অধ্যাপক হাসান আব্দুল কাইয়ূম
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশী বিপর্যয়ের পর এ দেশের মুসলিমগণকে স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেন পীর মাশায়েখ ও উলামায়ে কেরাম। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে শহীদে বালাকোট সৈয়দ আহমদ বেরেলবী (রহ.) মুজাহিদ আন্দোলন পরিচালনা করেন। তারই পথ ধরে ফুরফুরা শরিফের পীর মুজাদ্দিকে খামান আমীরুশ, শরীতাত হযরত আবু বকর সিদ্দিকী (রহ.) আবির্ভূত হন। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিপ্লবের মাত্র ৫ বছর আগে ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দের বসন্তকালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন পশ্চিমবাংলার হুগলি জেলার ফুরফুরার ঐতিহ্যবাহী সিদ্দিকী পরিবারে। যখন তার বয়স মাত্র নয় মাস তখন তার আব্বা হাজী আব্দুল মুক্তাদির (রহ.) ইন্তেকাল করেন। তার আম্মা মুসাম্মাৎ মুহব্বতুন নিসা ছেলেকে বুকে আঁকড়ে ধরলেন, ছেলেকে বড় করার সামগ্রিক দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। তাকে উচ্চ শিক্ষিত করার দায়িত্ব পালন করলেন। আম্মার সরাসরি তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা করে মাদরাসা শিক্ষার উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করলেন। মদিনা মনওয়ারা থেকে লাভ করলেন সিহাহ সিত্তাসহ ৪০ খানা হাদিস গ্রন্থের সনদ। ইলমে তাসাওউফ হাসিল করার জন্য তিনি বায়আত গ্রহণ করলেন যুগশ্রেষ্ঠ পীর কামিল হযরত সুফী ফতেহ আলী ওয়াহিসী (রহ.)-এর নিকট। পীরের কাছ থেকে কাদিরীয়া চিশতিয়া নকশবন্দীয়া মুজাদ্দিদীয়া আওর মুহাম্মদীয়া তরিকার তা’লীম প্রাপ্ত হয়ে প্রতিটি তরীকায় পূর্ণ কামালিয়াত হাসিল করলেন। পীর তাকে খিলাফতনামা দিয়ে বললেন, বাবা আবু বকর। তুমি মুহিউস সুন্নাত এবং আমীরুশ শরী’আত হবে। পীর প্রদত্ত লকব দুটি অক্ষরে অক্ষরে প্রস্ফুটিত হয়েছে তার জীবনে। অচিরেই বলিষ্ঠ এবং কর্মউদ্দীপনা সবাই লক্ষ্য করেন এবং দলে দলে লোক এসে তার হাতে বায়’আত হয়ে জীবনকে সার্থক করে তোলেন। মুজাদ্দিয়াতের সমগ্র লক্ষণ তার কর্মতৎপরতায় ফুঠে ওঠে। জাতীয় জাগরণে তার অবদান শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা লাভ করে। তিনি প্রথম দিকে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের বঙ্গীয় প্রাদেশিক শাখার সভাপতি ছিলেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সম্মানিত সদস্য ছিলেন। পরে তার উদ্যোগে গঠিত হয় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাঙালা আসাম। তিনি শিরক বিদআত, কুফর অন্ধ বিশ্বাস ও কুংস্কার দূর করার জন্য গঠন করেন বক্তাদের সংগঠন আঞ্জুমানে ওয়ায়েজীন। এই তাজ্জুমান সমগ্র বাংলা আসামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করে জনগণের কাছে হিদায়েতের বাণী তুলে ধরতেন।
তিনি ফুরফুরা শরিফে ইসালে সওয়াজ মাহফিল কায়েম করেন। এই মাহফিলকে বলা হয় মাহফিলে ওয়াজ দরয়ামানে অ্যাঁ ইসালে সওয়াব। মূলত এটা এক বিশাল উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। এই মাহফিল সম্পর্কে তিনি বলেছেন : আমার বাড়িতে বছরের ২১/২২/২৩ শে ফাল্গুন তারিখ নির্ধারণ করিয়া একটি ওয়াজের মজলিশ করি। আমি জানি, আল্লাহ বলিয়াছেন : হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজদিগকে ও নিজেদের পরিজনকে অগ্নি হইতে রক্ষা কর। এই আয়াতের মর্ম অবলম্বনে আমার বাড়িতে দেশি-বিদেশি সকলকে আম দাওয়াত দিয়া বহু আলেম-ওলামা, হাফেজ, কারী কর্তৃক ওয়াজ নসিহত করাইয়া ও নিজে করিয়া শরিয়তের হুকুম আহকাম জানাইয়া দেই। যদি কোনো দেশে কোন মছলা লইয়া মতভেদ থাকে, তবে এই মাহফিলে থাকিয়া তাহার মীমাংসা করিয়া লন।
ফুরফুরা শরিফ ছাড়াও তিনি বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নির্ধারিত তারিখে এই মাহফিল করেন। যেমন : শর্শিনায় নির্দিষ্ট তিন দিন অগ্রহায়ণ মাসে, ফরিদপুর শরিফে ৪ঠা মাঘ তারিখে। তিনি মুষলে পরা বাংলার মুসলিম সমাজকে জাগিয়ে তোলেন। এদেশে মুসলিম সম্পাদিত কোনো পত্র-পত্রিকা ছিল না। তারই প্রত্যক্ষ চেষ্টায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় একের পর এক পত্র-পত্রিকা বের হয় : ইসলাম প্রচারক, মিহির সুধাকর, মোসলেম-হিতৈষী, আল ইসলাম, ইসলাম দর্শন, সুলতান, বঙ্গনূর, নবনূর, রওশনে হেদায়েত, শরিয়ত, শরিয়তে ইসলাম, ইসলাম জগৎ, হানাফী, হানাফী জমায়েত, আল মুসলিম, মোহাম্মদী, মোসলেম, সুন্নাতুল জামায়াত, আজাদ, হেদায়েত।
বাংলা ভাষা চর্চা মুসলিম মননে তিনি জাগিয়ে দেন। বহু পুস্তক প্রকাশে তার পৃষ্ঠপোষকতা লক্ষ্য করা যায়। তার পৃষ্ঠপোষকতায় প্রায় ১১০০ মাদরাসা এবং ৭০০ মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়।
তারই ইন্তেকালে সমগ্র দেশ শোকে মুহ্যমান হয়। দৈনিক আজাদ সম্পাদক মওলানা আকরাম খাঁ দৈনিক আজাদে এক দীর্ঘ নিবন্ধে বলেন : ‘তাহার (জনাব পীর সাহেবের) জীবনের বিভিন্ন দিকের অসাধারণ তৎপরতার পরিচয় দিতে যাওয়া আজ আমাদের পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব, তাহার অমায়িক ব্যবহার, তাহার অসাধারণ আখলাক এবং আমাদের প্রতি তাহার অশেষ ¯েœহের বর্ণনা করিতে যাওয়াও আজ আমাদের সাধ্যাতীত। তাহার লক্ষ লক্ষ মুরিদ ও গুণমুগ্ধ ভক্তের ন্যায় আমরাও আজ এই বিরাট অসাধারণ ব্যক্তিত্বের তিরোধানে শোকে অভিভূত।’
লেখক : মুফাস্্সিরে কোরআন, গবেষক, সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন