রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মুক্তাঙ্গন

ভূগর্ভস্থ পানিতে বাড়ছে লবণাক্ততা

প্রকাশের সময় : ৮ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হেলেনা জাহাঙ্গীর
দেশের দক্ষিণ-প শ্চিামঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে মানুষ। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের গবেষক দল দক্ষিণবঙ্গের একাধিক উপজেলায় লবণাক্ততার পরিমাণ পেয়েছে ১০ পার্টস পার থাউজেন্ড (পিপিটি) মাত্রার বেশি। আগামী কয়েক দশকে তা দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদিও স্বাভাবিক অবস্থায় তা দশমিক ৫ পিপিটির মধ্যে থাকার কথা।
খুলনার দাকোপ উপজেলার একটি গ্রাম তিলডাঙ্গা। একসময় তিল উৎপাদনে আধিক্যের কারণেই এ নাম রাখা হয় গ্রামটির। নদীবাহিত হালকা পলিজ বালির কারণে এখানকার ভূমি তিলের জন্য বিখ্যাত ছিল। অথচ মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ফসলটির আবাদ বন্ধ হয়েছে পাঁচ-সাত বছর আগেই। এখন ধান আবাদও বন্ধের পথে। শুধু তিলডাঙ্গা নয়; লবণাক্ততার ভয়াবহ গ্রাসে সত্যপীর, চটবালিয়া, আঁধারমানিক ও নলডাঙ্গাসহ উপকূলীয় এ অঞ্চলের আরো অনেক গ্রাম। এখন আর কৃষিপণ্য উৎপাদন আগের মতো হচ্ছে না এসব গ্রামে। কয়েক বছর আগেও কিছু ধান আবাদ করা গেলেও এখন তাও করা যাচ্ছে না।
জাতিসংঘের আশঙ্কাজলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই অঞ্চলে দিন দিন লবণাক্ততার প্রভাব বাড়ছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আগামী ৩৫ বছরে এই অঞ্চলের আড়াই কোটি মানুষকে বাস্তুচ্যুত হতে হবে।
লবণ পানির ঊর্ধ্বমুখিতা বা প্রভাবের কারণে বাস্তুচ্যুত এসব মানুষ যাচ্ছে কোথায়? এমন প্রশ্নের অংশ বিশেষের জবাব রয়েছেÑ শহর-বন্দরের বস্তিতে। বাস্তুভিটা ছেড়ে এদের বৃহৎ অংশই কাজের খোঁজে শহর-বন্দরে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। সেখানে তারা থাকছে বস্তিতে বা সরকারি পরিত্যক্ত জায়গায় ঝুপড়ি তুলে। এদের পুরুষরা রিকশা চালায় বা জন-মজুরির কাজ করে। মেয়েরা ঘর সামলানোর পাশাপাশি বাসাবাড়ি বা মেসে কাজ করে। শহর-বন্দরে আসা বাড়তি এই জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার বাইরেই থেকে যায়। দুই-একটি ব্যতিক্রম বাদে এদের শিশুরা থাকে শিক্ষাবঞ্চিত। নারী-শিশুদের স্বাস্থ্য সমস্যা, পুষ্টি সমস্যা থাকে মূলধারার বাইরে। নগরে-বন্দরে এসে ঠাঁই নিলেও স্বপ্নহীন, সাধ্যহীন এক জনগোষ্ঠীই বেড়ে উঠছে এভাবে। শহর-বন্দরে এদের ঠাঁই দিতে বেড়ে উঠছে বস্তি ও ঝুপড়ি। জাতিসংঘের আশঙ্কা সত্য হলে আগামী ৩৫ বছরে যে আড়াই কোটি মানুষ শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে উচ্ছেদ হবে, তারাও ঠাঁই নেবে এখানে। তাহলে অবস্থা কী দাঁড়াবে সহজেই তা অনুমেয়। তাই এব্যাপারে করণীয় এখনই ঠিক করা দরকার।
বাস্তুচ্যুত মানুষ কোথায় আশ্রয় নিল তার চেয়ে বড় কথাÑ কেন মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, কীভাবে তা রোধ করা যায় তার উপায় খুঁজে বের করা। আমরা যতদূর জানি, গঙ্গায় ফারাক্কা বাঁধ দেওয়ার কারণেই এই অঞ্চলের নদ-নদীগুলো মরে যাচ্ছে। আর ওপর থেকে মিঠাপানির প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় বঙ্গোপসাগর থেকে ক্রমান্বয়ে লবণ পানি উজানে ধেয়ে যাচ্ছে। এভাবেই লবণাকৃত হয়ে যাচ্ছে এককালীন ফসলি জমি। ছারখার হয়ে যাচ্ছে জনজীবন। সভ্য জনগোষ্ঠী হারিয়ে ফেলছে তার পরিচয়। এই সমস্যার সমাধান করার ক্ষমতা আমরা রাখি কি না সে প্রশ্নও এখন ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ১৯ জেলার ১৪৮টি উপজেলার মধ্যে মাত্রাতিরিক্তভাবে লবণাক্ততায় আক্রান্ত হবে ১০টি উপজেলার নদীর পানি। এগুলো হলো সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালীগঞ্জ, খুলনার বটিয়াঘাটা, দাকোপ, ডুমুরিয়া, কয়রা, পাইকগাছা, বাগেরহাটের মংলা ও পটুয়াখালীর কলাপাড়া। এসব উপজেলায় এখন ১০ পিপিটি মাত্রার লবণাক্ততা বিরাজ করছে। আগামীতে তা ১৫-২৫ মাত্রায় উন্নীত হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণেই উপকূলীয় অঞ্চলের মাটিতে সমুদ্রের লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ঘটছে। ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। এছাড়া জলোচ্ছ্বাসের কারণে সমুদ্রের লবণ পানি উঁচু ভূমিতে উঠে আসে। পরে তা আর নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেয়া হয় না। নদীতে মিষ্টি পানির অভাব থাকায় লবণাক্ত পানি অপসারণ হচ্ছে না। এছাড়া পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের অভাব, উপকূলীয় নদ-নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় জোয়ারের সময় লবণাক্ত পানির বাঁধ উপচে লবণাক্ততা বাড়ছে। সার্বিকভাবে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি অভ্যন্তরীণ কৃষিজমিতে চলে আসায় কৃষিজমির লবণাক্ততা বাড়ছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে জমির স্বাভাবিক উৎপাদনক্ষমতা।
জানা গেছে, উপকূলীয় এসব অঞ্চলের মাটিতে লবণাক্ততা বেশি থাকায় মাইক্রোবিয়াল অণুজীবের কার্যক্রম এবং মাটির জেবপদার্থ, নাইট্রোজেন ও ফসফরাসের সহজলভ্যতা কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে কপার আর জিংকের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। তবে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের জন্য কিছুটা লবণাক্ততা হ্রাস পায় বলেই বেশকিছু এলাকায় ধান বিশেষ করে আমন আবাদ হয়। তবে মৌসুমের শেষের দিকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়ায় ফসলে দানার সংখ্যা কমে যায়। এতে ফলন ঠিকমতো পান না কৃষক। আর বৃষ্টিপাত কমার কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত জমির পরিমাণ বাড়ছে। এছাড়া সিডর ও আইলার মতো উচ্চমাত্রার জলোচ্ছ্বাসের কারণে এ অঞ্চলের অনেক এলাকায় এখন শস্য আবাদ বন্ধ হয়ে গেছে।
এর মধ্যে আইলা উপদ্রুত দাকোপ উপজেলার দুটি ইউনিয়নের প্রায় ৭ হাজার ২০০ হেক্টর চাষাবাদযোগ্য জমির মধ্যে প্রায় ৬ হাজার ৫০০ হেক্টরে আমন চাষ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ উপজেলার কামারখোল ও সুতারখালী ইউনিয়নের প্রায় ৩৫টি গ্রাম আমন চাষাবাদে সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে আইলাদুর্গত খুলনার কয়রা উপজেলার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নে দুই বছর ধরে তিন হাজার বিঘা জমিতে ধান চাষ করা যাচ্ছে না। পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
ভৌগোলিক অবস্থান এবং উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে খুলনা অঞ্চলে একসময় উদ্ভিদের সমারোহ থাকলেও কালক্রমে তা হারিয়ে গেছে। অর্ধ শতকের ব্যবধানে দেশের দক্ষিণাঞ্চল খাদ্য উদ্বৃত্ত থেকে এখন ঘাটতির জেলায় পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, জমিতে একাধিক ফসল ফলানো বা ক্রপ ইনটেনসিটিতে পিছিয়ে পড়েছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বৃহত্তর খুলনা জেলা। সার্বিকভাবে দেশে ফসল নিবিড়তা ১৮৩ হলেও খুলনায় মাত্র ১২৭ শতাংশ।
উপকূলীয় অঞ্চলে দেশের প্রায় ৩২ শতাংশ ভূমিতে বসবাস করছে প্রায় চার কোটি মানুষ, যা মোট জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ। এ অঞ্চলের মাত্র ৩০ শতাংশ জমি এখন চাষযোগ্য। এছাড়া ১৭ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে মাছ চাষসহ অন্যান্য কাজে। ৫৩ শতাংশ জমি পতিত রয়েছে শুধু লবণাক্ততার কারণে। চাষযোগ্য ৩০ শতাংশ জমি আবার পরিপূর্ণভাবে উৎপাদনে কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না।
ষ লেখক : চেয়ারম্যান, জয়যাত্রা ফাউেন্ডশন

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন