রদান করা হল। কিছু দিন পরে মুনশী আবদুল মাননান এবং আরো পরে হারুনুর রশিদ, আবদুল আউয়াল ঠাকুরকে এই পদে নিয়োগ দেয়া হয়। বার্তা বিভাগে সুলতান আহমাদ (বার্তা সম্পাদক), মো. মূসা (চীফ সার এডিটর), নূরুদ্দীন (চীফ রিপোটার) মঞ্জুরুল আলম (সিনিয়র রিপোর্টার) এবং মাহবুবুল বাসেত, ড. আবদুল হাই, জাকারিয়া কাজল ফটো সাংবাদিক সালাহউদ্দীনসহ আরো অনেক সিনিয়র জুনিয়র নিয়োগ প্রাপ্ত হলেন। ফিচার বিভাগকে গফুর ভাই নিজ পছন্দমত লোক নিয়ে সাজালেন। এদের মধ্যে বিভিন্ন ফিচার পাতার দায়িত্বে এলেন, শেখ দরবার আলম, মুনশি মাওলানা ফজলুর রহমান, হাসনাইন ইমতিয়াজ, মকবুলা পারভিন এবং পরবর্তীতে মাওলানা ওবায়দুর রহমান খান নদভী প্রমুখ। সাধারণ ও অন্যান্য বিভাগে মমিন খান লোহানী, হাবীবুর রহমান তালুকদার শামসুল হক, আবদুল কুদ্দুসের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আয়োজন প্রায় শেষ। কিন্তু ইনকিলাব ভবন নির্মাণের কাজ এখনো অসম্পূর্ণ। এ অবস্থায়ই প্রিন্টিং মেশিন বসানো হলো। সার্কুলেশন ভবন থাকবে ২/১ আরকে মিশন রোডে। বিসমিল্লাহ বলে সূচ অন করে উদ্বোধন করলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী জালাল আহম্মাদ। অন্যান্য কাজ চলবে কোথায়? তার সুব্যবস্থা করা হল এভাবে যে, সম্পাদকীয় ও ফিচার বিভাগের কাজ চলবে মাওলা হুজুরের নিজস্ব বাসভবনের নিচতলায়, নিউজ রিপোর্টিং, কম্পোজ, পেস্টিং প্লেট তৈরি ইত্যাদি চলবে, বনানী ১১নং রোডে ভাড়া নেয়া একটি বাড়িতে। জেনারেল সেকশনের জন্য ভাড়া নেয়া হল বনানী ২নং রোডে আর একটি বাড়ি। এখানে বসলেন সম্পাদক বাহাউদ্দীন ভাই এবং তার কনিষ্ঠভ্রাতা ও অন্যতম ডিরেক্টর আবুজাফর মো. সালাহউদ্দীন। অনেকে দ্বিধান্বিত ছিলেন ৪/৫ জায়গার কাজ সমন্বিত করে প্রতিদিন নিয়মিতভাবে যথা সময় দৈনিকটি প্রকাশ করা সম্ভব হবে তো? কিন্তু আল্লাহপাকের অফুরন্ত মেহেরবানী, বিস্ময়করভাবে নির্বিঘেœ সব কাজ চলেছে নিখুঁত ও নিপুণভাবে। বনানী থেকে আরকে মিশন রোডে ছুটোছুটিতে কখনো থমকে দাঁড়াতে হয়নি লাল জীপ গাড়িটিকে। ভারতীয় মেশিন হলেও অত্যন্ত ভাল সার্ভিস দিয়েছে ওরিয়েন্ট প্রেস ইউনিটগুলো।
অবশেষে এল প্রতীক্ষিত সেই শুভক্ষণ। ১৯৮৬ সালের ৪ জুন। হোটেল সোনারগাঁওয়ে হল যাত্রা শুরুর অনুষ্ঠান।
সবার হাতে হাতে ইনকিলাবের উদ্বোধনী সংখ্যা। সেই সংগে সবাই শুনল আর এক আনন্দ বার্তা। ঐদিনই জন্ম নিয়েছে সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীনের প্রথমা কন্যা। দুই নবজাকের আবির্ভাবে পুলক-প্লাবিত হলেন সবাই।
প্রকাশের কিছু দিনের মধ্যেই ইনকিলাব সাড়া জাগাতে সক্ষম হল। এর একটা নিজস্ব পাঠকমহল গড়ে উঠল। সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় বিশেষ বিশেষ প্রতিবেদন, ফিচার পাতাগুলোর নিবন্ধের মধ্যে তারা প্রাণের কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পেল। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের যে বোধ বিশ্বাস, জীবনাচরণ, আচার অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। যাকে অনেক সময়, উপেক্ষা করা হয়েছে, অবহেলা করা হয়েছে, উপহাস করা হয়েছে সেই ব্যথা প্রসমনের এবং অনেক না বলা কথা, না বলতে পারা কথা একটা বলিষ্ঠ মাধ্যম পেয়ে তারা একে লুফে নিলেন। ইনকিলাবকে মনে করলেন একান্তভাবেই নিজের পত্রিকা। এ শ্রেণির পাঠকরা কী চায় তা বুঝতে পারা, হৃদয়ঙ্গম করতে পারা, তাকে ভাষা দিতে পারা, প্রকাশ করতে পারার মধ্যেই নিহিত ছিল ইনকিলাবের সাফল্য। আপনজনের কাছে, আপন প্রতিষ্ঠানের কাছে মানুষের একটা প্রত্যাশা থাকে, এটা যে যতটা পূরণ করতে পারে সে ততটাই হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারে। প্রকাশের কিছু দিনের মধ্যেই সেই পারঙ্গমতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হল ইনকিলাব।
ইনকিলাব কোন রাজনৈতিক দলের মুখপত্র নয়, কোন বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার নয়, সত্য প্রকাশে সে অকুণ্ঠ, দেশের স্বার্থে সে নিরাপোস, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব, এর প্রতিইঞ্চি ভূমির পবিত্রতা রক্ষার ক্ষেত্রে পত্রিকা হিসাবে তার ভূমিকা অটল, অবিচল। উগ্রতা, চরমপন্থা, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতার সে চরম, বিরোধী। আসলে সাম্প্রদায়িকতার কথা আমাদের এই দেশকে নিয়ে যা প্রচার করা হয় তার অনেকটাই উদ্দেশ্য প্রণোদিত। আরবজাহান, মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকার বহু দেশ ভ্রমণের সুযোগ আমার হয়েছে- একথা গর্বের সঙ্গে আমি বলতে পারি, এদেশের মানুষের মত এমন উদার, পরমত সহিষ্ণু মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। এখানের মুসলমানরা পরম নিষ্ঠার সাথে যেমন নিজ ধর্ম পালন করে, তেমনি অন্য ধর্মের মানুষের ধর্ম পালনেও করে সার্বিক সহযোগিতা। এখানে মসজিদে মসজিদে ইমামগণ, ওয়াজ মাহফিলে মাহফিলে উলামা মাশায়েখগণ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সর্বদা কথা বলেন। সংখ্যালঘুদের সাথে সহ অবস্থান, তাদের অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা সুরক্ষার কথা সোচ্চার কণ্ঠে উচ্চারণ করেন। ইসলাম শান্তি ও নিরাপত্তার ধর্ম। সত্যিকার ইসলামকে আমরা যত শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে পারব শান্তি ও নিরাপত্তা ততটাই নিশ্চিত হবে। আর এর থেকে যতটাই আমরা সরে যাব অশান্তি ও অস্থিরতা ততই আমাদের গ্রাস করবে। এদেশে ইসলাম এসেছে সুফী সাধক, আউলিয়ায়ে কেরামের মাধ্যমে। তাদের শিক্ষা প্রেমের শিক্ষা, ¯্রষ্টা ও সৃষ্টিকে ভালবাসার শিক্ষা, উদারতা ও মানবতার শিক্ষা, হিংসা, বিদ্বেষ, পরিহারের শিক্ষা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, ন্যায়-ইনসাফের শিক্ষা। এ দেশের মুসলমানদের মন-মানসে সে শিক্ষার প্রভাব সদা জাগ্রত। তাই চারদিকে শত উস্কানী সত্ত্বেও তার কুপ্রভাব থেকে আমাদের দেশ, আমাদের জনগণ এখনো মুক্ত। ইনকিলাব তার প্রতিষ্ঠা কাল থেকে নানাভাবে একথা বার বার বলে এসেছে।
তবু সব কথা সবার সহ্য হয় না, সব সত্য সকলে মেনে নিতে পারে না। সবার চিন্তা, জীবন দর্শন, বিশ্বদৃষ্টিও এক নয়। ‘সব ফুল ফুটতে দাও’  এটা মুখে আওড়ালেও কাজ হয় অনেকের বিপরীত। এই অসহিষ্ণু লোকেরা অন্যের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করতে চায়। গলা টিপে ধরতে চায়। দীর্ঘ চলা পথে ইনকিলাবকেও বার বার এরূপ কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। সাময়িকভাবে কখনো কখনো এর প্রকাশনা বন্ধও থেকেছে। কথায় আছে, ‘বিপদে বন্ধুর পরিচয়’। সে পরিচয় ইনকিলাব বার বার পেয়ে ধন্য হয়েছে। ইনকিলাবের প্রকাশনা বন্ধের দুর্দিনে একে খুলে দেয়ার দাবি গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে, নিভৃত পল্লীর পথঘাটে উচ্চারিত হয়েছে। রাজধানীর রাজপথে পর্যন্ত মিছিল হয়েছে, সভা হয়েছে, সমাবেশ হয়েছে। মসজিদে মসজিদে মাহফিলে মাহফিলে দোয়া ও মুনাজাত হয়েছে। দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ছারছীনার পীরছাহেব হযরত মাওলানা শাহ্্ আবুজাফর মো. ছালেহ (রহ.), জৈনপুরী ছিলছিলার পীরে কামিল হযরত মাওলানা আবদুল লতীফ চৌধুরী (রহ.) (ফুলতলী ছাব) এজন্য মিছিলে নেমেছেন, সমাবেশ করেছেন। আরও বহু ওলামা-মাশায়েখ, ইসলামী জনতা এ দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন, সরকারের কাছে দাবি পেশ করেছেন। কেবল দেশেই নয় ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন শহর জনপদে বাংলাভাষাভাষী লোকদের মধ্যেও এ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। এ দাবিতে সোচ্চার হওয়া দৃশ্যমান হয়েছে। এখানেই ইনকিলাবের স্বার্থকতা। ইনকিলাবের প্রতি এই একাত্মতার, এই ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ দেশে-বিদেশে সর্বত্র দেখে আমি অভিভূত হয়েছি।
অগনিত মানুষের ভালবাসায় সিক্ত, অগণন গুণগ্রাহীর প্রীতিতে ধন্য, জনগণ নন্দিত ইনকিলাব বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে, বহু বাধা-বিঘœ অতিক্রম করে আল্লাহর মেহেরবানীতে সুদীর্ঘ তিনটি দশক পূর্ণ করেছে। শুরু করেছে ৩১তম বছরের পথ-পরিক্রমা। এর স্বপ্নদ্রষ্টা, রূপকার, প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা এমএ মান্নান আজ নেই, যাদের নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল তাদের অনেকেই চলে গেছেন, না ফেরার দেশে। অনেকে অন্য মিডিয়ায়ও কাজ করছেন। আমরাও থাকব না, চলে যাব দুনিয়া ছেড়ে। কিন্তু কাল প্রবাহ অন্তহীন, অপ্রতিরুদ্ধ। সেই কালের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে, যে নীতি-আদর্শের জন্য ইনকিলাব অনন্য, সেই নীতি-আদর্শে অটল- অবিচল থেকে ইনকিলাব দিশারীর ভূমিকা পালন করে যাক, তার চলা পথ কুসুমাস্তীর্ণ হোক, সর্ব শক্তিমান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে ৩১তম প্রতিষ্ঠা দিবসের শুভলগ্নে এই আমাদের মুনাজাত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন