বরগুনায় স্ত্রীর সামনে প্রকাশ্যে রিফাত শরীফকে (২২) কুপিয়ে হত্যা মামলার প্রধান আসামি সাব্বির আহমেদ ওরফে নয়ন বন্ড (২৫) পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ভোর সোয়া ৪টার দিকে বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের পুরাকাটা ফেরিঘাট এলাকায় এ বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় চার পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে পিস্তল, গুলি ও গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়। বরগুনার পুলিশ সূত্রে এসব বিষয় জানা গেছে। নয়ন বন্ডের মতো অন্য আসামিদেরও সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছেন নিহত রিফাতের বাবা ও স্ত্রী।
রিফাত হত্যায় জড়িতরা কেউ ছাড় পাবে না বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদ্জ্জুামান খান কামাল। গতকাল দুপুরে নিহত রিফাতের কবরের কাছে গেছেন বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু এমপি। এদিকে, রিফাত হত্যায় জড়িত প্রধান আসামি নয়ন বন্ডকে জীবিত ধরতে ব্যার্থ হওয়ায় এবং তাকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।
পুলিশ সূত্র জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মঙ্গলবার ভোর সোয়া ৪টার দিকে নয়ন বন্ডকে গ্রেফতারে বুড়ির চর ইউনিয়নের পুরাকাটা এলাকায় অভিযান চালানো হয়। এ সময় পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে তাদেরকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় নয়ন বন্ড ও তার সহযোগীরা। পরে পুলিশও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালায়।
সূত্র আরও জানায়, গোলাগুলির পর ঘটনাস্থলে তল্লাশি করে নয়ন বন্ডের গুলিবিদ্ধ লাশ ছাড়াও ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তল, এক রাউন্ড গুলি, দুটি শটগানের গুলির খোসা এবং তিনটি দেশীয় ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় চার পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। তারা হলেন- অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সদর সার্কেল শাজাহান হোসেন, এসআই মনিরুজ্জামান, এসআই হাবিবুর রহমান ও কনস্টেবল হাবিব। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন গতকাল বেলা ১০টার দিকে নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুরাকাটা এলাকায় পুলিশ অভিযান পরিচালনা করলে মজিদ মিয়ার বাড়ি নামক স্থান থেকে নয়ন বন্ড ও তার সহযোগীরা পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে গুলি চালায়। এ সময় পুলিশও পাল্টা গুলি চালালে ঘটনাস্থলে নয়ন বন্ড নিহত হয়। তার সঙ্গীরা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। তাদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে।
পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্রে আরও জানা যায়, গতকাল দুপুরের দিকে বরগুনা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সোহরাফ হোসেনের নেতৃত্বে তিন জন চিকিৎসক নয়নের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন। পরে লাশটি স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বরগুনা সদর থানার ওসি আবির মোহাম্মাদ হোসেন বলেন, বিকাল ৩টার দিকে নয়নের লাশ তার মামা মিজানুর রহমানের কাছে হস্তান্তর করা হয়। নয়নের মামার বাড়ি সদর উপজেলার গৌরিচন্না এলাকায় তার লাশ দাফন করা হবে বলে জানা গেছে।
হত্যায় জড়িতরা প্রভাবশালী হলেও রেহাই নেই
গতকাল রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আমরা চাই না, রিফাত হত্যার মতো এমন কোনো ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি ঘটুক। এ ঘটনায় জড়িতরা যতো প্রভাবশালী লোকই হোক না কেন তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। কেউ-ই রেহাই পাবে না।
মন্ত্রী বলেন, বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত আসামি নয়ন বন্ডকে নিরাপত্তা বাহিনী বেশ কিছুদিন ধরে খুঁজছিল। সে ছিলো পলাতক। পুলিশ যখন তাকে ধরার চেষ্টা করছিল তখন সে অস্ত্র প্রদর্শন করে। এই জন্য পুলিশ নিজের জীবন রক্ষার্থেই গুলিবিনিময় করেছে। আর এতে নয়ন বন্ড নিহত হয়। তিনি আরও বলেন, এই ঘটনায় আরো যারা জড়িত, তাদের জীবিত গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকেও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছিল। কিন্তু সম্ভব হয়নি।
রিফাতের কবরের কাছে গেলেন এমপি শম্ভু
রিফাত শরীফের কবরের কাছে গেলেন বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু এমপি। মঙ্গলবার দুপুরে ৬ নম্বর বুড়ির চর ইউনিয়নের ছোট লবনগোলায় রিফাতের গ্রামের বাড়িতে এসে তিনি কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। তিনি শোকাহত পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দেন তিনি।
এসময় বরগুনা জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাধবী দেবনাথ, ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক আলতাফ মাওলানাসহ জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। কবর কাছে এমপি শম্ভু বলেন, রিফাতের হত্যাকারী প্রধান আসামি নয়ন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। বাকি আসামিদেরও গ্রেফতার করে শাস্তির আওতায় আনা হবে।
সব আসামির শাস্তি চাইলেন রিফাতের বাবা ও স্ত্রী
নয়নের মতো সব আসামিদের সর্বোচ্চা শাস্তি দাবি করেছেন রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ ও স্ত্রী আয়েশা আক্তার মিন্নি। ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নয়ন বন্ডের মৃত্যুর খবর পেয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তারা এ দাবি করেন।
বাবা দুলাল শরীফ বলেন, সব আসামিদের শাস্তি হলে তবেই আমার মন শান্তি পাবে। তিনি বলেন, এখনও দুই আসামি গ্রেফতার হয়নি। তাদের গ্রেফতার করে সবাইকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এই ঘাতকরা শাস্তি পেলেই আমার রিফাতের আত্মা শান্তি পাবে।
স্ত্রী মিন্নি তার বাবার বাসায় সাংবাদিকদের বলেন, হত্যার ঘটনার পর থেকে মূল আসামি নয়ন গ্রেফতার না হওয়ায় সবার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম। এখন সেই শঙ্কা অনেকটা কেটে গেছে। ভয় থেকে এখন নিজেকে কিছুটা হালকা মনে করছি। তিনিও হত্যার ঘটনায় জড়িত প্রত্যেকের ফাঁসি দাবি করেন।
আসকের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ
এদিকে, আসামী সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ডকে জীবিত আটক করে বিচারিক আদালতে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে সংগঠনটি এ উদ্বেগ প্রকাশ করে।
বিবৃতিতে বলা হয়, আসক মনে করে, ‘ক্রসফায়ারে’ নয়ন বন্ডের মৃত্যু এ মামলার বিচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষতি সাধন করবে। সংস্থাটি মনে করে, প্রতিটি মানুষের জীবনের ও বিচার লাভের অধিকার তার মানবাধিকার যা বাংলাদেশের সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে স্বীকৃত রয়েছে। সংস্থাটি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, পুলিশ প্রশাসন এ ধরনের জঘন্য সব অপরাধ প্রবণতারোধে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডকে একটি সমাধান হিসেবে ধরে নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। কিন্তু সাময়িকভাবে এ ব্যবস্থা স্বস্তি এনে দিলেও তা সমাজকে চরম সঙ্কটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে- যা কোনো সভ্য, গণতান্ত্রিক, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। বরং এটি দেশে প্রচলিত আইন, বিচার ও শাসনব্যবস্থার প্রতি চরম আস্থাহীনতা তৈরির সুযোগ করে দিচ্ছে। বিচার বহির্ভূত এসব হত্যাকান্ডের ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তসহ বিচার হওয়া বাঞ্ছনীয়। পাশাপাশি আইন ও বিচার ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং এসব অপরাধ প্রবণতারোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
প্রসঙ্গত, গত ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে স্ত্রীর সামনে প্রকাশ্যে রিফাত শরীফ (২২) কুপিয়ে হত্যা করে নয়ন বন্ড ও তার সহযোগীরা। এ ঘটনায় নিহতের বাবা বাদী হয়ে বরগুনা সদর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় নয়ন ও রিফাত ফরাজীসহ ১২ জনের নাম উল্লেখ এবং আরও চার থেকে পাঁচজনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। এর মধ্যে সোমবার পর্যন্ত ৯ জনকে গ্রেফতারের কথা শোনা গেছে। পুলিশ সূত্র জানায়, গ্রেফতারদের মধ্যে চন্দন (২১), মো. হাসান (১৯), অলিউল্লাহ (২২) ও টিকটক হৃদয় (২১) এজাহারভুক্ত আসামি। এছাড়া নাজমুল ইসলাম (১৮), সাগর (১৯), তানভীর (২২), কামরুল হাসান ওরফে সাইমুন (২১) ও অপর একজনকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন