রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

চিকেন নেকে প্রতিবন্ধকতা কাম্য নয়

| প্রকাশের সময় : ৮ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

ভারতের সাথে বাংলাদেশের সাড়ে ৪ হাজার কিলোমিটারের বেশি স্থল সীমান্ত দিয়ে প্রতি বছর বৈধ-অবৈধভাবে যে পরিমান ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশ করছে তা একদিকে বাংলাদেশের উৎপাদন ব্যবস্থাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে, অন্যদিকে একতরফা বাণিজ্য সুবিধার কারণে বাংলাদেশের প্রতিকুলে ভারতের সাথে বাণিজ্য বৈষম্য ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এ ধরনের একতরফা বাণিজ্যিক সুবিধা আঞ্চলিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কোনো ইতিবাচক ফল দেয় না। মাত্র ২০- কিলোমিটার স্থল সীমান্ত করিডোরে ভারতের প্রতিবন্ধকতা না থাকলে নেপাল ও ভ’টানের সাথে বাংলাদেশের স্থল বাণিজ্য আরো অনেক বাড়ত। এরই পথ ধরে ভারতের প্রস্তাবিত বিবিআইএন সংযুক্তি বা উপাঞ্চলিক করিডোরের সুফল পাওয়া যেত। ভারতের সাথে ব্যাপক বানিজ্য বৈষম্য বিদ্যমান থাকা সত্তে¡ও নানা অজুহাতে বাণিজ্য জটিলতা, নিষেধাজ্ঞা ও অশুল্ক বাঁধা সৃষ্টি করে বৈষম্য আরো বাড়িয়ে চলেছে ভারত। এহেন বাস্তবতায়, আঞ্চলিক ও দেশীয় বাস্তবতাকে সামনে রেখে দেশসমুহের মধ্যে একটি গঠনমূলক আঞ্চলিক বানিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্কে গড়ে তোলার বিষয়ে কথা হচ্ছে দুই দশকের বেশী সময় ধরে। পূর্ব ও পশ্চিমা বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও ভারত নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে। ধরে বাস্তবায়নাধীন এশিয়ান হাইওয়ে এবং সাম্প্রতিত সময়ে চীনের রোডস এন্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভের সাথে বাংলাদেশ যুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করার পরও ভারতের প্রত্যক্ষ ও নেপথ্য ভ’মিকার কারণে এই সম্ভাবনাময় সড়ক যোগাযোগ নেটওর্য়াকের বিশাল সামাজিক- রাজনৈতিক- বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশে।

চলমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় কানেক্টিভিটিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আসিয়ানসহ আঞ্চলিক ও উপাঞ্চলিক জোট ও অর্থনৈতিক জোটগুলো দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা পালন করে চলেছে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই আশির দশকের শুরুতে দক্ষিণ এশিয়া সহযোগিতা ফোরাম হিসেবে সার্ক গঠণ করা হলেও সার্কের সবচেয়ে বড় অংশীদার হিসেবে ভারতের দায়িত্বহীন ভ’মিকার কারণে একটি অর্থবহ আঞ্চলিক ফোরাম হিসেবে সার্ক কখনো সত্যিকার অর্থে কার্যকর ভ’মিকা রাখতে পারেনি। মূলত: কাশ্মিরসহ আঞ্চলিক ইস্যুতে ভারত-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক দ্বন্দের কারণেই তা সম্ভব হয়নি, এ কথা দ্বিধাহীনভাবেই বলা যায়। তবে পাকিস্তানকে বাইরে রেখে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভূটানের একটি উপ-আঞ্চলিক জোট গঠনের প্রক্রিয়াও ভারতই শুরু করেছিল। দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলা এই উপ আঞ্চলিক জোটের মধ্যে প্রস্তাবিত সড়ক যোগাযোগের কানেক্টিভিটিকে কাজে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী করার যে সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে, অহেতুক সময় ক্ষেপণ ও আইনগত জটিলতা সৃষ্টির মাখ্যমে তা বাস্তবায়ণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অভিযোগের আঙুলও ভারতের দিকে। এর ফলে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভ’টান বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিকভাবে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এক অনন্য উচ্চতা লাভ করেছে বলে উভয় দেশের সরকারের তরফ থেকে মাঝে মধ্যেই বলা হচ্ছে। ডিজিটাল অগ্রগতি, কানেক্টিভিটি ইত্যাদি শব্দবন্ধগুলোও অহরহ শোনা যায়। কিন্তু চীন যখন সারা দুনিয়ার সাথে তার দেশসহ দক্ষিণ এশিয়াকে সড়ক রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত করে চলেছে তখনো দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারত তার দেশের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভ’টানের বাণিজ্যিক প্রয়োজনে মাত্র ২০-৩০ কিলোমিটারের করিডোর দিয়ে এই দুই দেশের সাথে বাংলাদেশের স্থল বাণিজ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বাস্তবতায় বহু আগেই পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতার মধ্য দিয়ে এসব ছোটখাট সমস্যা দূর হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। দুই দশক আগে(১৯৯৮ সালে) সম্পাদিত বাংলাদেশ- ভারত ফুলবাড়ি চুক্তি সম্পাদিত হলেও নানা বাহানা, আইনগত জটিলতা, শুল্ক ও অশুল্ক বাঁধা সৃষ্টির মাধ্যমে চুক্তির বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে ভারত। এমনকি বিবিআইএন এবং ২০০২ সালে বাংলাদেশ ভারত নেপাল ও ভ’টানের মধ্যে যে অবাধ বাণিজ্যের সমঝোতা হয়েছিল তা বাস্তবায়নে ভারতের সদিচ্ছার প্রতিফলন কখনো দেখা যায়নি। নিজের অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক স্বার্থ ও আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ঝুঁকি সত্বেও গত এক দশকে ভারতের চাহিদার প্রায় সবকিছুই দিয়েছে বাংলাদেশ। এমনকি নামমাত্র শুল্কে শত শত কিলোমিটারে নৌ ও স্থল ট্রানজিটের নামে ভারতকে বাণিজ্যিক করিডোর দিয়েছে বাংলাদেশ। পক্ষান্তরে গঙ্গা ও তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যাসহ বাংলাদেশের কোনো দাবীই পুরণ হয়নি। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ও স্থল করিডোর ব্যবহার করে ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে প্রায় বিনাশুল্কে পণ্য পরিবহনের সুযোগ পেলেও এসব বন্দরের সুবিধাসহ নেপাল ও ভ’টানের সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধির ব্যাপক সম্ভাবনা দাবিয়ে রাখতেই যেন ভারতের যত অপচেষ্টা। তবে অনেক বাঁধা বিপত্তি সত্তে¡ও নেপাল ও ভ’টানের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ভলিয়্যুম বেড়ে চলেছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা বড় প্রতিবেশি ও আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে ভারতের জন্য এটা শোভনীয় নয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন