শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভালোবাসার আলো

প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ফরিদা হোসেন
জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়েছিল আশকার। সবুজ লনে সোনাগলা রোদের ছড়াছড়ি। পড়ন্ত বেলা।
বিষণœ উদাসী বাতাস থেকে থেকে ঘুরে যাচ্ছিল এধার ওধার দিয়ে।
টেবিলে রাখা ফুলের ঝাড় থেকে ভেসে আসছে বিহ্বল সুবাস। নিশ্চুপ মুহূর্ত।
দরজায় ভারী পর্দা ঝুলছে। প্রজাপতিদের অভিসার। ফুলের ওপর ওদের থরথর কম্পন, এই সব কিছুর মধ্যে সমাহিত হয়ে যেতে পারলেÑঅন্তত তাহলেও অন্তর্জ¡ালা থেকে একটু মুক্তি পেতো আশকার।
কিন্তু কে ওকে বলে দেবে মুক্তির ঠিকানা! কে দেবে শান্তির আশ্বাস! কে ওকে বাঁচাবে এই দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে!
: আশকারÑ
ক্লিনিকের একটি বিশেষ কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকলো জাফর।
আশকার যেন দিগন্তের ওপারে। ওপরে মনে হলো অনেক দূর থেকে একটা পরিচিত ডাক ভেসে আসছে। অথচ কিছুতেই যেন মনে করতে পারছে না।
কবে যেনÑকে যেন এমন একটা নাম ধরে ওকে ডাকতো।
: আশকার।
আবার ডাকলো জাফর। এবার ধীরে ধীরে ঘাড় ফেরালো আশকার।
তাকালো দরজার দিকে। অস্ফুট কণ্ঠে বললÑ
: জাফর। একটু হাসতে চেষ্টা করলো আশকার। জাফর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ওর পাশে বসলো।
বললÑ
: রাতে রেডিওতে খবরটা শোনে আমি পাগল হয়ে গেছি রিয়েলি।
আশকার আবার বাইরের দিকে তাকালো।
লালচে রোদের স্পর্শ ওর মুখের ফরসা রঙকে আরও রক্তিম করে তুললো।
জাফর শুধু স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলো আশকারের অদ্ভুত চোখ দু’টোর দিকে।
এক সময় বললÑ
: আসতে অনেক দেরী হয়ে গেল, কি করব, শর্মিলাকে কিছুতেই সামলাতে পারছিলাম না।
আশকারের গলার কাছে কিছু যেন একটা আটকে গেল।
জাফর এ প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না। ওর নীরবতা যেন আশকারের প্রশ্নের জবাব এনে দিল। কারণটা যেন বুঝতে পারলো আশকার।
আজকের দৈনিকটা পাশের টেবিলে।
স্পষ্টাক্ষরে জ্বলজ্বল করছে প্রথম পৃষ্ঠার হেডিংটাÑ‘তরুণ সাহিত্যিক আশকার চৌধুরীর রাষ্ট্রীয় পুরস্কার লাভ’।
আশকারের আত্মীয়, বন্ধু বা গুণ গ্রাহীদের আজ কাঁদবার কথা নয়Ñ হাসবার কথা। আনন্দের কথা।
আশকারের অগণিত গুণমুগ্ধ পাঠক-পাঠিকাদের আজ ভারী খুশীর দিন।
সকাল থেকে আসতে শুরু করেছে অনেক টেলিফোন আর শুভেচ্ছা বাণী।
এসেছে রাশিকৃত ফুলের উপহার। চাঞ্চল্য এসেছে হাসপাতালের নিষ্প্রাণ জীবনে। এসেছে ব্যতিক্রম।
কিন্তু কারো সাথেই দেখা করেনি আশকার। জানিয়েছে অসুখের বাড়াবাড়ি।
সাড়া পড়ে গেছে সারা বাংলাদেশে। এরকম মর্মস্পর্শী উপন্যাস যেন কখনোই রচিত হয়নি আগে।
লেখক আশকার যেন কোন মানুষ নয়। ও যেন এক অদৃশ্য যাদুকর। ওর অদৃশ্য যাদু কাঠির ইশারায় যেন রচিত হয়েছে এক দুর্লভ কাহিনী।
উপন্যাসটির নাম “অবগুণ্ঠন”। লেখাটি শেষ করার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আশকার নিজেও কল্পনা করতে পারেনি। বুঝতে পারেনি নিজের মনকে।
বুঝতে পারলো তখন দ্বিতীয়বার পা-ুলিপিটি পড়া শেষ হলে।
নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করে ভীষণভাবে চমকে উঠলো আশকার।
পৃথিবীর আর কেউ না জানুক, শর্মিলা আর জাফর জানে কে এই অবগুণ্ঠনবর্তী।
নার্স এলো আরো একগাদা ফুলের ঝাড় নিয়ে বললোÑ
: পত্রিকা থেকে কয়েকজন রিপোর্টার এসেছেন। তারা কি ভেতরে আসবেন?
হঠাৎ দু’হাতে নিজের অবিন্যস্ত চুলগুলোকে মুঠি করে ধরলো আশকার।
অস্থির কণ্ঠে বললÑ
: প্লীজ সিস্টার প্লীজ। লীভ মি এলোন। রিপোর্টারদের বলুন আমার মৃত্যুর পর যেÑ
: আশকার।
আশকারের কাঁধে হাত রাখলো জাফর। আর অমনি মন্ত্র মুগ্ধের মতো শান্ত হয়ে পড়লো আশকার।
একটা দীর্র্ঘশ্বাস চাপতে চাপতে শুধু বললোÑ
: আমার বড় কষ্ট জাফর।
: জানি ভাই, আর-আর সে কথাই আজ শর্মিলাকে বলছিলাম।
: শর্মিলাকে!
জাফর বললÑ
: আর কাকেই বা বলব, বল! কাকেই বা বলা যায়!
গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে কুমিল্লায় এসে “অজন্তায়” উঠেছিল আশকার।
উঠেছিল জাফরেরই অনুরোধে।
ভার্সিটি বন্ধ। নতুন একটা লেখা শুরু করার প্রস্তুতিও চলছিল। এরই মধ্যে কিছুটা প্রশান্তির জন্যেই বন্ধুর কথা ফেলতে পারলো না আশকার।
ওদের বাড়ির “অজন্তা” নামটা ভালো লেগেছিল আশকারের। অদ্ভুত সব কারুকার্য করা আর লতা-পাতায় ঘেরা  ছিল বাড়িটা। একটু নিরিবিলি বলেই নতুন জায়গাটা ভালো লেগেছিল আশকারের।
ওকে মুগ্ধ করেছিল এখানকার কাব্যিক পরিবেশ।
সন্ধ্যার অন্ধকারে লনে একা বসেছিল আশকার জাফরের অপেক্ষায়।
কাছেই এক অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে গেছে জাফর কিছুক্ষণ হলো।
ভালোই লাগছিল একা নির্জনে বসে থাকতে। প্রশস্ত লনের চারদিকে নারকেল আর সুপারী গাছের ছায়া ছায়া রহস্যময় অবস্থান। মাথার ওপরে মেঘময় আকাশ। কেমন যেন উদাস আর বিষণœ করে দিয়েছিল ওর মনটাকে। ইজি চেয়ারে এলানো আশকারের চোখ দু’টো যেন বুজে আসছিল নীরবতার আমেজে।
এমনি সময় অজন্তায় দক্ষিণের ঘর থেকে ভেসে এলো বীণার ঈষৎ ঝংকার।
চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলো আশকার।
বীণার তারে তখনো আলাপ চলছে। ভীষণ অবাক হলো আশকার। স্পষ্ট বুঝতে পারছে না কোন দিক থেকে আসছে এই সুরের ঝংকার।
আশেপাশে লাগোয়া কোন বাড়ি নেই।
প্রায় সবগুলোই দূরে দূরে। আলো জ্বলছে অজন্তার দক্ষিণের কোণের ঘরটায়। বাতাসে কাঁপছে ভারী পর্দা।
রাগ-রাগিণীর সাথে আশকারের পরিচয় নেই।
কিন্তু তবু ওর মনে হলো এই নিশি রাত, থেকে থেকে বয়ে যাওয়া, হাওয়া...মেঘময় আকাশÑসবকিছুর সাথে যেন মিশে একাকার হয়ে গেছে ওই ক্রন্দসী সুর।
লন ছেড়ে বারান্দায় উঠে এলো আশকার আপন মনে।
আগের চেয়ে আরো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে এবার।
কিন্তু এ কেমন সুর?
আসলেই কি কোন যন্ত্রের সুর? নাকি কেউ কাঁদছে নিজের বুকটাকে রক্তাক্ত করে!
কেমন করে পারে মানুষ?
জাফর এসে কখন ওর পাশে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি আশকার।
যখন সম্বিৎ ফিরে পেল তখন অনেকখানি সময় পেরিয়ে গেছে।
জাফর একটু হাসলো আশকারের ভাব দেখে।
বললÑ
: শর্মিলা Ñ আমার বোন বাজাচ্ছে। আশকার নির্বাক।
জাফর বললÑ
: চল ভেতরে চল।
: না। এখানেই বেশ লাগছে বললো জাফরও।
বীণার সুর তখনো কেঁদে চলেছে আপন ভঙ্গিতে।
আশকার একসময় বললÑ
: সত্যি অপূর্ব! আমি এ রকম আগে কখনো শুনিনি। কেমন করে মানুষ পারে এমন সুর সৃষ্টি করতে?
একসময় বীণার ঝংকার থামলো।
আশকার যেন তখনো পার্থিব সত্তাহীন। ও যেন এই লোকালয়ের কেউ নয়।
জাফর ওকে চেনে। এক সময় বললÑ
: খেতে চল। রাত অনেক হয়েছে। নিঃশব্দে উঠলো আশকার। এরপর থেকে প্রতি সন্ধ্যায় বীণার কান্না শোনা যেন নেশা হয়ে দাঁড়ালো আশকারের।
অনেকগুলো তরঙ্গায়িত মুহূর্তÑবহুক্ষণ ধরে চলতো সেই করুণ রাগ-রাগিণীর আলাপ।
অবাক হয়েছে আশকার। জাফর জানে ও বীণা ভালোবাসে। অথচ বীণার সেই বাদকের সাথে আজো পরিচয় হয়নি আশকারের।
কিন্তু এমন তো হবার কথা নয়। জাফর কি তবে ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে।
আশকারের ছুটি প্রায় ফুরিয়ে এসেছে।
ওর ভেতরটা ছটফট করতে লাগলো কাউকে দেখার জন্যে। প্রতি সন্ধ্যায় ভাবে হয়তো আজ ওকে অন্দরে নিয়ে যাবে জাফর।
কিন্তু না। জাফর যেন একেবারেই নির্বিকার।
শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে উঠলো আশকার। তখন রাত।
অজন্তার দক্ষিণের ঘর থেকে ভেসে আসা বীণার ঝংকার সুর যেন চিরে চিরে এগুচ্ছে রাত্রির নীরবতাকে টুকরো টুকরো করে।
ইজি চেয়ারে বসেছিল দু’জনেই। হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো আশকার। বললÑ
শর্মিলাকে দেখাবি না?
চমকে উঠলো জাফর।
একটু যেন ভাবলো। তারপর বললÑ
ও কারো সামনেই বেরোয় না। অত্যন্ত ঘরকুনো হয়ে পড়েছে শর্মিলা আজকাল।
কথাগুলো বলে আশকারের দিকে যেন হাসতে চেষ্টা করলো জাফর।
: ও Ñ
আশকার যেন একটু হতাশ হলো। ওর আরো আগেই বোঝা উচিত ছিল যে বেরুবার হলে আগেইÑ
জাফর আশকারের কাঁধে হাত রাখলো।
: কিছু মনে করিসনে ভাই। ও একটু ওরকমই।
আশকার একটু হাসবার মতো মুখ করে বললÑ
: না না এতে মন খারাপ করার কি আছে?
কিন্তু আশকারকে দেখলো শর্মিলা।
দেখলো খুব ভোরে লনের ডানপাশের রাধাচুড়ার নিচে পায়চারি করতে।
একরাশ অবিন্যস্ত চুলের অরণ্যে দ্রুত আঙ্গুল চালিয়েছিল আশকার পায়চারী করতে করতে।
দৃঢ় ঋজু দেহÑ পায়চারীর ওই ভঙ্গিÑঘাড়ের পেছন দিক থেকে মুখের একাংশ।
যতোটুকুনই দেখলো, সেই দেখাতেই যেন বুকের ভেতরটা ওর কেমন করে উঠলো।
ভয় পেলো শর্মিলা।
ভেতর থেকে কি একটা প্রচ- ঢেউ এসে যেন আছড়ে ফেলে দেবে ওকে।
পাগলের মতো সশব্দে জানালা বন্ধ করে দিল শর্মিলা। আর তার পরেই ছেলে মানুষের মতো হু-হু করে কেঁদে ফেললো ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে।
ওর চোখের উত্তপ্ত পানিতে প্লাবিত হলো কপোল দু’টো।
দু’চোখ ভরে দেখলো শর্মিলা।
দেখলো আর কাঁদলো অক্লান্ত।
কোথায় যেন বাঁশী বাজছে।
কতো দূরে কে জানে?
এখন ভোর না হয়ে যদি রাত হতোÑ নিঝুম রাত... ভৈরবী বাঁশী না হয়ে ওই সুর যদি বীণার বেহাগ কিংবা মালকোষ হতো তাহলে যেন ভীষণ ভালো লাগতে শর্মিলার।
অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে আরো আকুল হয়ে কাঁদতে পারতো শর্মিলা সমস্ত যন্ত্রণাকে উজাড় করে দিয়ে।
কেউ  জানতো না।
দেখতো না।
জানালা বন্ধ হওয়ার শব্দে চমকে উঠেছিল লনে পায়চারীরত আশকার।
মুহুর্তের জন্যে চোখ তুলে তাকালো হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া জানালার দিকে।
এরপর সারাটা দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো।
রাত নামলো ॥
কিন্তু বীণা বাজালো না।
অন্যান্য দিনের মতো আজও আকুল আগ্রহে কান পেতে রইলো আশকার।
অস্থির পায়চারী করলো বারান্দায়, কিন্তু বীণা বাজলো না।
তারের কান্না আজ স্তব্ধ।
পরের দিন সন্ধ্যায় নিজের ঘরে ইজি চেয়ারে চোখ বুজে পড়েছিল শর্মিলা।
টেবিল ল্যাম্পের আবছা আলোয়া ওর মুখম-লের বড় বেশি রহস্যময় মনে হচ্ছিল।
বহুদিন  ক্যান্সার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল শর্মিলা।
বোনের জন্যে দু’হাতে টাকা খরচ করেছে জাফর। বিদেশে নিয়ে গিয়েও বড় হাসপাতালে রেখেছিল কিছুদিন।
ধনী বাপের রেখে যাওয়া প্রচুর ধন-সম্পত্তি ছিল জাফরের।
তবে না থাকলেও বোনের চিকিৎসার জন্যে নিজেকে বিক্রি করে দেবার মতো হৃদয়ও ছিল জাফরের।
এতো বড় দুনিয়ায় শর্মিলা ছাড়া আছেই বা কে ওর!
মা মারা গেছেন শর্মিলার জন্মের পরপরই। আর বাবা! সে তো বছর পাঁচেক হলো।
শর্মিলা তখন স্কুলের ছাত্রী। আর তখন থেকেই এই দুটি ভাই-বোন একে অন্যকে অবলম্বন করে বেঁচে আছে।
কিছু দিন হলো বাড়ি ফিরে এসেছে শর্মিলা।
ঘরে ঢুকলো জাফর। পাষাণ মূর্তিকে দেখলো পেছন থেকে। ঘরের কোণে কার্পেটে স্তব্ধ বীণা।
এগিয়ে এলো জাফর।
বললÑ
: জানালা বন্ধ কেন রে? বাতাস আসবে কি করে?
: না নাÑ
: না কিরে?
বিস্মিত জাফর দেখলো ক্লান্ত শর্মিলার চোখ দু‘টো। বললÑ
: আশকার বীণা ভালোবাসে। আজ একবারও তো বাজাসনি।
: না নাÑ
: না! না কেন?
: ভাইয়াÑ
নিজেকে সামলানো কঠিন হলো শর্মিলার। স্তব্ধ জাফরের হাত শর্মিলার পিঠ স্পর্শ করলো। দু’হাতে বীণাটা তুলে এনে শর্মিলার কোলে এনে দিল।
জাফর বললÑ
: এটাই তো সব বেদনার অবসান শর্মি!
: ভাইয়াÑ
জানালা খুলে দিল জাফর। হু-হু করে ঠা-া বাতাস শর্মিলার চোখের কোল ছুঁয়ে গেল।
আকুল হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর কুন্তল সমুদ্রে।
আবার মৃদু ঝংকার উঠলো বীণার তারে।
র’য়ে র’য়ে সে সুর কেঁদে ভাসিয়ে দিল সন্ধ্যায় বিহ্বল মুহূর্ত। আর সেই সুরেলা মুহূর্তে নিজেকে আবিষ্কার করে চমকে উঠলো আশকার।
ওর যেন নবজন্ম হয়েছে।
বারান্দায় ইজি চেয়ারে বিমূর্ত আশকার। বিরতি নেই বীণার সুরে।
কি এক অব্যক্ত করুণ মিনতি যে ঝরে পড়ছে সে সুরে।
বাতাস হয়ে লুটিয়ে পড়ছে পায়ে।
কি যেন বলতে চাইছে সে। সুর... অথচ কিছুতেই যেন প্রকাশ করতে পারছে না।
কিন্তু আশকার কি ওই মায়াবী সুরের জালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে?
ওতো এসেছিল নতুন লেখার খোরাকের সন্ধানে।
এসেছিল ছুটি কাটাতে। কিন্তু কই? কোথায় গেল ওর লেখা? নতুন একটা উপন্যাস শুরু করার কথা ছিল আশকারের। ওকি তবে পাগল হয়ে গেছে? না  হয়ে যাবে? এ কি অদ্ভুত যাদু? কেন এমন হয়?
কিন্তু কেমন সেই অর্ঘ্য নিবেদিকা শিল্পী? যার সুরের মায়ায়, যাদুতে উন্মাদ করে তুলেছে আশকার নামের এই আশ্চর্য মানুষটিকে?
শর্মিলা যার নাম।
একই বাড়িতে, একই ছাদের নিচে আছে, অথচ তবুও ওকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি আশকারের।
সযতেœ প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছে অন্তরঙ্গ বন্ধু জাফরও।
কিন্তু কেন?
এ কি লীলা বিধাতার!
কিন্তু নতি স্বীকার করার বাসনা নিয়ে আশকারের জন্ম নয়।
দুর্বার দুর্গম হোক সে পথ।
হোক বিধাতার বিচারে অমার্জনীয় অপরাধ।
কি করে ফিরে যাবে আশকার সেই সুর স্রষ্টার দর্শন না করেই। এ যে আত্ম প্রবঞ্চনা।
বীণা কোলে সুরের ঝংকার তুলছিল শর্মিলা। পিঠময় ছড়ানো একরাশ দীর্ঘ কেশভার। জ্বলছে কোনেন নীল আলো।
শর্মিলা তখনো সুরের রাজ্যে সমাহিত। দু’টি চোখ প্রায় নিমীলিত।
: শর্মিলা!
মেঘমন্দ্র কণ্ঠ আশকারের।
ঈষৎ ঝাঁকুনী লাগলে ঝংকৃত সুর মূর্ছনায়।
চোখ খুললো শর্মিলা?
সেই অবিন্যস্ত চুলের অরণ্য, বিভ্রান্ত দু’টো তৃষ্ণার্ত, ক্লান্ত চোখ...।
কম্পিত অথচ সংযত ওষ্ঠদ্বয়, দাঁড়াবার আর কিছু বলবার ওই ভঙ্গি।
শর্মিলা নামের এক নিভৃতচারিণী মেয়ের দুয়ার প্রান্তে এক আশ্চর্য প্রেমের দ্যুতি নিয়ে এ কোন দেবদূত!
এ কি স্বপ্ন?
এমন অবিশ্বাস্য ঘটনাও কি সম্ভব?
শর্মিলার চোখ দু’টো যেন ঝাপসা হয়ে আসছে।
দুলছে যেন পুরো পৃথিবীটা।
তারপর!
তারপর আর  কিছু বলতে পারে না সে।
এরপর কখন শর্মিলা সম্ভিৎ ফিরে পেয়েছে, ওর মনে পড়ে না।
মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা।
আর বুকের ভেতরেÑকি যেন ঠিক বুঝতে পারে না শর্মিলা। ব্যথা না শূন্যতা। হৃদয়ের কোথায় যেন কি একটা ঘটে গেছে। শর্মিলার মনে হলো প্রখর দ্যুতি নিয়ে এখনো তেমনি দাঁড়িয়ে আছে আশকার।
আশকার আগুন জ্বেলে দিয়ে গেছে ওর ব্যাধিগ্রস্ত দেহে আর মনে। সেতো কোনদিন প্রকাশ করেনি নিজেকে? নিজের অভিশপ্ত অস্তিত্বকে সযত্বে আড়াল করে রেখেছিল সবার কাছ থেকে।
তার অনাঘ্রাত কুমারী জীবনের আকাক্সিক্ষত স্বাদ-স্বপ্ন সব কিছুকে বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছে অদৃষ্টের লিখনে।
কোথা দিয়ে আর কেমন করে এই সর্বনাশা রোগ শর্মিলার উপর নজর দিল খোদা জানেন।
অমন কাঁচা সোনার মতো রং ভাষাময় আয়ত চোখÑ
হাসবার ওই চমৎকার ভঙ্গি যে কোন মানুষকে ভাবিয়ে তুলবার মতো ছিল সন্দেহ নেই।
সেই শর্মিলা বিদেশ থেকে চিকিৎসা করিয়ে আসবার পর পরই নিজেকে সযতনে বন্দী করেছে ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে। ও জানে, সীমিত সময় ওর হাতে।
এরপর থেকে শর্মিলা তৈরি করে নিয়েছে আপন ভুবন।
কিন্তু আজ এ কি হলো! যক্ষপুরীর লৌহ কপাট অতিক্রম ক’রে দুয়ারে এসে দাঁড়ালো এ কোন রাজপুত্র!
ওভাবে কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল আশকার।
কতোক্ষণ!
কি দেখছিল সে অমন ক’রে ... কেন দেখছিল?
কি আছে দেখার!
কিন্তু শর্মিলার চোখ দু’টো কেন সেই মুহূর্তে অন্ধ হয়ে গেল না!
কি যেন বলছিল আশকার? “আমার কল্পনার অর্ঘ্য তোমায় মাধুর্য্য দিয়েছে আমি তোমার বেদীমূলে”...
আর কিছু মনে পড়ে না শর্মিলার।
কেন এমন হলো? কেন আশকার তৃষ্ণার্ত কুমার দৃষ্টির আগুনে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিল শর্মিলার ধ্যানী মনটাকে? কেন আশকারের মেঘমন্দ্র কণ্ঠের উত্তাপে গলিয়ে দিল ওর স্তব্ধ তুষার হৃদয়?
পরদিন ভোরে বারান্দায় চেয়ারে বসে গোলাম আলীর গজল শুনছিল শর্মিলা। ওকে যেন এই লোকালয় থেকে দূরে, অনেক দূরে নিয়ে গিয়েছিল।
ওর আদ্র দু’টো চোখ, যেন চোখ নয়, যেন মহাশূন্যের বিষণœ ছবি।
এমনি সময় বারান্দাটা পেরিয়ে ঠিক শর্মিলার পেছনে এসে দাঁড়ালো আশকার।
তারপর কম্পিত কণ্ঠে ডাকলোÑ
: শর্মিলাÑ
হঠাৎ করে চমকে উঠলো শর্মিলা এবং বুঝতে পারলো ওর পেছনে খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছে আশকার।
উঠে দাঁড়িয়ে সামনের রেলিংটা শক্ত করে ধরলো শর্মিলা।
আশকার বললÑ
: শর্মিলা, আমি চলে যাচ্ছি। আমি জানি এভাবে তোমার কাছে আসা, কথা বলা, আমার উচিত হয়নি। কিন্তু তবুও না এসে আমি পারিনি। আমার এই অশোভন আচরণকে তুমি ক্ষমা করো। প্লীজ!

চলে গেল আশকার। ছুটি কাটাতে এসে ভিন্ন এক উপলব্ধি নিয়ে ফিরে গেল কর্মস্থলে।
ঢাকায় এসেও বুকের ভেতরটা কেমন খাঁ খাঁ করতে লাগলো ওর। অব্যক্ত এক অস্থিরতা যেন ধিকি ধিকি জ্বলতে লাগলো ভেতরটায়।
ভার্সিটিতে ক্লাস একেবারেই যেন ভালো লাগে না ওর।
এই অস্থিরতার মধ্যেই একদিন নতুন একটা লেখায় হাত  দিল আশকার।
এবং লিখতে আরম্ভ করে ওর মনে হলোÑএকজন কেউ যেন ওর খুব কাছেই আছে।
যে অব্যক্ত অনুভূতির কথা কাউকে বলা যায় না, বোঝানো যায় না, অথচ বুকের অন্তঃস্থলে অনুভূত হয় প্রতিনিয়ত...
সে কথা যেন লিখতে বসলে মোমের মতো গলতে থাকে নীরবে।
উপন্যাসের পা-ুলিপিটা শেষ করে জাফরকে ডেকে  পাঠালো আশকার।
বললÑ
: কিছুদিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছি। শরীরটা কেমন যেন ভালো লাগছে না। বইটা ছাপার সব দায়িত্ব তোর ওপর দিয়ে গেলাম।
জাফর কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, বাধা দিয়ে ওর হাত চেপে ধরলো আশকার। বললÑ
: প্লীজ, কোন প্রশ্ন করিস নে।
জাফর মৃদু হাসবার চেষ্টা করলো। বললÑ
: ঠিক আছে। ভালো থাকিস। সুস্থ থাকিস।

পরদিনই শহর ত্যাগ করলো আশকার।
ফিরে এলো প্রায় চার মাস পর। ব্লাড ক্যান্সার নিয়ে।
সব জানতো জাফর। ওকে দেখে চমকে উঠলো। বললÑ
: একি করেছিস আশকার? কেমন করে যেন  হাসলো আশকার। তারপর হঠাৎ দুই বাহু প্রসারিত করে আবৃত্তি করার মতো করে বলে উঠলোÑ
আমি বেসেছি যাহারে ভালো
এ দেহ সেই-ই করেছে আলো।
সেদিন চোখ শুকনো রাখতে পারেনি জাফর।
জাফর নতুন উপন্যাস ‘অবগুণ্ঠন’-এর একটা ঝকঝকে কপি আশকারের হাতে তুলে দিয়ে ওর চোখে চোখ রাখলো জাফর। বললÑ
: কিন্তু কেমন করে এতোটা বাড়াবাড়ি হলো?
আশকার স্তব্ধ।
জাফর বললÑ
: শর্মিলার কাছে একবার যাবি?
: শর্মিলা! হঠাৎ যেন ভীষণভাবে চমকে উঠলো আশকার। বলল যাব।
দ্বিতীয় বারের মতো অজন্তা’র সামনে এসে দাঁড়ালো আশকার।
সন্ধ্যা তখন পেরিয়ে গেছে। জাফর এসে জানালোÑ
: আশকার এসেছে।
হঠাৎ যেন বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠলো শর্মিলার।
জাফর আবার বললÑ
: দেখা করবি না?
: নাÑ নাÑ নাÑ
প্রবলভাবে মাথা নাড়লো শর্মিলা। জাফর বেরিয়ে যেতেই আশকার এসে দাঁড়ালো দরজায়। দেখলো শর্মিলাকে। তারপর এক সময় ডাকলোÑ
: শর্মিলা।
আবার সেই মেঘমন্দ্র কণ্ঠ। আকুলভাবে বালিশে মুখ লুকালো শর্মিলা।
আশকার স্তব্ধ!
বিমূঢ়!
বিস্মিত!
ওর কণ্ঠে এবার ক্লান্তিময় মিনতি।
: আমায়, আমায় তুমি একটিবার দেখবে না শর্মিলা?
: নাÑনা Ñ নাÑ
আর্তনাদ করে মাথা নাড়লো শর্মিলা। আশকারের ক্লান্ত বিষণœ কণ্ঠ একটু হাসলো এবার। আর এই হাসবার চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে সমুদ্রের ব্যাকুল কান্না ধ্বনিত হলো ওর শেষের কথা।
বললÑ
: একটিবার, শুধু একটিবার তুমি আমার দিকে মুখ তুলে তাকাও শর্মি।
দেখবে, দেখবে আমিÑ
এরপর ওই আশ্চর্য কণ্ঠের ক্লান্তিময় মিনতিকে অস্বীকার ক’রে বালিশে মুখ লুকিয়ে রাখা যায় না। অত সাহস শর্মিলার বুকে নেই।
কান্না ভেজা মুখ তুলে আশকারের দিকে তাকালো শর্মিলা। আর তারপরই আহত পাখির মতো আর্তনাদ করে উঠলোÑ
: আশকার!
আবার হাসবার চেষ্টা করে চোখ ভিজিয়ে তুললো আশকার। টেনেটেনে আবৃত্তি করলোÑ         আমি বেসেছি যাহারে ভালো
এ দেহ সেইÑই করেছে আলো।

দু’হাতে মুখ ঢেকে হু-হু করে কেঁদে উঠলো শর্মিলা।
আশকার তেমনি দাঁড়িয়ে রইলো দরজার সামনে। দেখলো শর্মিলার কান্নার সেই অপূর্ব দৃশ্য।
পরদিন ভোর হবার আগেই অজন্তা ত্যাগ করেছিল আশকার।
কিন্তু দুর্ভাগ্য। আর বই পেলেন না সরকার? পুরস্কৃত করতে গেলেন ‘অবকণ্ঠন’-কে।
আশকারের জানা ছিল না, কখন আর কেমন ক’রে জাফর বইটা একাডেমীতে পাঠিয়েছিল। অন্তত আশকার নিজে এমনটি কখনো করতো না।
জ্বালা, জ্বালা, জ্বালা অসহ্য জ্বালা। দেহে-মনে রক্তের রেণুতে-রেণুতে।
অসহ্য।
: অসহ্য! আমি পাগল হয়ে যাব! আমি পাগল হয়েÑ চিৎকার করে উঠলো আশকার। অস্থির হয়ে উঠে দাঁড়ালো চেয়ার থেকে।
সচকিত জাফর।
নার্স ছুটে এসে ধরলো আশকারকে। বললÑ
: প্লীজ মিঃ চৌধুরী, এতো উত্তেজিত হবেন না। আমি ভিজিটরদের যেতে বলছি।
: নাÑ নাÑ নাÑ
পাগলের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে চিৎকার করে উঠলো আশকার।
বললÑ
: ওকে কাঁদতে বারণ কর জাফর। শর্মি কাঁদছে। ওকে কাঁদতে দিসনে ভাই, কাঁদতে বারণ কর জাফর... শর্মি কাঁদছে... ওকে কাঁদতে দিসনে।
সংজ্ঞাহীন আশকারকে বিছানায় শুইয়ে দেয়া হলো। ডাক্তার-নার্সদের দৃষ্টিবান লক্ষ্য করলো জাফর।
কেবিনে ওষুধের তীব্র গন্ধ আর রাশিকৃত ফুলের সুরভি মিলে একটা উৎকট গন্ধ হয়ে ঘুরে মরছে চার দেয়ালের মধ্যে।
বিমূঢ় জাফর দরজার বাইরে এসে দাঁড়ালো।


 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন