নুরুল আলম বাকু, দামুড়হুদা (চুয়াডাঙ্গা) থেকে
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত এক সময়ের খরস্রোতা ভৈরব নদ এখন মরা গাঙে পরিণত হয়েছে। বছরের অধিকাংশ সময় নদের বুকজুড়ে চলে ধান, ভুট্টা, সবজিসহ নানা ফসলের আবাদ। নানাভাবে ক্রমান্বয়ে নদীর তলদেশ ভরাট হওয়ায় হারাতে বসেছে এ নদের অস্তিত্ব ও ঐতিহ্য। এখন দেখলে মনে হবে কোনো নিচু জমিতে ইরি-বোরো ধান চাষ হচ্ছে। আসলে পূর্বে এটা ফসল আবাদের উপযোগী কোনো নিচু জমি ছিল না। এটাই ছিল এক সময়ের খরস্রোতা ভৈরব নদ। এখন নদের মাঝ বরাবর সরু নালার মতো খালের সৃষ্টি হয়েছে। জানা যায়, এই ভৈরব নদের উত্তাল স্রোতধারা এক সময় এলাকার মানুষকে দিয়েছে বেঁচে থাকার প্রেরণা। এক সময় যার ছিল পূর্ণ যৌবন। যে নদের উথাল-পাথাল ঢেউয়ে কাঁপত মাঝি মাল্লার বুক। সেই উথাল নদের বুক এখন পানিশূন্য। নদের দুই পাশের মানুষ নদের জমি দখল করে সেখানে ধান, ভুট্টাসহ নানা প্রকার ফসলের আবাদ করছে। আর এ আবাদ করতে গিয়ে প্রতি বছরই নদের পাড়ের মাটি কেটে জমি সমতল করছে। ফলে প্রতিবছর ব্যাপক হারে ভরাট হচ্ছে নদের বুক। নদের বুকে ফসলের আবাদ করে হাতেগোনা কিছু মানুষ উপকৃত হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দুই তীরের বিশাল জনগোষ্ঠী। বছরের পর বছর তলদেশে পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে নাব্যতা হারিয়ে শুকিয়ে গেছে এ নদ। দুই তীরে বসবাসকারী মানুষের নিত্যদিনের ব্যবহার্য পানি সমস্যা তো রয়েছেই, সাথে পানি না থাকায় তীরবর্তী জনপদে দেখা দিয়েছে মাছের আকাল। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে বৃহত্তর যশোর ও খুলনা জেলার প্রধান নদ-নদীগুলোর অন্যতম হচ্ছে এই ভৈরব নদ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার গঙ্গা এবং দক্ষিণাবাহী নদী জলঙ্গীর সাথে মিশে মিলিত স্রোত আরও কিছু দূর এসে ভৈরব নাম নিয়ে জলঙ্গি থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশের মেহেরপুর জেলার কাথুলিতে প্রবেশ করেছে। ২৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদের মেহেরপুরের সীমানায় রয়েছে ৫০ কিলোমিটার এবং দক্ষিণ-পূর্বদিকে চুয়াডাঙ্গা জেলায় প্রবেশ করে প্রায় ২৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে দামুড়হুদা উপজেলার সুবলপুরে মাথাভাঙ্গা নদীর সাথে মিশেছে। এটা মাথাভাঙ্গার উপ-নদ। মৃতপ্রায় এ নদের পানি প্রবাহ শেষ হয়ে যাওয়ায় খরা মৌসুমে পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। তার ওপর আবার স্থানীয় প্রভাবশালী দখলবাজরা নদের সরকারি জমি দখল করে পাড়ের মাটি কেটে সমান করে নানা ধরনের ফসলের আবাদ করছে। ফলে প্রতিবছর এভাবে মাটি কেটে সমান করায় তলদেশ ভরাট হয়ে নদের মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়েছে। এভাবে অনৈতিক পন্থায় চাষাবাদ ও নানাভাবে নদ ভরাট হতে থাকলেও এসব বন্ধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। সূত্রে জানা গেছে, কয়েক বছর আগে এ নদের মেহেরপুর জেলার কিছু অংশে খননকাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত দামুড়হুদা উপজেলার অংশে খনন কাজের কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে নদের আংশিক স্থান খননে তেমন কোনো সুফল পাওয়া যাবে না বলে অভিমত অভিজ্ঞদের। কারণ কিছু অংশ নদ করে নদের ¯্রােতধারা সৃষ্টি করা যাবে না। তাই নদের পুরা অংশ খনন না হলে তেমন কোনো লাভ হবে না। এ ছাড়া এ নদ খনন হলেও নদের পতনমুখের মাথাভাঙ্গা নদীর তলদেশ অপেক্ষাকৃত উঁচু হওয়ায় ¯্রােত বাধাগ্রস্ত হয়ে কয়েক বছরের মধ্যে পলি পড়ে নদ আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। উপজেলার নদ পাড়ের ধান্যঘরা গ্রামের বাসিন্দা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ দর্শনা সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রভাষক আবদুল গফুর বলেন, এই নদ এক সময়ে খুব খরস্রোতা ছিল। এই নদের তীরেই গড়ে উঠেছিল ঐতিহ্যবাহী কার্পাসডাঙ্গা বাজার। বাজারের পূর্ব দিকে ইংরেজরা নীল চাষের জন্য গড়ে তুলেছিল নীলকুঠি। এই কুঠিতে বসেই বেনিয়ারা পার্শ্ববর্তী এলাকায় নীল চাষের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করত। সেই সময়ে এ অঞ্চলে উৎপাদিত নীলসহ কার্পাসডাঙ্গা বাজার থেকে বিভিন্ন পণ্য বোঝাই বড় বড় নৌকা ভৈরব দিয়ে মাথাভাঙ্গা নদীপথে কলকাতা যেত। এক সময় এ নদে প্রচুর মাছ ছিল। এই মাছ শিকার করে নদপাড়ের শত শত মৎস্যজীবী তাদের জীবিকানির্বাহ করত। নদ শুকিয়ে যাওয়ার ফলে মাছ না থাকায় জেলে পরিবারগুলো বর্তমানে মানবেতর অবস্থায় জীবনযাপন করছে। আবার অনেকে বাধ্য হয়ে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় ঢুকে পড়েছে। নদের উজানে ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করার ফলে নদে পানির স্রোত না থাকায় বছরের পর বছর পলি পড়ে ও অবৈধভাবে নদের বুক দখল করে পাড়ের মাটি কেটে নদের বুক সমতল করার ফলে তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। হারাতে বসেছে এর ঐতিহ্য। এ নদ খনন এখন সময়ের দাবি। এ নদটির সাথে সাথে মাথাভাঙ্গা নদী খনন করে মাথাভাঙ্গা নদী ও ভৈরব নদের সংযোগস্থলে স্লুইসগেটসহ একটি বাঁধ নির্মাণ করে বর্ষার পানি ধরে রাখতে পারলে এই পানি ব্যবহার করে নদের দুই তীরের হাজার হাজার একর জমিতে ফসল ফলানো সম্ভব। এই পানি ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমবে, অপরদিকে এই পানিতে মাছ চাষ করে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করা সম্ভব হবে। সেই সাথে ভৈরব নদ ও মাথাভাঙ্গা নদী ফিরে পাবে তাদের হারানো ঐতিহ্য।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন