মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

অলিম্পিক গেমসের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিবর্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ আলী ও বাংলাদেশ

প্রকাশের সময় : ৮ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী
সর্বকালের সেরা মুষ্টিযোদ্ধা, শতাব্দীর সেরা মার্কিন নাগরিক ‘দ্য গ্রেটেস্ট’ মোহাম্মদ আলী গত ৩ জুন শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় ফিনিক্স এরিনা হাসপাতালে ৭৪ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। কেনটাকির লুইভিলে ১৯৪২ সালের ১৭ জানুয়ারি খ্রিস্টান দম্পতি ক্যাসিয়াস মারসেলাস ক্লে এবং ওডিসা গ্ল্যাডি ক্লে’র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পিতা নিজের নামের সাথে মিলিয়ে সন্তানের নাম রেখেছিলেন ক্যাসিয়াস মারসেলাস ক্লে জুনিয়র। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, আলীর মৃত্যু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের চড়াই-উৎরাই ও অমানবিক বর্ণবৈষম্য সম্পর্কে একটি নতুন মূল্যায়নে উপনীত হওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে। বিশেষত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসনবিরোধী, বর্ণবাদী ও ইসলামবিদ্বেষী ভূমিকা নিয়ে আবির্ভূত হওয়ার এই সময় মানবতাবাদের অকুতোভয় কণ্ঠস্বর মোহাম্মদ আলীর আকস্মিক চিরবিদায় আমাদেরকে ইতিহাসের সেসব চরম বাস্তবতার পর্যালোচনায় প্রলুব্ধ করে। সেই সাথে বিশ্ব অলিম্পিকের অতীত-বর্তমানের বিবর্তনের ধারায়ও আমাদের জন্য কিছু ঐতিহাসিক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। সর্বকালের সেরা মুষ্টিযোদ্ধা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইকনিক সেলিব্রেটি এবং মার্কিন মুসলমানদের অন্যতম প্রেরণার উৎস মোহাম্মদ আলীর সাথে বাংলাদেশের নাগরিকদেরও আত্মিক সম্পর্কের এক নিবিড় সেতুবন্ধন ছিল।
আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম মুসলমান বংশোদ্ভূত একজন আফ্রো-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ বারাক হোসেন ওবামা হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো দায়িত্ব পালন শেষে অবসর গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আড়াইশ বছরের ইতিহাসে এটি একটি অনন্য সাধারণ ঘটনা। এই ঘটনা মার্কিন গণতন্ত্রে হোয়াইট সুপ্রিমেসি বা বর্ণবাদের গ্যাঁড়াকল থেকে বেরিয়ে আসার প্রথম স্বাক্ষর হিসেবে বিবেচিত হবে। অবশ্য পশ্চিমা ঔপনিবেশিকতা থেকে বর্ণবাদে আক্রান্ত মার্কিন সমাজে কালা আদমিদের ন্যূনতম মানবীয় মর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রো-আমেরিকান, হিস্পানিক ও এশিয়ানদের অনেক লড়াই-সংগ্রাম ও কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। এ জন্য মার্টিন লুথার কিং, ম্যালকম-এক্স, এলিজা মোহাম্মদদের সারাজীবন ব্যয় করতে হয়েছে। ন্যাশন অব ইসলামের সাংগঠনিক তৎপরতার পাশাপাশি জনএফ কেনেডির মতো জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী প্রেসিডেন্টকেও মার্কিন সমাজের সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার লড়াইয়ে জীবন দিতে হয়েছে। বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে মার্কিন ফাউন্ডিং ফাদারদের স্বপ্নের আমেরিকা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের মূল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল সেখানকার আফ্রো-আমেরিকান বা কৃষ্ণাঙ্গরা। মার্কিন বর্ণবাদের ভিতকে নাড়িয়ে দিয়ে ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটন ডিসির লিঙ্কন মেমোরিয়ালের সামনে বর্ণবাদবিরোধী লাখো মানুষের সামনে মার্টিন লুথার কিং যে বক্তৃতা করেছিলেন, ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’ শিরোনামে সেই বক্তৃতা মার্কিন ইতিহাসে এক অনন্য উচ্চতায় স্থান পেয়েছে। বর্ণবাদবিরোধী এই বক্তৃতাকে আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিসবার্গ বক্তৃতার সাথে তুলনা করা হয়। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদী গোষ্ঠী, সা¤্রাজ্যবাদ ও ইহুদি প্রভাবিত মিডিয়া ও রাজনৈতিক থিঙ্কট্যাঙ্কগুলো মার্টিন লুথার কিংকে ন্যাশন অব ইসলামের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। মার্টিন লুথার কিং এবং ম্যালকম-এক্স গুপ্তহত্যার শিকার হওয়ার ঘটনার দায়ও ন্যাশন অব ইসলাম নেতাদের ওপর চাপিয়ে আইনগত হয়রানিসহ তাদের মনোবল ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করতে দেখা গেছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সম্ভাবনাময় আফ্রো-আমেরিকানদের বেশিরভাগ তাদের পূর্বপূরুষের দাসত্বের ইতিহাস ও মনোজাগতিক শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র বিকল্প হিসেবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিশ্বদর্শন হিসেবে ইসলামকেই বেছে নিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম আইকনিক মার্কিন নাগরিক মোহাম্মদ আলী তাদেরই অন্যতম । মোহাম্মদ আলীই প্রথম পশ্চিমা বিশ্বের কাছে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন। তিনি দাসত্বের পরিচয়বাহী ক্যাসিয়াস ক্লে নাম পরিত্যাগ করে ‘মোহাম্মদ আলী’ নাম গ্রহণ করেছেন। ষাটের সেই উত্তুঙ্গ সময়ে মোহাম্মদ আলী ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশগ্রহণের রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করার পাশাপাশি এই অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে মার্কিন জনমত গঠনে বিশাল ভূমিকা রেখেছিলেন। ‘টু মেক আমেরিকা দ্য গ্রেটেস্ট ইজ মাই গোল, সো আই বিট দ্য রাশিয়ান অ্যান্ড বিট দ্য পোল অ্যান্ড ফর দি ইউএসএ অউন দ্য মেডেল অব গোল্ড। দি গ্রিকস সেইড ইউ আর বেটার দ্যান কেসিয়াস অব ওল্ড’ মাত্র ১৮ বছর বয়সে রোম অলিম্পিকে লাইট-হেভিওয়েট বক্সিংয়ে শিরোপা জেতার পর তৎকালীন কেসিয়াস মারসেলাস ক্লে প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠে এভাবেই নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। দ্বিতীয়বার অলিম্পিক গোল্ড মেডেল জেতার পর তিনি লাইভ মিডিয়ায় ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘কেসিয়াস ক্লে হচ্ছে একজন ক্রিতদাসের নাম, এই নাম আমি পছন্দ করি না, আমি এই নাম চাই না, আমি এখন মোহাম্মদ আলী, একজন মুক্ত মানুষ এবং আমি সকলকে বলব এখন থেকে আমাকে মোহাম্মদ আলী নামে সম্বোধন করতে এবং আমার সম্পর্কে কিছু বলতে বা লিখতে হলে এ নাম ব্যবহার করবেন।’ মোহাম্মদ আলীর সেই সাহসী ও প্রত্যয়দীপ্ত আহ্বানকে কেউ অগ্রাহ্য করতে পারেনি। কারণ তিনি অলিম্পিকে তিন তিনবার শিরোপা জিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকাকে বিশ্বের কাছে আরো উজ্জ্বল ও সম্মানিত করেছেন। সাদা চামড়ার ডোনাল্ড ট্রাম্প বা তার পূর্বপুরুষ যা কখনো করতে পারেননি। আমেরিকান সিভিল ওয়ার তথা ঔপনিবেশিক যুগের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার যুদ্ধ থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রথমে কৃষিপ্রধান দেশ থেকে একটি শিল্পসমৃদ্ধ বিশ্ব অর্থনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করার সুবিশাল ঐতিহাসিক কর্মযজ্ঞে এশিয়া-আফ্রিকা থেকে অভিবাসী কাল আদমিদের ভূমিকা সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। শত শত বছর আগে ম্যালকম-এক্স, ক্যাসিয়াস ক্লে, লেরয় জোনস, বারাক ওবামা অথবা মাইকেল জ্যাকসনের পূর্বসূরিরা দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি হয়ে আমেরিকায় অভিবাসী হয়ে নিজেদের মানবিক মর্যাদার শিখরে উত্তীর্ণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে গৌরবান্বিত ও বিশ্বশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে অনবদ্ধ ভূমিকা পালন করেছেন।
ক্যাসিয়াস মারসেলাস ক্লে ধর্মান্তরিত হয়ে ‘মোহাম্মদ আলী’ হয়ে যাওয়ার পরও এ নাম বিংশ শতকের এক মহত্তম মার্কিন নাগরিকের নাম হিসেবে ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে অঙ্কিত হয়ে থাকার পেছনে রয়েছে অলিম্পিকের গৌরবময় মর্যাদার আসন। অলিম্পিক গেমসে শক্তিমত্তার প্রদর্শন বিশ্ব সভ্যতায় আধিপত্যের সমার্থক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এই গেমসের শুরু থেকেই। তবে অলিম্পিক গেমস ঐতিহাসিকভাবে প্রাচীন ও আধুনিক এই দুটি পর্যায়ে বিভক্ত। যতদূর জানা যায়, প্রাগৈতিহাসিক যুগে শুরু হওয়া অলিম্পিক গেমস খ্রিস্টপূর্ব ৫ম ও ৬ষ্ঠ শতকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকে রোমানদের দ্বারা গ্রিক সভ্যতা অধিকৃত হওয়ার আগ পর্যন্ত টিকেছিল। বিশেষত রোমান স¤্রাট প্রথম থিওডোসিয়াস ৩৯৩ সালে সকল পৌত্তলিক সংস্কৃতি নির্মূলের ঘোষণা দিয়ে একটি ডিক্রি জারি করার মধ্য দিয়ে প্রাচীন অলিম্পিক গেমসের প্রাথমিক সমাপ্তি পর্বের সূচনা হয়। থিওডোসিয়াসের উত্তরসূরি দ্বিতীয় থিওডোসিয়াস সিংহাসনে আরোহণের পর খ্রিস্টীয় ৪২৬ সালে সব গ্রিক টেম্পল ধ্বংসের হুকুম জারির মধ্য দিয়ে প্রাচীন গ্রিসের ঐতিহ্যবাহী অলিম্পিক গেমসের যবনিকাপাত ঘটে বলে কোনো কোনো ঐতিহাসিক মত দিচ্ছেন। প্রাচীন অলিম্পিকের সাথে যেমন তৎকালীন সা¤্রাজ্যের নিয়ন্ত্রকদের পৃষ্ঠপোষকতা ও আধিপত্যের সম্পর্ক ছিল, একই সাথে তাদের প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস তথা গ্রিক পুরানের দেবতাদের প্রভাবও ছিল অবিচ্ছেদ্য রূপে। মূলত গ্রিক দেবতাদের যুদ্ধবিগ্রহের কাহিনীর ওপর ভিত্তি করেই প্রাচীন গ্রিসে এই ক্রীড়াযজ্ঞ পালিত হতো। রোমানদের হাতে গ্রিসের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে অলিম্পিক গেমস বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রায় দেড় হাজার বছর পর ঊনবিংশ শতকে উসমানীয় সা¤্রাজ্যের বিরুদ্ধে গ্রিসের পুনরুত্থান ও পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের উচ্চাভিলাষ থেকেই অলিম্পিকের নবজন্ম। অষ্টাদশ শতকের শেষপ্রান্তে এসে ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি পশ্চিমা ইউরোপীয় রেঁনেসার যুগে প্রবেশ ও নতুন সা¤্রাজ্যবাদের সূচনা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ইউরোপীয় সভ্যতা তার পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে প্রাচীন অলিম্পিকের অনুকরণে আন্তর্জাতিক ক্রীড়া জগতের একটি বিশ্ব ইভেন্ট শুরুর উদ্যোগ বাস্তবতা লাভ করে। ফরাসি বিপ্লবের সময় ১৭৯৬ এবং ৯৮ সালে ফ্রান্সে ন্যাশনাল অলিম্পিক ফেস্টিভ্যাল উদযাপনের মধ্য দিয়ে আধুনিক অলিম্পিকের প্রাথমিক যাত্রা শুরুর কথা বলা হলেও মূলত এটি শুরু হয়েছিল ১৮২১ সালে উসমানীয় খিলাফতের কাছ থেকে গ্রিসের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক তৎপরতার মধ্য দিয়ে। কনস্টানটিনোপল বা আধুনিক তুরস্কের ইস্তাম্বুলে জন্মগ্রহণকারী একজন গ্রিক বংশোদ্ভূত কবি ও সাংবাদিক প্যানাজিওটিস সাওৎসাস তৎকালীন গ্রিক ধনকুবের ইভানজেলোশ জাপাসকে অলিম্পিকের হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি গঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আঠারশ ষাটের দশক থেকে ১৮৮৮ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমস ইভেন্টগুলো জাপাসের পৃষ্ঠপোষকতা বা অর্থানুকূল্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ কারণে ইভানজেলোশ জাপাসকে আধুনিক অলিম্পিকের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
প্রাচীন গ্রিসের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের এই প্রেক্ষাপট থেকে বিশ্ব মুসলমানেরও অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। বিশ্বের ক্ষয়িষ্ণু জাতিরাষ্ট্রগুলোর চিন্তাশীল নাগরিকরাও এ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। মুসলমানদের কাছ থেকে গ্রীসের জাতিগত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করার পাশাপাশি পশ্চিমা অর্থনৈতিক সা¤্রাজ্যবাদের একটি মজবুত ঐক্যের গাঁটছড়া তৈরি করতে গিয়ে হাজার বছর আগে অবলুপ্ত প্রাচীন অলিম্পিক গেমসকে ব্যবহার করার উদ্যোগ পরবর্তীতে একটি সাংস্কৃতিক আধিপত্যের স্মারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং সাম্প্রতিক কয়েক দশকে গণচীন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে অলিম্পিকের পদক তালিকার প্রথম সারিতেই শুধু অবস্থান নেয়নি, সেই সাথে পশ্চিমা দুনিয়ার বাইরে তারা অলিম্পিকের আয়োজক বা হোস্ট রাষ্ট্র হওয়ারও ‘যোগ্যতা’ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। তবে অদ্যাবধি কোনো মুসলমান রাষ্ট্র সামার অলিম্পিকের আয়োজক দেশ হওয়ার স্বীকৃতি পায়নি। অলিম্পিকের সাথে এখানেই কোথায় যেন একটি নীতিগত অবস্থানের গোপনীয়তা লুক্কায়িত আছে। ভিন্নভাবে বলা যায়, পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে কোনো মুসলমান রাষ্ট্র সামার অলিম্পিক গেমস আয়োজনের অর্থনৈতিক বা অবকাঠামোগত সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো অর্ধশতাধিক মুসলমান রাষ্ট্রকে তাদের ক্লায়েন্ট স্টেট হিসেবে হাজার হাজার কোটি ডলারের ভোগ্যপণ্য ও সমরাস্ত্রের বাজার হিসেবে দেখলেও কখনো অলিম্পিক গেমসের আয়োজক হওয়ার অবস্থানে দেখতে চায় না। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ শতাধিক রাষ্ট্রের পতাকা নিয়ে অলিম্পিকে অসংখ্য মুসলমান নানা ইভেন্টে অসংখ্য শিরোপা জয়লাভ করেছে। বরং সর্বকালের সেরা অ্যাথলিটদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ ও মুসলমান পুরুষ ও নারীর সংখ্যাই তুলনামূলকভাবে বেশি। মোহাম্মদ আলী তাদেরই একজন।
মোহাম্মদ আলী ১৮ বছর বয়সে প্রথমবারের মতো লাইটওয়েট বক্সিংয়ে সোনা জিতে চমক সৃষ্টির বছর ১৯৬০ সালের রোম অলিম্পিকে মোহাম্মদ আলীর প্রায় সমবয়সী একজন মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ নারী এথলিট উইলমা রুডল্ফ ১০০ মিটার, ২০০ মিটার ও ৪০০ মিটার রিলে রেসে সোনা জিতে অভাবনীয় চমক সৃষ্টি করেছিলেন। ১৯৯৪ সালে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে ৫৪ বছর বয়সে উইলমা রুডলফ টেনেসির ন্যাশভিলে মৃত্যুবরণ করার ২ বছর পর টেনেসির গভর্নর উইলমা রুডলফের জন্মদিন ২৩ জুনকে টেনেসিতে ‘উইলমা রুডলফ ডে’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ ছাড়া তার নামে রাস্তা, স্কুল, অ্যাওয়ার্ডসহ অনেক কিছুই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে তিনবারের বক্সিং চ্যাম্পিয়ন এবং আজীবন মানবাধিকারের অন্যতম সংগ্রামী, জাতিসংঘের অন্যতম শান্তিদূত মোহাম্মদ আলীর জন্য মার্কিন সরকার কী ভূমিকা নেয় তাই এখন দেখার বিষয়। মুসলমান এবং কালো হওয়ার ‘অপরাধে’ মোহাম্মদ আলী মার্কিন সমাজের কাছে প্রাপ্য অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হয়েছেন, ভবিষ্যতেও হয়তো তিনি কিছু মানুষের কাছে মরণোত্তর অবমূল্যায়ন ও বৈরিতার শিকার হবেন। এ জন্য তিনি শুরু থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। ১৯৬৪ সালে সনি লিস্টনের সাথে হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াইয়ের আগে সেই প্রতিযোগিতাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি বর্ণবাদী চরিত্র লাভ করেছিল। সাদা চামড়ার বর্ণবাদীরা মোহাম্মদ আলীকে একজন কালো আদমি হিসেবে তার পরাজয় প্রত্যাশা করছিল। সে সময়ের মার্কিন বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব ম্যালকম এক্স মোহাম্মদ আলীকে মানসিকভাবে গড়ে তুলতে গিয়ে যে উদ্দীপনামূলক বক্তব্য রেখেছিলেন, তার সারসংক্ষেপ অনেকটা এমনÑ ‘তুমি তখনি স্বাধীনতা পাবে যখন তুমি তোমার প্রতিপক্ষকে বোঝাতে পারবে যে, স্বাধীনতার জন্য তুমি যে কোনো কিছু করতে প্রস্তুত আছ। স্বাধীনতার জন্য এটাই একমাত্র পথ। তুমি যখন মানসিকভাবে সে ধরনের ভূমিকা নিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করবে, তারা তখন তোমার গায়ে ‘ক্রেজি নিগ্রো’র বদনাম এঁটে দিতে চাইবে। অথবা তোমাকে একজন এক্সট্রিমিস্ট, চরমপন্থি, র‌্যাডিক্যালিস্ট অথবা রাষ্ট্রদ্রোহী তকমা দিয়ে তোমাকে থামিয়ে দিতে চাইবে। কিন্তু তুমি যদি নিজের র‌্যাডিকেল অবস্থানে অনড় থাক যতক্ষণ না বিপুল সংখ্যক মানুষ তোমার অবস্থানকে সমর্থন করতে শুরু করবে, তখনই তুমি স্বাধীনতা লাভ করবে।’ মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী এবং মানবাধিকার প্রত্যাশী কালোদের প্রতি অর্ধশত বছর আগে ম্যালকম-এক্স এর এই বক্তব্য আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমান শুধু নয়, মুসলিম বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্বের শোষিত-নিপীড়িত সব মানুষের জন্যও সমভাবেই প্রযোজ্য।
বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং ইসলামী মূল্যবোধ সম্পৃক্ত জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রবক্তা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মোহাম্মদ আলীর সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক চেতনাকে যথার্থভাবেই অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বর্ণবৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে আজীবন প্রতিবাদী ও সংগ্রামী মোহাম্মদ আলীর জীবন বিশ্বের সব মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণার উৎস। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমন্ত্রণে ১৯৭৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সপরিবারে (আলীর বাবা, মা, ছোটভাই, দ্বিতীয় স্ত্রী ও কন্যা লায়লা আলীকে নিয়ে) বাংলাদেশ সফরে আসেন মোহাম্মদ আলী। সপ্তাহব্যাপী বাংলাদেশ সফরে বাংলাদেশের সিলেট ও বান্দরবনের পাহাড়, সুন্দরবনসহ নানাপ্রান্ত ঘুরে বেরিয়েছিলেন। সে সময় তিনি বাংলাদেশকে একটি ‘বেহেশত’ বলে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া তাকে ‘সম্মানসূচক’ বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পাসপোর্ট এবং নাগরিকত্ব সনদপত্র হস্তান্তর করেছিলেন। ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রদত্ত গণসংবর্ধনায় মোহাম্মদ আলী বলেছিলেন, যদি কখনো যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাকে সে দেশ থেকে বের দেয়, তবে তিনি বাংলাদেশে এসে বসবাস করবেন। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম খ্যাতিমান ও প্রভাবশালী মার্কিন নাগরিক মোহাম্মদ আলী আরো বহু দেশ থেকে বহু সম্মাননা ও স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। তবে বাংলাদেশকে তার ভালোলাগা ও ভালোবাসার স্বীকৃতি এ দেশের মানুষকে আপ্লুত করেছে। আমাদের প্রজন্ম বাল্যকাল থেকে মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের অতি উচ্চ আইকনিক আসনে বসিয়েছিলাম। তার বেড়ে ওঠা, ইসলামের সর্বজনীন সাম্য, শান্তি ও মানবাধিকারের পক্ষে তার আমৃত্যু লড়াই বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষের জন্য অনন্য প্রেরণাদায়ী হয়ে থাকবে। মোহাম্মদ আলীকে বাংলাদেশের নাগরিকত্বে ভূষিত করার মধ্য দিয়ে এ দেশের জনগণের সাথে মোহাম্মদ আলীর যে আত্মিক সেতুবন্ধন রচিত হয়েছিল তার স্বাক্ষর হিসেবে আমাদের সরকার যদি সর্বকালের সেরা এই মুষ্টিযোদ্ধা ও মানবাধিকার কর্মীর স্মৃতির প্রতি সম্মানে বাংলাদেশের কোনো বড় প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করেন, আমাদের ধারণা, দেশের ১৬ কোটি মানুষই অকুণ্ঠচিত্তে তা সমর্থন জানাবে। বাংলাদেশের অনেক খ্যাতিমান নাগরিক আমেরিকায় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন, সেখানকার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখছেন। অনেক বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে নিজেদের সেকেন্ড হোম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এখন আমরা এখন এই দাবিও করতে পারছি যে, শতাব্দীর অন্যতম সেরা মার্কিন নাগরিক তিনবারের অলিম্পিক স্বর্ণজয়ী মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীও বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন এবং ক্ষরা-বন্যা, দুর্ভিক্ষের বদনামপ্রাপ্ত এ দেশটিকে বিশ্বের কাছে ‘বেহেশত’ হিসেবে আখ্যায়িত করে নিজের সেকেন্ড হোম হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন। ১৯৮৪ সালের লস এঞ্জেলেস অলিম্পিক থেকে ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিক পর্যন্ত বিশ্ব অলিম্পিকের ৮টি আসরে বাংলাদেশের অ্যাথলিটরা অংশগ্রহণ করলেও এ পর্যন্ত কেউ পদক পাওয়া দূরের কথা প্রতিযোগিতায় পদকের কাছাকাছিও পৌঁছতে পারেননি। একমাত্র মোহাম্মদ আলী ছাড়া বিশ্বের আর কোনো অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশকে এতটা আপন করে নেননি। মোহাম্মদ আলীর জন্য আমরা গর্বিত। তার মৃত্যু আমাদের জন্য শোকের এবং বেদনার, আমাদের সরকার এই বার্তা বিশ্বের কাছে তুলে ধরবে, এই প্রত্যাশা দেশবাসীর। আগামী শুক্রবার নিজ শহর কেনটাকির লুইভিলে ইসলামী রীতি অনুযায়ী মোহাম্মদ আলীর জানাজা দাফন ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হবে, শেষ বিদায়ের অনুষ্ঠানে সব ধর্মের মানুষকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে তার পরিবার। মোহাম্মদ আলীর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে আমাদের দেশের কোনো প্রতিনিধি হাজির থাকলে দেশের মানুষ কিছুটা স্বস্তিবোধ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন