শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ছেলে ভুলানো গান দিয়ে ঘুম পাড়ান সম্ভব নয়

প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আবদুল আউয়াল ঠাকুর
জাতীয় সংস্কৃতিই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি দেশকে তুলে ধরে। একটি দেশ কতটা সভ্য বা তাদের সভ্যতা কতটা পুরনো তা বোঝা যায় তাদের সংস্কৃতি থেকে। অনেক দিন আগে শিল্পকলা একাডেমিতে চীনের সংস্কৃতির উপর এটি অনুষ্ঠান দেখছিলাম। সেখানে তারা অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে তাদের নিজস্ব শারীরিক কসরত দেখিয়েছিল। চমৎকার ও মনোমুগ্ধকর অনুষ্ঠানটি চলার এক পর্যায়ে ঘোষক জানালেন, এখন যে প্রদর্শনী দেখান হবে সেটি চার হাজার বছরের পুরনো। সেই সাথে তিনি আরো জানালেন, আমরা চীনের প্রাচীন সংস্কৃতিকে অবিকৃতরূপেই তুলে ধরছি। কথা খুব ছোট তবে এর ব্যপ্তি বিস্তৃতি অনেক বেশি। এ কথা থেকে বুঝতে কারো অসুবিধা হবার নয় চীনের সভ্যতা চার হাজার বছরের পুরনো। চীনের লিখিত সংবিধানের বয়সও চার হাজার বছরের বেশি সময়ের। চার হাজার বছরের পুরনো প্রদর্শনী আর নব কলা কৌশলের প্রদর্শনীর মধ্যে যে বিস্তর ব্যবধান সেটাও অত্যন্ত পরিষ্কার। তা সত্ত্বেও দুটোই ছিল সমভাবে উপভোগ্য। বিশেষ করে চার হাজার বছর আগে চীন কি রকম ছিল তার একটা ধারণা ঐ প্রদর্শনীতেও পাওয়া সম্ভব। যারা চীনের লিখিত ইতিহাস বা চীনা সমাজের পরিবর্তনের সাথে সম্যক পরিচিত নন তাদের কাছেও এ প্রদর্শনী দেখার পর সে সময়ের চীনা সমাজ সম্পর্কে এক ধরনের ধারণা জন্মাবে। শুধু চীন নয় বোধকরি প্রাচীন সভ্য দেশগুলোর অনেক দেশেই এ ধরনের রেওয়াজ রয়েছে। বাংলাদেশস্থ ইরানী কালচারাল সেন্টারের দাওয়াতে তাদের নওরোজ অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছিলাম মাত্র কদিন আগে। সেখানেও ইরানী প্রতিনিধি সুন্দর করে তুলে ধরলেন নওরোজের ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত ও প্রেক্ষাপট। তিনি জানালেন তিন হাজার বছর ধরে এটি পালিত হচ্ছে। যদিও নওরোজের ইতিহাস আরো পুরনো। এ নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে সেটি আজকের বিষয় নয়। প্রাচীন ঐতিহ্য তুলে ধরার অনেক উদাহরণ দেয়া সম্ভব। একটি দেশ কতটা সমৃদ্ধ, ঐতিহ্যবান তা বোঝা যায় তাদের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিটি দেশের দূতাবাসই বিদেশে নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। আন্তর্জাতিক মহল এভাবেই পরস্পরের সাথে পরিচিত হয়। আধুনিক বিশ্বে সাংস্কৃতিক কর্মকা- হিসেবে চলচ্চিত্র, টেলিফিল্ম, নাটকও প্রদর্শিত হয়। এগুলোও সময়ের চিত্র। এ থেকেও প্রতিটি সমাজের মন-মানসিকতার চিত্র উঠে আসে।
রাষ্ট্রীয় সফরে পাকিস্তান যাবার পর সেখানে আমাদের সৌজন্যে যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছিল তার একটি বড় অংশ ছিল বাংলাদেশের জনপ্রিয় বাংলাগান। আয়োজকদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তোমরা বাংলা গান শোনালে কেন? ওরা উত্তর দিল তোমাদের সম্মানে। এছাড়া এগুলো আমাদের এখানেও সমান জনপ্রিয়। এ কথার হয়ত যুক্তি আছে এ কারণে যে একসময় দুটো অংশ মিলেই পাকিস্তান ছিল। সে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ। সেদিকে যাব না। বলছিলাম সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ নিয়ে। সংস্কৃতির সংজ্ঞা নিয়ে যত মতভেদই থাক এটি যে প্রতিটি দেশের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা মেধা-মননের প্রতিবিম্ব বোধ করি এ নিয়ে কোন মতপার্থক্য থাকার সুযোগ নেই। সাধারণত জাতীয় উৎসব ও ধর্মীয় উৎসবের মধ্য দিয়ে জাতীয় সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে। আমাদের জাতীয় উৎসব এবং ধর্মীয় উৎসবগুলো মোটামুটি স্থির। এসব অনুষ্ঠানগুলোতে ঐতিহাসিক কাল থেকেই দেশের সকল শ্রেণির মানুষ তাদের মতো করেই অংশ নিচ্ছে, আনন্দ করছে। বোধকরি এ নিয়ে বড় ধরনের কোন মতপার্থক্য নেই। এসব দিনগুলোতে কে কি করবে কে কিভাবে পালন করবে সেটিও মোটামুটি নির্ধারিত রয়েছে। আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ। আমাদের জাতীয় ভাষা বাংলা। আমাদের একটি নববর্ষও রয়েছে। এই ভাষার লড়াইয়ের দিনটি জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর সঙ্গতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির একটি আন্তর্জাতিক  স্বীকৃতির প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। বাংলাভাষার ইতিহাস বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিচিতির চেয়েও অনেক পুরনো। গবেষকগণ ষষ্ঠ শতক আর দ্বাদশ শতক যাই বলুন না কেন ভাষার প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ নেপালের রাজ দরবারে পাওয়ার মধ্য দিয়ে মূলত ভাষা হিসেবে বাংলা টিকে থাকার ঐতিহাসিক সংগ্রামের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। কি ঘটেছিল সে সময়ে যে কারণে আদি বাংলা ভাষাভাষি আমাদের পূর্বপুরুষদের কাউকে কাউকে এ অঞ্চল ছেড়ে নেপালে যেতে হয়েছিল? ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় খ্রিষ্টপূর্ব সাত শতকের শেষ বা ছয় শতকের প্রথম দিকে  প্রাচুর্য সন্ধানী  ব্রাহ্মণরা নদী পার হয়ে উত্তর-পূর্ব দক্ষিণ এশিয়ার কুশাল ও মগধের রাজদরবারে অনুপ্রবেশ শুরু করেছিল। নিজেদের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তারা আন্তঃরাষ্ট্রীয়  বিবাদ-সংঘাত  সৃষ্টিতে  অপতৎপর হয়ে ওঠে। এরই ঘাত-প্রতিঘাতে বৌদ্ধ ধর্ম মূলবাসী  গণমানুষের প্রতিরোধের প্রধানতম মাধ্যমে পরিণত হয়ে উঠেছিল। ইতিহাসের নানা চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিয়ে খ্রিষ্টীয় চার শতকে মগধে ব্রাহ্মণ্যবাদী গুপ্ত সা¤্রাজ্যের উদ্ভবের মধ্য দিয়ে উত্তর ভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদ দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছিল। সরাসরি গুপ্ত শাসনাধীন আজকের পশ্চিমবাংলায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ব্যাপকভাবে পরিহার ভূমিদান পদ্ধতির মাধ্যমে চিরস্থায়ী সার্বভৌমত্ব দিয়ে ব্রাহ্মণ বসতি স্থাপন করা হয়েছিল। করদ রাজ্য হওয়ায় আজকের বাংলাদেশ অনেকটাই ব্রাহ্মণমুক্ত থেকে যায়। স¤্রাট হর্ষবর্ধনের হত্যা ও তার মন্ত্রী অর্জুনের ক্ষমতা দখলের পর সারা উত্তর ভারতে ব্যাপকহারে বৌদ্ধ নিধন করা হয়। ফলে বৌদ্ধরা রাজনৈতিকভাবে রীতিমত নগণ্য হয়ে পড়ে। গোপাল ও তার বংশধরদের সামনে রেখে ব্রাহ্মণ মন্ত্রী অমাত্য শাসনের সাড়ে তিনশ বছর এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন বংশের  অনুর্ধ্ব শ‘বছরের শাসনামলে পশ্চিমবাংলা ও বাংলাদেশের বৌদ্ধ সমাজকে সুপরিকল্পিতভাবে  ধবংসের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল বৌদ্ধ অনুসারি জনগণের  আর্থিক মেরুদ- ভেঙে দেয়া এবং তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য মুছে ফেলা। সুতরাং সহজেই অনুমেয় কেন এবং কি কারণে কেবলমাত্র নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা এবং নিজেদের ভাষা রক্ষার তাাগিদেই তাদের কাউকে কাউকে দেশ জন্মভূমি ছেড়ে সুদূর নেপালে আশ্রয় নিতে হয়েছিল।
যারা পালিয়ে বেঁচে ছিলেন তাদের কারণেই হয়ত আজকের বাংলাভাষার ইতিহাস ঐতিহ্য তথা শেকড়  খুঁজে পাওয়া গেছে। ঠিক যেভাবে তারা বেঁচে থাকার ও ভাষার প্রতিষ্ঠার লড়াই করেছিলেন তেমনিভাবেই হয়ত ভাষার প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদা রক্ষার লড়াই হয়েছিল ৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারি। এই মহান ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ এবং ভাষা সৈনিকদের লোভ-লালসা বিবর্জিত আন্দোলনের প্রতিফলই হচ্ছে আজকের বাংলাদেশ। এই যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলো এটিকে যদি এক বাক্যে বলা যায় যে আমরা ৭১সালে পাক সামরিক জান্তার বর্বরতম ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিরোধ গড়ে তুলেই নয় মাসের স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বাধীন হয়েছি তাতে পুরোটা বলা হবে না। পুরোটা হচ্ছে সেই পূর্বপুরুষদের কথা যারা এক সময়ে ব্রাহ্মণ্যবাদ তথা বর্ণবাদের নির্যাতনে পড়ে ধর্মীয় আস্থাহীনতার সংকটে নিপতিত হয়ে ইসলামের সাম্যবাদে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারা মুগ্ধ হয়েছিলেন ইসলামের প্রচারকদের আচার-আচরণ ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে। এই যে পরিচয় এটাই আসল কথা। এখানেই মূল  প্রোথিত। জাতির ভেতরগত আত্ম পরিচয়। সংস্কৃতির মূল বীজ এখানেই নিহিত। বোধকরি আমাদের জাতীয় জীবনে এই চেতনাসমৃদ্ধ বোধ বিশ্বাস যারা তুলে ধরতে পেরেছেন তারাই সফল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। আমাদের সংস্কৃতি ভাববাদী না বস্তুবাদী এনিয়ে যে বিতর্কই থাক আমাদের সংস্কৃতিতে ধর্মীয় প্রভাব নিয়ে কোন বিতর্ক নেই বলেই মরমী ভাটিয়ালি এ দেশে এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয় সংগীত। আধুনিক যুগেও মনমাঝি  বা দেহঘড়ির গান যে মানুষকে আন্দোলিত করছে সে তো প্রোথিত মূল চেতনার জন্যই। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি আমাদের জাতীয় জীবনে সংস্কৃতির মূল সুর আজ উপেক্ষিত। যে সংস্কৃতিকে আমাদের কোন কোন মহল নিজেদের বা জাতীয় বলে পরিচিত করাতে চাচ্ছে তার সাথে নাড়ীর কোন সম্পর্ক নেই। নেই বলেই এসব প্রত্যাখ্যাত হয়েছে হচ্ছে। সং¯ৃ‹ৃতি চেতনা ও লালনের এই আলোচনার মূলে রয়েছে এবারের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের প্রসঙ্গ। অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে বৃহন্নলা নামক একটি চলচ্চিত্রকে জাতীয় পুরস্কার দেয়ার পর ভারতীয় গল্প চুরির অভিযোগে পুরস্কার প্রত্যাহার করা হয়েছে। এটা ভাবা যায় যে দেশের হাজার বছরে সোনালী ঐতিহ্য সমৃদ্ধ নিজস্ব সমৃদ্ধ সংস্কৃতি রয়েছে তারা কিনা কাহিনী চুরি করে সোনালী ঐতিহ্যকে পান্ডুর বর্ণ করে দিয়েছে। ম্লান করে দিয়েছে জাতীয় ঐতিহ্য। বিশ্ব দরবারে নিজেদের চোর বলে পরিচিত করিয়েছে। গভীর পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এই চোরাই কাহিনীর পুরস্কার আগে কেউ ধরতে পারলেন না। এমনকি শ্রেষ্ঠ চলচিত্র বাছাইয়ের তালিকাভুক্ত হবার সময়ও কেউ  এটা শনাক্ত করতে ব্যর্থ হলেন। তাহলে বিচারকদের দায়িত্ব কি ছিল? তারা কী দেখেছেন? নাকি তাদের এটা বোঝার  মতো মেধা-মনন ছিল না। ভাবা যায় এটি কত বড় জাতীয় ব্যর্থতা এবং লজ্জাকর। প্রতিবছর বাংলা একাডেমির বই মেলায় লাখ লাখ টাকার বই বিক্রি হচ্ছে। নামের সাথে লেখক কবি সাহিত্যিক ড. সমৃদ্ধদের কোন অভাব না থাকলেও একটি সিনেমা বানাবার মত গল্প দেশে খুঁজে না পাবার বিষয়টাও সত্যিই বিস্ময়কর। সংকট কোথায়? চিন্তায় না পরিচর্চায়। এটা বহুবার বলা হয়েছে দেশে মৌলিক রচনার অভাব রয়েছে। এটাও অনেকটা ওপেন সিক্রেট যে অনেক ক্ষেত্রেই ইংরেজি থেকে হিন্দী, হিন্দী থেকে প্রথমে পশ্চিমবাংলায় ও পরে নাম, ধাম, পাত্র বদলিয়ে তা এদেশে কোন কোন লেখকের বলে পরিচিতি পাচ্ছে। একটি সমাজ বিনির্মাণে লেখক বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাদেরকেই সমাজের মাথা বলে বিবেচনা করা হয়। একটি সমাজে বুদ্ধিজীবীদের বিকাশে সরকার ও বিত্তবানদের কার্যকর ভূমিকা রাখার কথা স্বীকৃত। এক সময়ে দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় যে উৎসাহ প্রদান করতো তা এখন নেই বললেই চলে। মনে করা হয় সরকারের কোন কোন মহলকে তথাকথিত সহায়তার নামে যে পরিমাণ চাঁদা দিতে হয় তারপর আর অন্য কোন সহায়তা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পাবার ক্ষেত্রে যে ধরনের কাঠ-খড় পোড়াতে হয় সে অনেক বড় ব্যাপার। মূল জাতীয় ঐতিহ্য লালনে  যে ধরনের সরকার দরকার তার অনুপস্থিতিতে এটা কোন অবস্থাতেই সম্ভব নয়। শিল্প, সাহিত্য চর্চায় দলীয় আনুগত্য কোন বিষয় হবার কথা নয়। বাস্তবে সেটাই যে হচ্ছে তার প্রমাণ বৃহন্নলা। অনেকদিন থেকেই এটি এটিএন বাংলার দেয়ালে ঠাঁই পেয়েছিল। শুরু থেকেই দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, যে দেশের মানুষ রক্ত দিয়ে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছে সেই দেশে হিন্দী বর্ণমালার আদলে বাংলা বর্ণমালা লিখে রাখার সাহস কোত্থেকে আসে? বিষয়টি প্রকৃত বিবেচনায় নতুন নয়। বছর কয়েক আগে পশ্চিমবাংলা সফর করতে গিয়ে দেখেছি সেখানকার মানুষের জীবনাচারে বাংলা অনেকটাই উধাও। সেখানকার বাঙালীরা সহজে বাংলা বলেন না। তাদের দোকানপাটগুলোতে যেসব সাইনবোর্ড রয়েছে তার অধিকাংশই এভাবে হিন্দী হরফের আদলে বাংলা লিখা। পশ্চিমবাংলার অনেক বিদগ্ধজনের একান্ত আলোচনাতেও এনিয়ে ক্ষোভ শুনেছি। কার্যত সেখানে যে হিন্দী আগ্রাসন চলছে সেটাই সব কিছু খেয়ে ফেলেছে। বাংলাভাষার কবি রবীন্দ্রনাথের রচিত গান ভারতে জাতীয় সংগীত হলেও বাংলার কোন মর্যাদা নেই। হিন্দী ভাষায় কোন নববর্ষও নেই। ভাষা হিসেবে হিন্দীর আলোচনা মূখ্য নয়। বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, অন্য ভাষায় মায়ের ভাষার বর্ণ বিবর্ণ করার বিষয়টি এসিড নিক্ষেপের চেয়ে বা ইভটিজিংএর চেয়ে কী কোন অংশে কম অপরাধ। বোধকরি নিজের জন্মের উপর আত্মবিশ্বাস থাকলে এ ধরনের অপকর্ম করতে কেউ সাহস পেত না। ঘটনা অনেক দিনের হলেও এ ধরনের ঘটনা অপরাধ কিনা সেটা দেখা যাদের দায়িত্ব তাদের মুখ থেকে এখনও কিছু শোনা যায়নি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যিনি রয়েছেন এক সময়ে তিনি নন্দিত নাট্যাভিনেতা ছিলেন। এ দায়িত্ব থেকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কিভাবে নিজেকে আড়াল করছে সেটাও বোঝা কষ্টকর। সাধারণত এ ধরনের পুরস্কার প্রধানমন্ত্রী দিয়ে থাকেন। হয়ত এক্ষেত্রেও তার কোন ব্যত্যয় ঘটেনি। সাধারণত প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের জাতীয় পুরস্কার হাতে তুলে দেয়ার আগে তাদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময়ও করেন। এ ক্ষেত্রেও হয়ত তার ব্যতিক্রম হয়নি। বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীকে স্বীকৃত চোরের সাথে যারা জাতীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচয় করিয়ে দিলেন তারা কারা? এতে জাতীয় ইমেজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে একবারও সংশ্লিষ্টরা ভেবে দেখেছেন। এর আগে মুক্তিযুদ্ধের ক্রেস্টের সোনা-রুপার চুরির ঘটনা ঘটেছিল। তারও কোন বিচার হয়েছে বলা যাবে না। দেশের যেসব ব্যক্তি কথায় কথায় গেল গেল বলে চিৎকার করেন বাঙালীত্ব রক্ষার জন্য প্রাণপাত করেন তারাই বা এসব নিয়ে কিছু বলছেন না কেন? এসব থেকে মনে হতে পারে অলোচ্য চোর বা চোরের দল অনেক বেশি প্রভাবশালী। অপরাধ এককভাবে নয় বরং হয়ত সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। জাতি এসব চোরদের চিনতে পারল না। এখানেই রাজনীতির প্রসঙ্গ বড় হয়ে দেখা দেয়।
প্রকৃতপক্ষেই জাতি যে গভীর রাজনৈতিক সংকটে রয়েছে বোধকরি সেটাই প্রমাণিত হয়েছে চোরদের পুরস্কৃত করার নজিরবিহীন ঘটনার মধ্য দিয়ে। এটি জাতীয় লজ্জা। রাজনীতিই হচ্ছে সমাজের মূল নিয়ামক শক্তি। আজ সমাজ থেকে রাজনীতি বিদূরিত। সমাজে মানুষের সাধারণ অধিকারও স্বীকৃত নয়। সংস্কৃতি হচ্ছে সুস্থতার প্রতীক।চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে মূলত অসুস্থতা ও দেউলিয়াপনারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। সেই সাথে এক ধরনের পদলেহি মানসিকতার চিত্রও ফুটে উঠেছে। এটি কোন বিবেচনাতেই স্বাধীন চিন্তা-চেতনা, মন-মানসিকতার অনুরূপ নয়। আমরা যে পুনরায়  পদানত হয়েছি বা হতে যাচ্ছি হয়ত বৃহন্নলা তারই প্রতীক রূপে উঠে এসেছে। সে বিবেচনায় সতর্ক হবার এখনই সময়। জাতীয় স্বাধীনতা জাতীয় সংস্কৃতি রক্ষায় এখনই সময় ঐক্যবদ্ধ হবার। যাদের বোধোদয় হওয়া প্রয়োজন তারা যদি জেগে ওঠেন বা ওঠার প্রক্রিয়ায় থাকেন তাহলেই অপশাসন, আগ্রাসন মোকাবিলা করে জাতীয় সংস্কৃতি রক্ষা করা সম্ভব।
এক সময়ে বর্গী আক্রমণের ভয় দেখিয়ে বাংলার শিশুদের মায়েরা ঘুম পাড়াত। এই বর্গী আক্রমণে সূত্র ধরেই বাংলার স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়েছিল। বিদেশি বণিকেরা এ দেশ দখল করে নিয়েছিল। এখন নতুন জুজুর ভয় দেখা দিয়েছে। তথাকথিত সাম্প্রদায়িকতার কথা বলে বিজাতীয় সংস্কৃতি ভর করছে আমাদের ঘাড়ে। নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষা করতে হলে অবশ্যই স্বকীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি রক্ষা করতে হবে। কার্যত সে কথারই জানান দেয় ইনকিলাব।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিষ্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন