শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

স্বাধীনতা গণমাধ্যমের অধিকার

প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুনশী আবদুল মাননান
স্বাধীনতা গণমাধ্যমের অধিকার, এটি অনেক দেশেই স্বীকার করা হয় না। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ কিংবা তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার প্রবণতা যথেষ্টই প্রত্যক্ষ করা যায়। চাহিবামাত্র তথ্য পাওয়া যেমন সব সময় সব দেশে সম্ভব হয় না, তেমনি গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও সব দেশে নিরঙ্কুশ ও অবাধ নয়। গত ২০ এপ্রিল ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার’ যে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক প্রকাশ করে তাতে বলা হয়, গত বছর বিশ্বে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দুর্বল হয়েছে। এটা গভীর ও বিচলিত হওয়ার মতো বলে উল্লেখ করে জানানো হয়, বিশ্বে সব অংশেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় ভাটা পড়েছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার-এর প্রতিবেদনে বিশেষভাবে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমের জন্য একটি আতঙ্কজনক পরিবেশ বা আবহ তৈরি হয়েছে। ‘বিশ্ব নেতারা বৈধ সাংবাদিকতা নিয়ে এক ধরনের নির্যাতনমূলক ভীতি বা মানসিক বৈকল্য সৃষ্টির প্রয়াস চালাচ্ছেন।’ অনেক দেশের সরকারই মাত্রা ছাড়ানো বিতর্কের ভয়ে গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিমালিকানায় গণমাধ্যমে স্বাধীনভাবে সংবাদ প্রচার ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। বৃহদাকার প্রচারযন্ত্রের কাছ থেকেও হুমকি আসছে। বড় বড় বাণিজ্যিক গোষ্ঠী গণমাধ্যমের মালিকানা কিনে নিচ্ছে এবং চাপ সৃষ্টি করছে। সরকারের সঙ্গে এই চাপ যুক্ত হওয়ায় জটিলতা আরও বাড়ছে।
গত ১১ থেকে ১৩ এপ্রিল লন্ডনের ওপেন ইউনিভার্সিটিতে কমনওয়েলথ সাংবাদিক সমিতির ত্রিবার্ষিক সম্মেলন হয়। ওই সম্মেলনেও বিশ্ব গণমাধ্যম পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কমনওয়েলথের মহাসচিব ব্যারনেস প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টকে (আইএফজে) উদ্ধৃত করে বলেন, দুঃখজনক সত্য হলো। এ বছর ২৪ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। ইউনিসেফকে উদ্ধৃত করে তিনি আরো বলেন, গত এক দশকে সাংবাদিক হত্যার ৯০ শতাংশ মামলারই কোনো নিষ্পত্তি হয়নি। ওই একই অনুষ্ঠানে ব্রিটেনে কানাডার হাইকমিশনার গর্ডন ক্যাম্পাবেল আরো কিছু হতাশাজনক চিত্র তুলে ধরেন। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ফ্রিডম হাউসের পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, কমনওয়েলথের ৫৩ দেশের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেই গণমাধ্যম পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছে না। ৯টি দেশে একেবারেই স্বাধীনতা নেই এবং ১৮টিতে আছে আংশিক স্বাধীনতা। ওই দিনের নৈশভোজে অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে কমনওয়েল প্রেস ইউনিয়ন ট্রাস্টের ডিরেক্টর, দি টেলিগ্রাফের নির্বাহী পরিচালক লর্ড গাই ব্ল্যাক বলেন, রাজনীতিকদের মুখে মুক্ত গণমাধ্যমকে সমর্থনের কথা শুনে আমি অভ্যস্ত। তবে সাধারণত তারা তাদের নিজেদের দেশের বদলে অন্যের দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসেন। কমনওয়েলথভুক্ত তিনটি দেশ জ্যামাইকা, কানাডা ও নিউজিল্যান্ডের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্বে মুক্ত গণমাধ্যমের তালিকায় শীর্ষে যে ১০টি দেশ রয়েছে তাদের মধ্যে এদের অবস্থান সমুজ্জ্বল। কিন্তু এই একই কমনওয়েলথের অনেকগুলো দেশ বছরের পর বছর তালিকার তলায় পড়ে আছে, যাদের মধ্যে উগান্ডা, পাকিস্তান, রুয়ান্ডা, বাংলাদেশ ও গাম্বিয়ার কথা বলা যায়। এসব দেশে গণমাধ্যম কঠোরভাবে এবং কখনো কখনো নিবর্তনমূলকভাবে নিয়ন্ত্রিত। তার মতে, সেখানে দুটি সমস্যা বিদ্যমান। প্রথমত, আইনের মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ। এক্ষেত্রে মানহানির দায়কে ফৌজদারি অপরাধ ও রাষ্ট্রদ্রোহের বিধান করে বিতর্ক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অভাব। তার সুচিন্তিত অভিমত, রিপোর্টার বা সম্পাদকরা যদি শারীরিক সহিংসতা, এমনকি মৃত্যুর হুমকি থেকে মুক্ত থাকতে না পারেন, তাহলে মুক্ত সাংবাদিকতা সম্ভব নয়।
স্বাধীনতা গণমাধ্যমের অধিকারÑবাংলাদেশে এই প্রতিপাদ্য কতটা কার্যকর অবস্থায় আছে, তা সংশ্লিষ্টদের যেমন অজানা নেই, তেমনি অজানা নেই পর্যবেক্ষক মহলেরও। অবশ্য সরকারি মহলের রয়েছে ভিন্ন বক্তব্য। সরকারি মহলের অভিমত হলো, এখানে অবাধ তথ্যপ্রবাহ যেমন আছে, তেমনি গণমাধ্যমগুলোও ভোগ করছে স্বাধীনতা। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে সরকার বিশ্বাসী নয় এবং নিয়ন্ত্রণ করছেও না। কেউ কেউ এমনও বলে থাকেন, এ যাবৎকালের মধ্যে গণমাধ্যমগুলো সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা উপভোগ করছে। মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতির দাবিও করা হচ্ছে। এই দাবির পক্ষে তথ্য উপস্থাপন করে বলা হচ্ছে, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের বৈশ্বিক সূচকে আগের বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৬। এবার ১৪৪। অর্থাৎ দুই ধাপ অগ্রগতি হয়েছে। অতঃপর সিদ্ধান্ত দেয়া হচ্ছে এভাবেÑ‘এদেশে গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা অতীতের তুলনায় অনেক সুরক্ষিত।’
সরকারি মহলের এই দাবি মানতে নারাজ দেশের রাজনৈতিক মহল, বিদ্বৎসমাজ, গণমাধ্যমসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং গণমাধ্যম কর্মীদের সংগঠন। তারা মনে করে, দেশে বিদ্যমান নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রে গণমাধ্যমও নিয়ন্ত্রিত। সরকার তার ক্ষমতা সংরক্ষণ ও প্রলম্বিত করার লক্ষ্যে গণমাধ্যমের ওপর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যাচ্ছে। পর্যবেক্ষক-বিশ্লেষকরা একমত যে, কোনো দেশে যখন গণতন্ত্র থাকে না কিংবা নানা নিয়ন্ত্রণের শৃঙ্খলে গণতন্ত্র বন্দি থাকে, তখন সেদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকে না, আইনের শাসন থাকে না, মানবাধিকার থাকে না, বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে এগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গণতন্ত্র থাকলে এসব থাকে, না থাকলে থাকে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এই বিবেচনা প্রয়োগ করলে দেখা যাবে, এখানে গণতন্ত্র বলতে প্রকৃতপক্ষে যা বোঝায়, তা নেই। গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো নির্বাচন। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হলে রাজনীতির চর্চা সুষ্ঠু ধারায় প্রবাহিত ও বিকশিত হতে পারে। নির্বাচনের মাধ্যমেই গণরায়ভিত্তিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। শান্তিপূর্ণভাবে সরকার ও শাসনের পরিবর্তন ঘটে। এই পথটি কার্যত রুদ্ধ হয়ে গেছে। এযাবৎ জাতীয় নির্বাচনসহ যতগুলো নির্বাচন হয়েছে তার কোনোটিই অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি। রাষ্ট্রশক্তি ও রাজনৈতিক পেশিশক্তি নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থার ওপর দখল প্রতিষ্ঠা করেছে। এর ফলে নির্বাচনের নামে হয়েছে প্রহসন। যারা এই নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়েছেন কিংবা যারা নিজেদের জনপ্রতিনিধি হিসেবে দাবি করেন তাদের নৈতিক অবস্থান ও ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল। তারা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকে বেতোয়াক্কা করেছেন, জনগণের ক্ষমতাকে হরণ করেছেন। কোনো অনির্বাচিত বা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে নির্বাচিত সরকার সব সময়ই একটা অস্বস্তি ও ভীতির মধ্যে থাকে। আর এই অস্বস্তি ও ভীতির কারণে নিয়ন্ত্রণ ও নিবর্তনমূলক ব্যবস্থার প্রতি পক্ষপাত দেখায়, রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে, বিরোধী দল দমনে যাচ্ছেতাই পন্থা অনুসরণ করে, গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ছাড়াও আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার উপেক্ষা করে। আমাদের দেশে এসব বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে লক্ষ্যযোগ্য। দেশে যদি প্রকৃত গণতন্ত্র থাকত তাহলে এরকম পরিস্থিতি তৈরি হতে পারত না।
গণতন্ত্রের সঙ্গে গণমাধ্যমের সম্পর্ক বিশদ ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। গণতন্ত্রে গণমাধ্যম অপরিহার্য অনুষঙ্গ। গণতন্ত্র না থাকলে স্বাধীন ও মুক্ত গণমাধ্যম প্রত্যাশা করা যায় না। স্বাধীনতা যে গণমাধ্যমের অধিকার, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই সেটা নিশ্চিত করতে পারে। গণমাধ্যম সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধের কাজ করে। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী শাসকগোষ্ঠী স্বাধীন বা মুক্ত গণমাধ্যম বরদাশত করতে পারে না। অনিবার্যভাবে শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে গণমাধ্যমের বিরোধ সৃষ্টি হয়। তখনই গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়টি অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। আমাদের দেশের গণমাধ্যম স্বাধীন নয়, মুক্ত নয়Ñএ কথা কেবল আমরাই নই, আন্তর্জাতিক মহলও উপর্যুপরি বলছে। গণমাধ্যম কর্মীদের মতে, বর্তমানে গণমাধ্যম যেরূপ নিয়ন্ত্রিত, অতীতে সেরূপ নিয়ন্ত্রণ কখনই লক্ষ্য করা যায়নি। দু’ভাবে প্রধানত গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। প্রথমত, নতুন নতুন নীতিমালা ও আইন করে এবং দ্বিতীয়ত, আইনবহির্ভূতভাবে। শেষোক্ত ক্ষেত্রে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছে। ফলে সব ধরনের গণমাধ্যমই এক ধরনের সেলফ সেন্সরশিপ অনুসরণে বাধ্য হচ্ছে।
সাংবাদিক হত্যা, সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন, গণমাধ্যম বন্ধ, সংবাদকর্মী ও সম্পাদকদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতার, হয়রানি ইত্যাদি অতিসাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১৪ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। সাংবাদিকদের সর্বোচ্চ সংগঠন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মতে, এই সংখ্যা ২৭। অধিকারের হিসাবে ওই সময়ে ১ হাজার ৮২২ জন সাংবাদিক নানাভাবে রোষের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে কথিত ১৪ জন নিহত হওয়া ছাড়াও আহত হয়েছেন ৮৩০ জন। ১৫২ জনকে মারধর করা হয়েছে। ৮০ জনের ওপর হামলার শিকার হয়েছেন। ২৫ জন গ্রেফতার হয়েছেন। তিনজন গুম হয়েছেন। এ ছাড়া ৩২৪ জনকে হুমকি দেয়া হয়েছে, চারজনকে নির্যাতন করা হয়েছে এবং ১৬৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
হত্যা, নির্যাতন, হামলা, মামলা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যা হয়েছে, অতীতে সেরকম দেখা যায়নি। অবশ্য সব সময়ই সাংবাদিকতা পেশা এদেশে অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। বিগত বছরগুলোতে তার মাত্রা ও পরিধি বেড়েছে। আগে যেমন বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যম বন্ধের ঘটনা ঘটেছে, বর্তমান আমলেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, এই সময়ে একটি দৈনিক, তিনটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল, একটি অনলাইন পোর্টাল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ছোটখাটো অনেক পত্রপত্রিকা বন্ধ করা হয়েছে। এসব গণমাধ্যমের শত শত সাংবাদিক ও কর্মী বছরের পর বছর ধরে বেকার অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এই মুহূর্তে দুজন সম্পাদক ও একজন শীর্ষ সাংবাদিক নেতা কারাগারে আছেন।
গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ কোন পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে, নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা কতটা হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে, তা অনুধাবনের জন্য এডিটরস কাউন্সিলের একটি বিবৃতি এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদপত্র ও জাতীয় প্রচার মাধ্যমের পক্ষে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। একদিকে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে দায়িত্বরত সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে, অন্যদিকে সংবাদপত্র ও প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা চলছে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রচার মাধ্যমের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। সরকার ও প্রশাসন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদ সংগ্রহ এবং পরিবেশনায় বাধা সৃষ্টি করছে। সংসদে সম্পাদক ও প্রকাশকদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেয়া হচ্ছে, যা তাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ,’ ইত্যাদি
বিভিন্ন নীতিমালা ও আইন-বিধি প্রণয়নের মাধ্যমে মিডিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি জাতীয় সম্প্রচার আইনের যে খসড়া দেয়া হয়েছে, তাতে এই আইনের বিধিবিধান বা প্রবিধান লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদ-, কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দ-দানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ওই আইনের খসড়ায় আরো বলা হয়েছে, লাইসেন্স ছাড়া প্রচার মাধ্যম পরিচালনা করলে জরিমানা হবে সর্বোচ্চ ১০ কোটি টাকা। গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যমান বাস্তবতায় এই আইনের অপপ্রয়োগের সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, আদালত অবমাননা ও মানহানির মতো বিষয়গুলো গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষ মেনে চলে। লাইসেন্স নেয়ার সময় এসব বিষয়ে গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষকে অঙ্গীকার করতে হয়। এ অবস্থায় জেল-জরিমানার আবশ্যকতা থাকতে পারে না। জাতীয় সম্প্রচার আইনের খসড়ায় এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যেখানে কারো কারো দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শর্ত আরোপ করা হয়েছে। বলা যায়, জাতীয় সম্প্রচার আইন গণমাধ্যমের সুবিধা দেয়ার বদলে অসুবিধাই বেশি সৃষ্টি করবে। তাকে নিয়ন্ত্রণ ও খবরদারির আওতায় নিয়ে যাবে। এ আইন গণমাধ্যমকে প্রকৃত সুরক্ষা দেবে না, নিয়ন্ত্রিত করবে।
প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধনের একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অনেকদিন ধরেই প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধনের তাগিদ উচ্চারিত হচ্ছিল। এই প্রেক্ষাপটে সংশোধনের জন্য যেসব প্রস্তাব করা হয়েছে, তার একটি ধারায় বলা হয়েছে, প্রেস কাউন্সিলের আদেশ অমান্য করলে শাস্তি হিসেবে কোনো সংবাদপত্র বা সংবাদ সংস্থার প্রকাশনা সর্বোচ্চ ৩০ দিন বন্ধ রাখতে পারবে প্রেস কাউন্সিল। জানা গেছে, প্রেস কাউন্সিল প্রচলিত আইন সংশোধনের একটি খসড়া তৈরি করে। তার ওপর মতামত দিতে দিয়ে আইন কমিশন এই প্রস্তাব সংযোজন করার পরামর্শ দেয়। আইন কমিশনের সুপারিশের মধ্যে সংবাদপত্র বা সংবাদ সংস্থা বন্ধ রাখা ছাড়াও সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, আইন কমিশন উপযাচক হয়েই এই বন্ধ ও জরিমানার সুপারিশ করেছে। প্রেস কাউন্সিলের অবশ্য এ ব্যাপারে ভিন্ন মত রয়েছে এবং এই প্রতিষ্ঠানটি আইন কমিশনের সুপারিশ মানতে বাধ্য নয়। বলা বাহুল্য, সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও ভীতি সৃষ্টির জন্যই এ সুপারিশ করা হয়েছে। সর্বশেষ এক খবরে জানা গেছে, গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণের জন্য সরকার একটি মনিটরিং কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা গড়ে তোলার চিন্তা করছে। এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইতোমধ্যেই নানা প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেরই জানা, ইতোমধ্যে অনলাইন নীতিমালা, আইসিটি অ্যাক্ট ইত্যাদি যা কিছুই করা হয়েছে তাতে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যটিই প্রধান হিসেবে উঠে এসেছে। সরকারের নীতি হওয়া উচিত গণমাধ্যম সুরক্ষা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। অথচ তার উল্টোটিই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দায়িত্বশীল ও বস্তুনিষ্ঠ গণমাধ্যমের বিকল্প নেই। যাচ্ছেতাই করার স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। এই স্বাধীনতা যেমন কেউ চায় না, তেমনি যে কোনো উছিলায় গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, তার অধিকার হরণ কাম্য হতে পারে না। দেশের প্রয়োজনে ও জনগণের প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণহীন, বাধাহীন, হুমকিহীন গণমাধ্যমই প্রত্যাশিত।
যুক্ত বা স্বাধীন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার জন্য এ দেশের মানুষ সুদীর্ঘকাল ধরে সংগ্রাম করে আসছে। ব্রিটিশ আমলে যখন আধুনিক সংবাদপত্রের উদ্ভব হয় তখন থেকেই এ সংগ্রাম চলছে। সে আমলেও দেখা গেছে, ঔপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠী সংবাদপত্রকে তার প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করছে এবং সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা রকম কালাকানুন প্রণয়ন করেছে। সংবাদপত্র বন্ধ এবং সাংবাদিকদের গ্রেফতার ও নির্যাতন করেছে। পাকিস্তান আমলে সংবাদপত্র দলন এবং সাংবাদিকদের ওপর জুলুম-পীড়নের ধারা আরো খোলাখুলিভাবে প্রত্যক্ষ করা গেছে। পাকিস্তান আমলে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন-সংগ্রামের মতো সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্যও আন্দোলন-সংগ্রাম চলেছে কখনো পাশাপাশি, কখনো একসঙ্গে। এটাই জনপ্রত্যাশা ছিল, স্বাধীনতার পর গণতন্ত্র যেমন সুপ্রতিষ্ঠিত হবে, তেমনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও নিশ্চিত হবে। কিন্তু এ প্রত্যাশা শুরুতেই মারাত্মক হোঁচট খায়। গণতন্ত্র উপেক্ষিত হয়, সংবাদপত্র হুমকিতে পড়ে এবং সাংবাদিকরা বিপন্ন দশায় পতিত হন। স্বাধীন দেশে সম্পাদক গ্রেফতার হবেন, সাংবাদিকরা হামলা-হয়রানির শিকার হবেন, সংবাদপত্র বন্ধ হবেÑএটা কেউ কল্পনা না করলেও এসব ঘটতে দেখা যায়। সব শেষে গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। একদলীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং চারটি বাদে সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হয়।
গণতন্ত্রের সঙ্গে সংবাদপত্রসহ অন্যান্য গণমাধ্যমের ভাগ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেখা গেছে, যখনই শাসকরা গণতন্ত্রের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে স্বেচ্ছাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, তখনই গণমাধ্যমের জন্য বিপদ নেমে এসেছে। আমরা পরবর্তীকালেও বিভিন্ন সময়ে দেখেছি, সংবাদপত্র বন্ধ হয়েছে, সাংবাদিকরা অশেষ ঝুঁকি, কষ্ট ও বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। এও এক বড় রকমের দুর্ভাগ্য এই যে, এ পর্যন্ত যেসব সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মী নিহত বা নির্যাতিত হয়েছেন, তারা কোনো বিচার পাননি। আর এখন তো বিচারহীনতার একটি ‘সংস্কৃতি’ই গড়ে উঠেছে। সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের বিচার হবে, এমন আশা আর এখন কেউ করে না। সকলেই একমত, গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রত্যাবর্তন না হলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আসবে না। স্বাধীনতা গণমাধ্যমের অধিকার, এটা নিশ্চিত করতে হলে গণতন্ত্র  প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ার বিকল্প নেই। বর্তমান শাসকরা বিভিন্ন নীতিমালা ও আইন-কানুনের মাধ্যমে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তা তাদের ক্ষমতাকে কতটা নিরাপদ করতে পারবে, আমাদের জানা নেই। তবে অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এটা একটি ভ্রান্তপথ। জনগণ ও গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করে কোনো দেশেই কোনো শাসকদের ভালো হয়েছে, এসব নজির নেই।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন