শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শ্রেষ্ঠতম সংস্কৃতিসেবীর রাজনীতি

প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এ. জেড. এম. শামসুল আলম
আল্লামা ইকবালের ন্যায় বিশ্বকবি শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও (১৮৬১-১৯৪১) ছিলেন জাতীয়তাবাদী কবি। দু’জনের জাতীয়তার আদর্শ ছিল সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। ইকবাল মুসলমানদের সাবধান করে দিয়েছেন তাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে। রবীন্দ্রনাথ মুসলমানদের আহ্বান জানিয়েছেন ভারত তীর্থে লীন হয়ে যেতে। ইকবাল কল্পনা করেছিলেন মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি। রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন ছিল এক অখ- রাম-ধর্ম-রাজ্য।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক আদর্শ এবং ভূমিকা আমাদের অনেকের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। কারণ, কবি হিসাবে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এক অসামান্য প্রতিভা। শ্রেষ্ঠতম সংস্কৃতিসেবী। রাজনৈতিক হিসেবে তাকে কখনো মূল্যায়ন করা হয় না। হিন্দু সমাজে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বন্ধাত্ব কখনই মুসলিম সমাজের ন্যায় তেমন প্রকট হয়ে উঠেনি।
সুষ্ঠু বা বলিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব হিন্দুসমাজে হয়নি বলে রবীন্দ্রনাথকে সক্রিয়ভাবে সর্বদা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে হয়নি। কিন্তু জাতীয় জীবনের সন্ধিক্ষণে যখনই ডাক এসেছে, বিশ্বকবি শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ণভাবে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। সাধারণভাবে তিনি সর্বদাই হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
১৮৬৭ সালে হিন্দুমেলার সূচনা হয়। হিন্দুমেলা ১৮৮০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল। এ মেলার উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদের উন্মেষ। অখ- ভারত এবং ভারতীয় মহাজাতি গঠনের লক্ষ্য নিয়ে হিন্দুমেলা শুরু হয়। হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব, হিন্দু জাতীয়তা ও ভাবের উপর বক্তৃতা, আলোচনা এবং জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে গণজাগরণের এক মহান লক্ষ্য হিন্দুমেলার উদ্যোক্তাদের মনে ছিল।
রবীন্দ্রনাথ শৈশবকাল হতেই হিন্দুমেলায় যোগ দিতেন। ১৮৭৫ সালে সর্বপ্রথম রবীন্দ্রনাথের কবিতা “হিন্দুমেলার উপহার” হিন্দুমেলায় পঠিত হয়। পরবর্তী সময়েও তাঁর বিভিন্ন কবিতা হিন্দুমেলায় পঠিত হয়। হিন্দুমেলাতেই হিন্দু জাতীয়তাবাদের বীজ সার্থকভাবে রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ে অঙ্কুরিত হয়। হিন্দুমেলা চলাকালে “স্বাদেশিক সভা” নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঐ প্রতিষ্ঠানের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন।  
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঋষি বঙ্কিক চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাবশিষ্য ছিলেন। বঙ্কিমের জাতীয় আন্দোলনকে তিনি “ভাবের আন্দোলন” বলে আখ্যায়িত করেছেন। রবীন্দ্রমানস বিকাশে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাব ছিল অপরিসীম। ১৮৯৬ সালে কলিকাতায় নিখিল ভারত কংগ্রেসের জাতীয় অধিবেশনকালে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম সঙ্গীত’টি সুর সংযোগ করে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং পরিবেশন করেন।
তখন হতেই রবীন্দ্রনাথের দেয়া সুরে ‘বন্দে মাতরম’ সঙ্গীত গীত হয়ে থাকে এবং কালক্রমে তা ভারতীয় জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা লাভ করে। পূর্ববর্তী বৎসর ১৮৯৫ সালে রবীন্দ্রনাথ নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগদান করেন। সে অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচিত “আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে”-এ সঙ্গীতটি গেয়েছিলেন। কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮৫ সালে অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজ বিসিএস (প্রশাসন) অফিসার এলান অক্টোভিয়াস হিউমের উদ্যোগে।
১৮৯৭ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় নাটোরে। উদ্বোধনী সঙ্গীত হিসেবে গীত হয় রবীন্দ্রনাথের “সোনার বাংলা”। সেই কনফারেন্সে রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে যুবকদল দাবী জানায় যে-সম্মেলনের বক্তৃতা, আলোচনা বাংলা ভাষাতেই করতে হবে। কিন্তু বিজ্ঞ এবং ইংরেজি ভাষায় পটু নেতৃবৃন্দ কিছুতেই বাংলায় আলোচনাতে রাজি হননি। অধিবেশন চলাকালে রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে যুবকদল তুমুল হৈ চৈ শুরু করেন। হট্টগোলের মধ্যে যখন অধিবেশন ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয় তখন সম্মেলনের নেতৃবৃন্দ বাংলায় অধিবেশনের কার্য পরিচালনা করতে সম্মত হন।
১৮৮২ সালে সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনায় ‘সাধনা’ পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। কার্যত এ পত্রিকা সম্পাদনার ভার ছিল রবীন্দ্রনাথের উপর। এ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের তরুণ বয়সের জাতীয়তাবাদী ভাবপূর্ণ বহু প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা প্রকাশিত হয়।
১৮৯৩ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের সভাপতিত্বে “চৈতন্য লাইব্রেরীতে” অনুষ্ঠিত জনসভায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর রাজনৈতিক ভাবপূর্ণ “ইংরেজ ও ভারতবাসী” প্রবন্ধটি পাঠ করেন।
১৮৯৮ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা শহরে। রবীন্দ্রনাথ এ অধিশনে যোগদান করেন এবং দেশীয় ভাব ও স্বার্থের সমর্থনে অনলবর্ষী বক্তৃতা দেন।
১৮৯৮ সালে রাজদ্রোহের অভিযোগে লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক গ্রেপ্তার হন। এর প্রতিবাদে কলিকাতা টাউন হলে যে সভা অনুষ্ঠিত হয় তাতে রবীন্দ্রনাথ “কণ্ঠরোধ” নামে একটি বিপ্লবী প্রবন্ধ পাঠ করেন। তিনি তিলক মামলা পরিচালনার জন্যে গঠিত অর্থসংগ্রহ কমিটিতে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এই সময় বহু রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখে সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন।
বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদিত “বঙ্গদর্শন” পত্রিকাটি কিছুকালের জন্য বন্ধ থাকে। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় “বঙ্গদর্শন” পত্রিকা পুনঃপ্রকাশিত হয়। “বঙ্গদর্শনের” মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ স্বাদেশিকতার মন্ত্র প্রচার করতে থাকেন। এ পত্রিকায় লিখিত প্রবন্ধগুলো জনগণের মনে গভীর রেখাপাত করে। ঐ সময় বিভিন্ন সভায় প্রবন্ধ পাঠ এবং বক্তৃতা করার জন্য রবীন্দ্রনাথ আমন্ত্রিত হতে থাকেন।
রবীন্দ্রনাথ “ভা-ার” এবং “ভারতী” এ দু’টি পত্রিকাও কিছুদিন সম্পাদনা করেন। তার সম্পাদনা কালীন পত্রিকা দু’টির লক্ষ্য ও নীতি ছিল হিন্দু জাতীয় চেতনার উন্মেষ।
“স্বদেশ সেবার পাঠশালা” নামে ‘ডন সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আচার্য সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায়। রবীন্দ্রনাথ “ডন সোসাইটির” কাজে সক্রিয় উৎসাহ প্রদর্শন করতেন এবং  বিভিন্ন বিষয়ে বক্তৃতা করতেন। ঐ সময়ে “সাবিত্রী লাইব্রেরী” নামে একটি স্বদেশী সংগঠন ছিল। আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ সেখানে বক্তৃতা করতেন।
১৯০৪ সালেই রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত “স্বদেশী সমাজ” প্রকাশিত হয়। এ পুস্তিকায় তিনি স্বদেশী সমাজ গঠনের নিজস্ব পরিকল্পনা পেশ করেন। পরবর্তী “স্বদেশী আন্দোলন” এই “স্বদেশী সমাজ” কর্তৃক বেশ প্রভাবিত হয়েছিল।
শিবাজী উৎসব অনুষ্ঠিত হয় কলিকাতায় ১৯০৪ সালে। শিবাজী কর্তৃক মুসলিম রাজত্ব বিলোপ করে স্বাধীন ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্মৃতি তর্পণ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয় “শিবাজী উৎসব”। এ  উৎসবে সভাপতিত্ব করেন মারাঠা নেতা লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক।
কলিকাতা টাউন হলের বিখ্যাত সুধী সভায় রবীন্দ্রনাথ “শিবাজী উৎসব”  কবিতা আবৃত্তি করেন। শিবাজী উৎসব ছিল শিবাজী জীবনের আদর্শ এবং ভারতীয় জাতীয় জীবনের দিকনির্দেশনা স্বরূপ। “শিবাজী উৎসব” কবিতা রবীন্দ্রনাথের জাতীয় আদর্শের এক বলিষ্ঠ প্রকাশ।
পূর্ববাংলার মুসলিমদের দাবীতে ১৬ অক্টোবর, ১৯০৫ খ্রীস্টাব্দে পূর্ববাংলা এবং আসাম নিয়ে এক নতুন প্রদেশ গঠিত হয়। ব্রিটিশ সরকার বার বার মুসলিমদের আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, এ ব্যবস্থা পরিবর্তন হবে না। নতুন প্রদেশ ছিল মুসলিম স্বার্থের অনুকূল। শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর মুসলিমগণ বাংলার হিন্দুদের দ্বারা ছিলেন নির্যাতিত এবং শোষিত। তাই তারা আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবীতে পশ্চিমবঙ্গ হতে আলাদা হতে চেয়েছিলেন।
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বাংলার হিন্দুগণ তুমুল আন্দোলন সৃষ্টি করেন ব্রিটিশ সরকার মুসলিমদিগকে দেয়া আশ্বাস ভুলে গিয়ে হিন্দুদের দাবীর নিকট নতি স্বীকার করেন এবং বঙ্গভঙ্গ রদ করেন (১২ ডিসেম্বর, ১৯১১)।
রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে মরণপণ করে আত্মনিয়োগ করে ছিলেন। ১৯০৫ সালের ২৫ আগস্ট কলিকাতা টাউন হলে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে এক বিরাট জনসভা হয়। রবীন্দ্রনাথ সে জনসভায় তাঁর আবেগপ্রাণ অগ্নিবর্ষী প্রবন্ধ “অবস্থা ও ব্যবস্থা” পাঠ করেন। সভায় জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় সকলে সে প্রবন্ধ পাঠ শুনতে পায়নি বলে এক সপ্তাহ পরে আবার টাউন হলে সভা অনুষ্ঠিত করে উক্ত প্রবন্ধ পুনঃপঠিত হয়।
১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর হতে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়। ঐদিন রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ এবং উদ্যোগে রাখীবন্ধনের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি বৎসর বঙ্গভঙ্গ রদ না হওয়া পর্যন্ত রাখীবন্ধনের উৎসব চালু ছিল। রবীন্দ্রনাথের রচিত “বাংলার মাটি বাংলার জল” গান গেয়ে একজন আর একজনকে রাখী বেঁধে দিতেন।
রবীন্দ্রনাথ নিজে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে যাকেই সামনে পেতেন রাখী বেঁধে দিতেন। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর রবীন্দ্রনাথ চিৎপুরের বড় মসজিদে গিয়ে মুসল্লীদের পর্যন্ত রাখী পরিয়ে দিয়েছিলেন।
১৬ অক্টোবর (১৯০৫ খৃ:) বিকেল বেলা ফেডারেশন হল গ্রাউন্ডে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত জনসভায় সভাপতিত্ব করার জন্য আহুত হন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা আনন্দ মোহন। তাঁকে ইনভ্যালিড চেয়ারে করে সভায় আনা হয়। ইংরেজি ভাষায় লিখিত সভাপতির ভাষণ পাঠ করেন আনন্দমোহন বাবুর পক্ষ হয়ে শ্রী সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ উক্ত বক্তৃতা বাংলায় অনুবাদ করেন।
একই দিন বাগবাজারে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আর একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথের আবেগময়ী বক্তৃতার ফলে উক্ত সভায় “জাতীয় ভা-ারের” জন্য ৫০ হাজার টাকা চাঁদা আদায় হয়। বাগবাজারে কয়েকদিন পর বিজয়া সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তাতেও রবীন্দ্রনাথ বক্তৃতা করেন।
বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনকালে রবীন্দ্রনাথ অসংখ্য সভা সমিতিতে বক্তৃতা করেন। যখনই তাকে কোন সভা সমিতিতে গমনের জন্য আহ্বান করা হত তখনই তিনি সাগ্রহে সাড়া দিতেন। শুধু বক্তৃতা নয়, প্রবন্ধ, কবিতা, গান প্রভৃতির মাধ্যমে তিনি জাতীয় জীবনে এক বিরাট উত্তেজনা সৃষ্টি করে ছিলেন।
ঐ সময়কার অবস্থা সম্বন্ধে নিজেই লিখেছেন, “এখন, ভাবতে আশ্চর্য লাগে। কি নিঃশঙ্ক বেপরোয়াভাবে কাজ করেছি, যা মাথায় ঢুকেছে করে গেছি কোনো ভয়ডর ছিল না ...।”
“বঙ্গভঙ্গ রদ উপলক্ষে ১২ ডিসেম্বর, ১৯১১ সালে অনুষ্ঠিত দিল্লী দরবারে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবার উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ যোগদান করেন।  ব্রিটিশ স¤্রাট পঞ্চম জর্জকে সংবর্ধনার জন্য তার রচিত সঙ্গীত “জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্য বিধাতা” সঙ্গীতটি গীত হয়।
রবীন্দ্রনাথ ১৯০৮ সালে পাবনায় অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কনফারেন্সের অধিবেশনে সভাপতি  হিসাবে যোগদান করেন।
১৯১৬ সালে কলিকাতায় অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে চরমপন্থী এবং মধ্যপন্থীদের ঐক্যে ফাটল ধরে। চরমপন্থীগণ হোমরুল আন্দোলনের প্রবর্তিকা মিসেস অ্যানি বেশান্তকে সভানেত্রী করার পক্ষপাতি ছিলেন। কিন্তু মধ্যপন্থীগণ মিসেস অ্যানি বেশান্তের মনোনয়নের বিরোধিতা করেন। ফলে দুই দলের ভিতর গোলযোগ অনুষ্ঠিত হয়।
মধ্যপন্থীগণ শ্রী বৈকুণ্ঠনাথ সেনকে সভাপতি করে অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করেন। অপর পক্ষে চরমপন্থীগণ রবীন্দ্রনাথকে সভাপতি করে অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করেন। পরে দু’দলের মধ্যে আপোষ হয়। মিসেস অ্যানি বেশান্ত সভানেত্রী মনোনীত হন এবং রবীন্দ্রনাথ ও শ্রী বৈকুণ্ঠ সেনের অনুকূলে  অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতির পদ পরিত্যাগ করেন।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা-
১৩ এপ্রিল, ১৯১৯ সালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আর ই ডায়ারের নির্দেশে অমৃতসরে জালিয়ানওয়ালাবাগে ইংরেজ সৈন্যদের ১৬৫০ রাউন্ড গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “স্যার” উপাধি পরিত্যাগ করেন। নিহত হয় ৩৭৯ জন।
সালাঙ্গা হত্যাকা- ২৮ জানুয়ারি ১৯২২
১৯২২ সালের ২৮ জানুয়ারি, শুক্রবার বঙ্গদেশের পাবনা জেলার সালাঙ্গা হাটে তৎকালীন সিরাজগঞ্জ মহাকুমার এসডি ও শ্রী সুনিল কুমার সিংহ রায় (পিতা লর্ড বিজয় কুমার সিংহ রায়), পাবনার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শ্রী আরএম দাসের উপস্থিতিতে পাবনা জেলার ইংলিশ সুপারেন্টেনডেন্ট বাঙ্গালী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতিতে ৩৯ জন পুলিশকে রাইফেলের গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। হাটের  দিন ভরা হাটে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় সরকারি হিসাব মতে ৪,৫০০।
পাঞ্জাবের অমৃতস্বরের জালিয়ানওয়ালাবাগে ইংরেজ ব্রিগেডিয়ার আরই ভায়ারের নির্দেশে ইংরেজ সৈন্যদের নির্দেশে ৩৭৯ জনের মৃত্যুতে সারা ভারতে তীব্র প্রতিক্রিয়া হলো। বঙ্গদেশের পাবনা জেলা সালাঙ্গা হাটে লর্ড বিজয় কুমার সিংহ রায়ের পুত্র মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট শ্রী সুনিল কুমার সিংহ রায়ের নির্দেশে পুলিশের গুলিতে হাটের দিনে হাটের ৪৫০০ লোকের মৃত্যুতে হিন্দু বা মুসলিম কেউ স্যার বা নবাব, রায় বাহাদুর, বা খান বাহাদুর খেতাব ত্যাগের প্রয়োজন অনুভব করলেন না। হয়ত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার স্বার্থেই সকলে ঘটনাটি যথাসম্ভব চেপে যেতে চেষ্টা করেন।
প্রচারণা ও আন্দোলনের শক্তি এমন যে তিলকেও তাল করা যায় এবং চোখে আঙ্গুল দিয়ে রাখলে হিমালয় পাহাড়ও অদৃশ্য হয়ে যায়।
১৯৩১ সালে হিজলী বন্দিশালায় গুলি চালনার প্রতিবাদে ভীষণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। কলিকাতা টাউন হলে হিজলী জেলে গুলি চালনার প্রতিবাদে সভা অনুষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ উক্ত সভায় সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। সভায় অতিরিক্ত জনসমাগমের ফলে গড়ের মাঠে সভার স্থান পরিবর্তিত হয়।
জনসংখ্যানুসারে বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিশীল সংস্থায় আসন পাওয়ার জন্য ভারতীয় মুসলমানদের দীর্ঘকালীন দাবীর ফলে প্রদত্ত সাম্প্রদায়িক (আসন) বাটোয়ারার প্রতিবাদে মহাত্মা গান্ধী আমরণ অনশন ধর্মঘট করেন। রবীন্দ্রনাথ পুনায় যাবেদা জেলে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাকে অনশন ভঙ্গ করতে অনুরোধ জানান। মহাত্মা গান্ধী রবীন্দ্রনাথের সম্মানেই অনশন পরিত্যাগ করেন।
রবীন্দ্রনাথ “সাম্প্রদায়িক (জনপ্রতিনিধিত্বশীল আসন) বাটোয়ারা” বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তিনি শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও ১৯৩৬ সালে কলিকাতা টাউন হলে অনুষ্ঠিত সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারাবিরোধী জনসভায় সভাপতিত্ব করতে সম্মত হন। কবির ব্যক্তিগত চিকিৎসক স্যার নীল রতন সরকার কবি যাতে সভার মধ্যে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পেতে পারেন তার ব্যবস্থা করেন। হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সহায়তা করার জন্য যখনই আহ্বান এসেছে ক্ষীণ স্বাস্থ্য, বার্ধক্য বা অপর কোনো অজুহাতে রবীন্দ্রনাথ কখনো সে আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেননি।
লেখক: সাবেক সচিব, গবেষক
 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন