শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

মুক্তাঙ্গন

তুচ্ছ সম্পদের মোহে আচ্ছন্ন মানুষ

প্রকাশের সময় : ৮ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ড. মুহাম্মদ এনামূল হক আজাদ
বর্তমান বিশ্বের মানুষ ঊর্ধ্বশ্বাসে সম্পদের পিছে দৌড়াচ্ছে। যেন সম্পদ অর্জনটাই মানুষের একমাত্র কাজ এবং এর জন্যই তার অস্তিত্ব ও তার জীবন। এ সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে তারা ন্যায়-অন্যায়, হালাল-হারাম, নৈতিক-অনৈতিক কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছে না। সমগ্র বিশ্বের সব মানুষের সব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে শুধুমাত্র এ লক্ষ্যেই। আজকের পৃথিবীর সব দেশের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাও পরিচালিত হচ্ছে শুধুমাত্র এ লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে। শিক্ষার্থীদেরকে গড়ে তোলা হচ্ছে শুধুমাত্র অর্থ-সম্পদ অর্জনের যোগ্য মেশিন হিসেবে। শুধু এ জন্যই উন্মোচিত হচ্ছে শিক্ষার নতুন নতুন দিগন্ত। কর্মের নতুন নতুন ক্ষেত্র। কেউ নিজেকে বা সন্তানকে যোগ্য অর্থ-সম্পদ অর্জনকারী হিসেবে দেখতে পেলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে যে, আমার জীবন স্বার্থক, আমি সফল, আমার সব কাজ সমাপ্ত, আমার দায়িত্ব পালন পরিপূর্ণ।
প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক বলেন, “প্রাচুর্যের লালসা তোমাদেরকে গাফেল রাখে। এমনকি তোমরা কবরে পৌঁছে যাও। এটা কখনও উচিত নয়। তোমরা সত্বরই জেনে নেবে” (তাকাসুর : ১-৩)। আল্লাহপাক আরো বলেন, “যে অর্থ সঞ্চিত করে ও গণনা করে, সে মনে করে যে, তার অর্থ চিরকাল তার সাথে থাকবে। কখনও না, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে পিষ্টকারীর মধ্যে। আপনি কি জানেন, পিষ্টকারী কী? এটা আল্লাহর প্রজ্বালিত আগুন। যা হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছবে। এতে তাদেরকে বেঁধে দেওয়া হবে। লম্বা খুঁটিতে” (হুমাযা : ১-৯)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে শিখখীর (রা.) বলেন, আমি একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট পৌঁছে দেখলাম তিনি সূরা তাকাসূর তিলাওয়াত করে বলছিলেন, “মানুষ বলে আমার ধন, আমার ধন, অথচ তোমার অংশ তো ততটুকু যতটুকু তুমি খেয়ে ফেল অথবা পরিধান করে ছিন্ন করে দাও অথবা সদকা করে সম্মুখে পাঠিয়ে দাও। এ ছাড়া যা আছে তা তোমার হাত থেকে চলে যাবেÑতুমি অপরের জন্য তা ছেড়ে যাবে” (ইবনে কাসীর, তিরমিযি, আহমদ, মাআরেফুল কোরআন)। হযরত আনাস (রা.) বর্ণিত এক রেওয়ায়েতে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “আদম সন্তানের যদি স্বর্ণে পরিপূর্ণ একটি উপত্যকা থাকে, তবে সে (তাতেই সন্তুষ্ট হবে না; বরং) দুটি উপত্যকা কামনা করবে। তার মুখ তো (কবরের) মাটি ব্যতীত অন্য কিছু দ্বারা ভর্তি করা সম্ভব নয়। যে আল্লাহর দিকে রুজু করে, আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন” (বুখারী, মাআরেফুল কোরআন)।
এই যে সম্পদ, যার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে মানুষ তার সমগ্র জীবনকে ব্যয় ও বিনাশ করছে, দ্বিধাহীন চিত্তে ও নির্ভয়ে এগিয়ে যাচ্ছে জাহান্নামের দরজার দিকে, কী তার মূল্য? কতটুকু তার সত্যিকার মূল্যমান? এ প্রসঙ্গে পবিত্র কালাম পাকে একটি সুন্দর বর্ণনা রয়েছে। মহান আল্লাহপাক বলেন, “যদি সব মানুষের এক মতাবলম্বী হয়ে যাবার আশঙ্কা না থাকত, তবে যারা দয়াময় আল্লাহকে অস্বীকার করে আমি তাদেরকে দিতাম তাদের গৃহের জন্যে রৌপ্য নির্মিত ছাদ ও সিঁড়ি, যার উপর তারা চড়ত এবং তাদের গৃহের জন্য দরজা দিতাম এবং পালংক দিতাম, যাতে তারা হেলান দিয়ে বসত এবং স্বর্ণ নির্মিতও দিতাম। এগুলো সবই তো পার্থিব জীবনের ভোগ সামগ্রী মাত্র। আর পরকাল আপনার পালনকর্তার কাছে তাদের জন্যই যারা ভয় করে” (যুখরুফ : ৩৩-৩৫)। এ বাণী থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, দুনিয়ার ধন-দৌলত আল্লাহর দৃষ্টিতে এত নিকৃষ্ট ও তুচ্ছ যে, সব মানুষের কাফের হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা না থাকলে তিনি সব কাফেরের ওপর স্বর্ণ-রৌপ্যের বৃষ্টি বর্ষণ করতেন। মূল্যহীন সম্পদ, পরিত্যক্ত বস্তু বা উচ্ছিষ্ট খাদ্য-সামগ্রী চোরে নিল না ডাকাত নিল, কুকুরে খেল না বিড়াল খেল, না পিঁপড়া খেলÑএতে যেমন আমাদের কোনো কিছু যায় আসে না।
আমরা এ ব্যাপারে তেমন কোনো চিন্তাÑআফসোস করি না। আল্লাহপাকের নিকটও সমগ্র পার্থিব সম্পদ অনুরূপ মূল্যহীন, পরিত্যক্ত ও উচ্ছিষ্ট। এটি মুসলিম খেল না কাফের খেল এতে তাঁর কিছু যায় আসে না। উপরন্তু পরকালীন মূল্যবান সম্পদে যেহেতু কাফেরদের কোনো অংশ নেই, তাই এ মূল্যহীন উচ্ছিষ্ট পার্থিব সম্পদের কিছু অংশ তাদেরকে কিছু দিন ভোগ করতে দিতে আল্লাহপাকের কোনো অনীহা নেই। কিন্তু বাঁধ সেঁধেছে মুমিনদের ঈমানের দুর্বলতা। পৃথিবীতে বসবাসকারী কিছু অবিশ্বাসীর জীবনে কিছু ধন-সম্পদ, প্রভাব প্রতিপত্তি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু প্রাচুর্যের স্পর্শ লাগলেও এখনো তা আল্লাহপাকের ঘোষিত স্বর্ণ-রৌপ্য বর্ষণের প্রাচুর্যের দূরতম নিকটেও যায়নি। এতেই আমরা বিশ্বাসীরা যেন খেই হারিয়ে ফেলেছি। ঊর্ধ্বাশ্বাসেÑচোখ বন্ধ করে তাদের অনুকরণে, অনুসরণে প্রাচুর্য লাভের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছি। আগ-পাছ চিন্তা করার সময় নেই। সময় নেই ভাবার ভালো-মন্দ, লাভ-অলাভ, কল্যাণ-অকল্যাণের। ধরেই নিয়েছি প্রাচুর্য মানেই উন্নতি, সম্পদের আধিক্য মানেই কল্যাণ। অথচ হযরত উকবা ইবনে আমের (রা.) নবী করীম (সা.) হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি ইরশাদ করেন, “যখন তোমরা দেখতে পাবে যে, আল্লাহতায়ালা কোনো ব্যক্তিকে তার অসংখ্য পাপ ও নাফরমানি সত্ত্বেও তার বাসনা অনুযায়ী দুনিয়ার অফুরন্ত নিয়ামত দান করিতেছেন, তখন মনে করবে যে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে ইস্তেদরাজ বা ঢিলদান ছাড়া আর কিছু না।” অতঃপর তিনি সূরা আন্-আমের ৪৪নং আয়াত পাঠ করেন। যার অর্থ “অতঃপর তারা যখন ওই উপদেশ ভুলে গেল যা তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল, তখন আমি তাদের সামনে সব কিছুর দ্বার উন্মুক্ত করে দিলাম। এমনকি যখন তারা প্রদত্ত নিয়ামত পেয়ে আনন্দে মেতে উঠল ও ভোগ-ব্যবহারে মগ্ন হলো, তখন আমি অকস্মাৎ তাদেরকে পাকড়াও করলাম। তখন তারা নিরাশ হয়ে গেল” (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস শরিফ)। আল্লাহর রাসূলের বাণী, “দুনিয়া যদি আল্লাহর কাছে মশার এক পাখার সমানও মর্যাদা রাখত, তবে আল্লাহতায়ালা কোনো কাফেরকে দুনিয়া থেকে এক ঢোক পানিও দিতেন না” (তিরমিযি, মাআরেফুল কোরআন)। আল্লাহর বাণী, “আর পার্থিব জীবন ধোঁকা ছাড়া অন্য কোনো সম্পদ নয়” (আলে ইমরান : ১৮৬)।
আল্লাহপাক আরও বলেন, “মানবকুলকে মোহগ্রস্ত করেছে নারী, সন্তান-সন্ততি, রাশিকৃত স্বর্ণ-রৌপ্য, নিশান লাগানো অশ্ব, গবাদি পশুরাজি এবং ক্ষেত-খামারের মতো আকর্ষণীয় বস্তুসামগ্রী। এসবই হচ্ছে পার্থিব জীবনের ভোগ্য বস্তু। আল্লাহর নিকট হলো উত্তম আশ্রয়। বলুন, আমি কি তোমাদেরকে এসবের চাইতেও উত্তম বিষয়ের সন্ধান বলব? যারা পরহেজগার আল্লাহতায়ালার নিকট তাদের জন্য রয়েছে বেহেশত, যার তলদেশে প্রস্রবণ প্রবাহিত, তারা সেখানে থাকবে অনন্তকাল। আর রয়েছে পরিচ্ছন্ন সঙ্গিনীগণ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি সুদৃষ্টি রাখেন” (আলে ইমরান : ১৪-১৫)। উল্লিখিত আল্লাহর বাণীতে দুনিয়ার মানুষের কয়েকটি প্রধান কাম্যবস্তু যা সাধারণভাবে মানুষ পেতে চায়, তার উল্লেখ করে বলা হয়েছে, “মানুষের অন্তরে এসবের প্রতি আর্কষণ স্বাভাবিক করে দেওয়া হয়েছে।” অপরদিকে হাদিসে বলা হয়েছে, “দুনিয়ার মহব্বত সব অনিষ্টের মূল।” তাই তো দেখা যায়, অনেক মানুষ এগুলোর বাহ্যিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে পরকালকে ভুলে যায়। অথচ মানুষের অন্তরে এগুলোর আকর্ষণ সৃষ্টি করার অন্যতম রহস্য হলো তাদের পরীক্ষা করা যে, কে এগুলোর আকর্ষণে মত্ত হয়ে পরকালকে ভুলে যায় এবং কে এসবের প্রকৃত স্বরূপ ও ধ্বংসশীল হওয়ার বিষয় অবগত হয়ে শুধু ততটুকু অর্জনে সচেষ্ট হয় যতটুকু তার প্রয়োজন এবং তা পরকালীন কল্যাণ লাভের লক্ষ্যেই ব্যয় করে। এ কথাই নিহিত রয়েছে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এ বাণীতে “দুনিয়া অভিশপ্ত এবং যা কিছু এতে আছে তাও অভিশপ্ত; তবে ঐসব বস্তু নয়, যদ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা হয়।” (মাআরেফুল কোরআন) এ কারণেই কয়েকটি লোভনীয় বস্তুর উল্লেখ করার পরই আল্লাহপাক বলেনÑ “এসবই হচ্ছে পার্থিব জীবনের ভোগ্য বস্তু। আল্লাহর নিকটই হলো উত্তম আশ্রয়।” অর্থাৎ এসব বস্তু হচ্ছে পার্থিব জীবনে ব্যবহার করার জন্য, যা ক্ষণস্থায়ী; মন বসাবার জন্যে নয়। আর আল্লাহর নিকট রয়েছে উত্তম ঠিকানা। সেখানে চিরকাল থাকতে হবে। যার নেয়ামত শেষ হবে না, হ্রাসও পাবে না। এর পরই আল্লাহপাক বলেন, “(হে রাসূল!) যারা দুনিয়ার অসম্পূর্ণ ও ধ্বংসশীল নেয়ামতে মত্ত হয়ে পড়েছে, আপনি তাদের বলে দিন যে, আমি তোমাদের আরো উৎকৃষ্ট নেয়ামতের সন্ধান বলে দিচ্ছি। যারা আল্লাহকে ভয় করে এবং যারা আল্লাহর অনুগত, তারাই এ নেয়ামত পাবে। সে নেয়ামত হচ্ছে সবুজ বৃক্ষলতাপূর্ণ বেহেশত, যার তলদেশ দিয়ে নির্ঝরণী সমূহ প্রবাহিত হবে। তাতে থাকবে সকল প্রকার কলুষমুক্ত পরিচ্ছন্ন সঙ্গিনীগণ এবং আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি।” রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “বুদ্ধিমান হচ্ছে সে ব্যক্তি যে আত্মসমালোচনা ও আত্ম-যাচাই করতে অভ্যস্ত এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য কাজ করে। পক্ষান্তরে দুর্বল ও সাহসহীন সে ব্যক্তি, যে নিজেকে প্রবৃত্তির লালসার দাস করে দিয়েছে এবং ইহা সত্ত্বেও সে আল্লাহর নিকট হতে অনুগ্রহের প্রত্যাশী” (তিরমিযি)।
এখন আমাদের চিন্তা করা দরকার যে, আমরা কি বুদ্ধিমান থাকব না দুর্বল-সাহসহীন হব? মহামূল্যবান সম্পদের অধিকারী হব না মূল্যহীন সম্পদের অধিকারী হব? ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার মূল্যহীন সম্পদের লোভে মোহাচ্ছন্ন থাকব না চিরস্থায়ী মহামূল্যবান উত্তম সম্পদের আকাক্সক্ষী হয়ে সজাগ হব? মহানবী (সা.) এর নি¤েœাক্ত হাদিসে এর উত্তর ও উত্তম সমাধান রয়েছে। আল্লাহপাক আমাদেরকে তা গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি দুনিয়াকে নিজের প্রিয়তম ও লক্ষ্যবস্তু রূপে গ্রহণ করবে, সে তার পরকালের বিশেষ ক্ষতিসাধন করবে। আর যে পরকালকে অধিকতর প্রিয় রূপে গ্রহণ করবে, সে অবশ্যই তার দুনিয়ার দিকের বড়ই ক্ষতিসাধন করবে। অতএব নশ্বর জগতের মোকাবিলায় স্থায়ী ও অক্ষয় পরকালকেই গ্রহণ কর” (মুসনাদে আহমদ, বায়হাকী, হাদিস শরিফ)।
ষ লেখক : সহকারী অধ্যাপক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন