পরপর একই স্থানে একই ঘটনা দুইবার ঘটা অস্বাভাবিক। ‘বিচিত্র এই পৃথিবীতে কোন কিছুই অসম্ভব নয়’ বাক্যটি বিশ্বাস করলে, খুবই স্বাভাবিক। দুইটি ঘটনার দারুণ মিল। সূচনা এক হলেও সমাপ্তি বিপরীত। একটি শুরু হয়ে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই শেষ। আরেকটি নদীর মতো সারাজীবন বয়ে চলে। শুকিয়ে গেলেও স্রোতের দাগ থেকে যায়।
তখন মোবাইলের যুগ ছিল না। যোগাযোগের জন্য ল্যান্ড ফোন বা সশরীরে হাজির হওয়াই উপায় ছিল। এটা ব্যক্তির ইচ্ছার উপর নির্ভর করত। সেই সময়ে ঘটনা দুইটি ঘটে।
মে মাসের প্রচন্ড গরম। সকালের শুরুতেই সূর্য রক্তবর্ণ। পৃথিবী পুড়িয়ে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাসে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে সকাল ১১টায় ফার্মগেইট নামে আজাদ। তেতে উঠা সূর্য তার ছোটখাটো শরীর পুড়িয়ে দিচ্ছে। ঘামে চুপচুপ। শার্ট ভিজে ভোটকা গন্ধ বের হচ্ছে। কোঁকড়া চুলের ডগায় ঘাম বিন্ধু হয়ে জমে ফুলে উঠে টুপ টুপ পড়ছে। পুরু চশমায় ঘাম পড়ে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। শার্টের খুট দিয়ে যে ডলে নেবে, তার উপায় নেই। দুই হাত দূরত্বের দৃশ্যও দেখতে কষ্ট হয়। চশমা ছাড়া রাস্তা পার হওয়া আজাদের পক্ষে অসম্ভব। গাড়িগুলো দ্রæত যাচ্ছে। পথচারীদের চলাচলের জেব্রা ক্রসিংয়েও গতি কমাচ্ছে না। রাস্তা পার হওয়ার জন্য অনেকেই দাঁড়িয়ে। আজাদও দাঁড়ায়। মানবস্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দেবে। ভাসতে ভাসতে রাস্তা পার হয়ে যাবে। একসময় ট্রাফিক পুলিশের দয়া হয়। দুই হাত দুই দিকে সোজা করে ক্রুশ হয়ে দাঁড়ায়। মানবস্রোত শুরু হয়েছে। আজাদ যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো রাস্তার মাঝ পথে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। পার হতে পারছে না। কোন কিছু না ভেবেই মেয়েটির হাত ধরে ফেলে। অনেকটা টেনে রাস্তা পার করে। ঝাপসা চোখেই আজাদ মেয়েটিকে লক্ষ্য করে। শ্যাম বর্ণের সাদা ডিমের উপর কালো দুইটি মনি নিয়ে তাকিয়ে আছে। কী সুন্দর বড় বড় চোখ! গায়ে সাধারণ ছিটফোট প্রিণ্টের সালোয়ার কামিজ। লম্বা চুলগুলো মাথা থেকে পিঠ বেয়ে কোমর পর্যন্ত নেমেছে। সুন্দরবনের চিত্রল হরিণের মতো লাগছে। মেয়েটি বুঝতে পারছে না, কী বলবে। আজাদই বলল,
-একটু হলেই তো গাড়ি চাপা পড়ছিলেন।
লজ্জাবনত হয়ে মেয়েটি বলল,
-ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। নড়তে পাচ্ছিলাম না।
-হু, অনেক সময় এমন হয়। ভয়ে মানুষ আড়ষ্ট হয়ে যায়। আপনারও সেই দশা হয়েছিল। কোথায় যাবেন?
-জিগাতলা।
-ও, জিগাতলা! আমার বাসাও সেখানে। চলুন একসাথে যাই। আপত্তি আছে?
মেয়েটি কী বলবে বুঝতে পারছে না।
আজাদ ততক্ষণে একটি রিকশা ঠিক করে ফেলেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই বলল,
-উঠুন।
মেয়েটি উঠে যায়। কিছুক্ষণ পর আজাদ বুঝতে পারে মেয়েটি হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো চুপসে যাচ্ছে। আঁটোসাঁটো হয়ে বসেছে।
-আপনার নামটা জানতে পারি?
মেয়েটি চমকে উঠে।
-জ্বি....জলি।
-বাহ্, জলি। সুন্দর নাম। কিন্তু আপনি এমন চুপসে আছেন কেন? জলি হন। মানুষ দেখলে কী ভাববে বলুন তো! ভাববে আপনার সাথে আমার ইয়ে আছে।
-না মানে...
-আমি ভাল ছেলে। ভয়ের কিছু নেই। অবশ্য ভয় পাওয়াই উচিত। জানা নেই, শোনা নেই-একটা অপরিচিত ছেলের সঙ্গে রিকশায় যাচ্ছেন। ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে আমাকে ভয়ের কারণ নেই। আমি আজাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আই ই আর-এ পড়ি। ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন এন্ড রিসার্চ। আপনি কী করেন? কোথায় পড়াশোনা করেন?
জলি আরও চুপসে যায়। মাথা নিচু করে বলল,
-গার্মেন্টস-এ চাকরি করি।
আজাদ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর স্বাভাবিকভাবে বলল,
-ও, খুব ভাল....খুব ভাল। এসময়ে মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়া উচিত। নিশ্চয়ই উচিত। তা... গার্মেন্টস কোথায়?
-ফার্মগেইট।
-আজ অফিসে যাননি?
-গিয়েছিলাম। দেরি হয়ে যাওয়ায় চাকরি চলে গেছে।
-আহ্-হা, বলেন কি! চাকরি চলে গেছে! এত অল্পতেই চলে গেল?
-পর পর দুই দিন দেরি হয়েছে তো।
-কী নিষ্ঠুর গার্মেন্টসওয়ালার। একটু দেরি তো হতেই পারে। গাড়ি পেতে সমস্যা হয় না!
জলির চোখ ভিজে ওঠে। ওড়না দিয়ে গোপনে মোছে। আজাদ শান্তনা দেয়,
-মন খারাপ করবেন না। চিন্তার কিছু নেই। আপনি দক্ষ। আরেকটি চাকরি পেয়ে যাবেন। ব্যাপারই না। বাসায় কে আছে?
-মা আর দুই ভাই। বাবা নেই। মারা গেছে।
-বড় ভাই কি করে?
-মুদির দোকানদার। ছোট ভাই গার্মেন্টসে চাকরি করে।
-ভাল, খুব ভাল। সায়েন্স ল্যাবরেটরি এসে গেছে। আপনি তো বাসায় যাবেন।
-জ্বি।
-আমি ইউনিভার্সিটি যাব। এক কাজ করুন..... আপনি রিকসা নিয়ে চলে যান। ভাড়া দিয়ে দিচ্ছি।
জলি তাকিয়ে থাকে। করুণ দৃষ্টি। আজাদের মনটা কেমন করে উঠে। দ্রুত চিন্তা করে। তারপর বলল,
-এখন বাসায় গিয়ে কী বলবেন। আরেকটা চাকরি জোগাড় না হওয়া পর্যন্ত চাকরি চলে যাওয়ার কথা বলা ঠিক হবে না। এক কাজ করা যায়। চলুন সিনেমা দেখি। মন ভাল হয়ে যাবে। বলাকায় গিয়ে দেখি কী সিনেমা চলছে।
জলি কোন কথা বলে না। মনে মনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের উপর ভরসা পায়।
রিকশা বলাকা সিনেমা হলের সামনে দাঁড়ায়। জলির হাত ধরে টিকেট কাউন্টারে যায় আজাদ। রিয়াল স্টলের দুইটি টিকেট কাটে। জলির মন কেমন চাঙ্গা হয়ে উঠে। চোখে-মুখে আনন্দের আভা। আজাদ লক্ষ্য করে। সাড়ে ১২টার শো। হল পাতলা। গোটা কতক দর্শক। হুস-হাস শিশ দিচ্ছে। আজাদ ও জলি দেয়াল ঘেঁষে দুইটি সিটে বসে। সিনেমা শুরু হতে এখনও ১৫ মিনিট বাকী। আজাদ বলল,
-তোমাকে আমার ভাল লেগেছে। তুমি কী আমাকে বিয়ে করবে?
আধো আলো আধো অন্ধকার জলির জন্য পর্দা হিসেবে কাজ করে। মনে হচ্ছে আজাদ পর্দার অপর পাশ থেকে কথা বলছে। চোখে চোখ পড়ছে না। দেখছে না। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই কথা বলে।
-আমাকে বিয়ে করতে চান কেন? আপনি উচ্চ শিক্ষিত। ভাল পরিবারের ছেলে। আমার চেয়ে অনেক ভাল পাত্রী পাবেন।
-শোন, এরই নাম প্রেম। ভালবাসা। বড়ই দুষ্টু। জাত-পাত মানে না। মানুষে মানুষে প্রেম-ভালবাসা হয়। জাত-পাতে না। তোমার আমার পরিচয় ঘন্টাখানেকের। প্রথম দেখায় তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। লাভ এট ফার্স্ট সাইট। তোমাকে ভাললেগেছে, এর চেয়ে সত্য পৃথিবীতে আর কিছু নেই।
জলি মুগ্ধ হয়ে যায়। অন্ধকারেই আজাদের হাত ধরে। কাঁধে মাথা এলিয়ে দেয়। বলল,
-পৃথিবীতে এত ভাল মানুষ আছে, জানতাম না। আপনি এত ভাল!
-ভাল-মন্দ বুঝি না। তোমাকে ভালবেসেছি, বিয়ে করতে চাই-এটাই আমার কাছে ভাল মনে হয়েছে। আর যা ভাল, তা আমি করবই। তুমি যদি রাজী থাক, তবে সিনেমা দেখে সোজা কাজী অফিস যাব। বিয়ে করব। তবে একটা অসুবিধা আছে।
স্বপ্নভঙ্গের মতো চমকে উঠে জলি,
-কি?
-বাসায় হয়ত আমাদের বিয়ে মেনে নেবে না। আব্বা-আম্মা, ভাই-বোন। বুঝতেই তো পারছ। ম্যানেজ করতে পারবা না?
-কিন্তু...
-কোন কিন্তু নয়। ভালবাসার জন্য পৃথিবীতে কত প্রেমিক-প্রেমিকা জীবন দিয়েছে। লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ...। আর আমরা তো কোন অন্যায় করছি না। বিয়ে করছি। এটুকু কষ্ট করতে পারবা না?
জলি আবেগ ধরে রাখতে পারে না। বলল,
-পারব....পারব।
-শোন বিয়ে করে সোজা বাসায় যাব। তোমাকে দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে আমি ভাগব। বাকীটা তোমার কাজ।
-ভাগবেন! কেন?
-আ-রে বোঝ না। গরম গরম অবস্থায় বের করে দিতে পারে। তখন কোথায় যাব। পড়াশোনা করছি। চাকরি-বাকরি করছি না। বিষয়টা খারাপ দেখায়।
আবেগী হয়ে উঠে জলি,
-সমস্যা নেই। বড় ভাইকে বলব তোমাকে একটা দোকান করে দিতে। পড়াশোনাও করবে, দোকানও চালাবে। তুমি চালাতে না পারলে ছোট ভাইকে বসিয়ে দেব। দোকানের আয় দিয়ে আমাদের দুজনের চলে যাবে। তারপর পাস করে বের হলে তুমি চাকরি করবে।
-এটা তো পরের কথা। তুমি যদি বাসায় ম্যানেজ করতে পার, তবে এসবের প্রয়োজন পড়বে না। আর তুমি যখন বাসায় ঢুকে পড়বে, তখন আমি নিশ্চিত আব্বা-আম্মা ফেলে দেবে না। ওনারা ভাল মানুষ। তাছাড়া মান-সম্মানের ভয় আছে না! পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে তারপর আমি বাসায় ঢুকব।
-তা ঠিক, বলে জলি আজাদের কাঁধে মাথা রাখে। হাত চেপে ধরে। আজাদ ধীরে ধীরে সিনেমার নায়কের মতো দুই আঙ্গুল দিয়ে জলির থুঁতনি ধরে চেহারাটা উপরে তোলে। জলি নায়িকার মতো চোখ বন্ধ করে আছে। এমন সুখের সাথে জলির কখনো পরিচয় হয়নি। সুখের সাগরে নেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।
হঠাৎ দুই সিট পরে বসা এক লোক বলল,
এই যে ভাই, যা করার বাসায় গিয়ে করেন। বাসার কাম হলে নিয়া আইলেন ক্যান? বাসায় যান। বাসায় গিয়া কাম করেন।
আজাদ ও জলি সম্বিত ফিরে পায়। নড়েচড়ে বসে। সিনেমা কখন শুরু হয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে টের পায়নি। বিরতী চলছে।
আজাদ বলল,
-বাথরুমে যাব।
জলি তটস্থ হয়ে বলল,
-না, এখন যেও না।
-প্রস্রাব চেপেছে। যেতেই হবে।
জলি আহলাদিত হয়ে উঠে,
-না, এখন না। পরে যাও। আমার লজ্জা লাগছে।
-তাহলে এক কাজ করি। এখানেই সেরে ফেলি।
জলি লাফ দিয়ে উঠে বলল,
-ছিঃ এসব কি বলছ। মানুষ কি বলবে?
-কেউ টের পাবে না। এখান দিয়ে ছেড়ে দিলে সিটের তল দিয়ে গড়িয়ে সামনে চলে যাবে। কেউ বুঝতে পারবে না।
-ছিঃ ছিঃ যাও, বাথরুমে যাও।
আজাদ উঠে চলে যায়। হলের মূল গেইটের সামনে লোকজনের ভিড়। কলাপসিবল গেইটের ফাঁক দিয়ে বাদাম, চানাচুর কিনছে। আজাদ ভিড় ঠেলে যায়। গেইট একটু ফাঁকা। একজন বের হওয়ার মতো জায়গা রয়েছে।
আজাদের সাথে দেবের কখনো দেখা হয়নি। চিন-পরিচয়ের সম্ভাবনাও নেই। দুই জগতের দুই জন। প্রকৃতির কী খেয়াল আজাদের ঘটনাই দেবের উপর চেপে বসেছে। অন্যভাবে, অন্যরূপে। ট্রুথ ইজ আউট দেয়ার-যেখানে সত্য আছে। তারার আলোর মতো। ফু দিয়ে নিভিয়ে দেয়া যায় না। পলাশীর যুদ্ধ। কেউ দেখিনি। কিন্তু অস্বীকারের উপায় নেই।
সেই একই জায়গা। একই জেব্রা ক্রসিং। সময়টা ছিল ভিন্ন। প্রসন্ন বিকেল। একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। কড়া রোদ বৃষ্টি ধুয়ে কোমল করে দিয়েছে। সোনালী রোদ গাছের পাতায় লেপটে আছে। মানুষের গায়ে পরশ বুলাচ্ছে। বুক থেকে স্নিগ্ধ নিঃশ্বাস বের হয়ে আসে। আরাম লাগে। দেব দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি তার পাশে। রাস্তা পার হওয়ার অপেক্ষা। কখন যেন মেয়েটির হাতে দেবের হাত মিলে যায়। সম্মোহিত হয়ে রাস্তা পার হয়। দু’জন দু’জনের দিকে তাকায়। ধীরে ধীরে দেবের চোখের পলক পড়ে। ঘুম ঘুম ভাব। মেয়েটি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।
-আপনি?
-হ্যাঁ, আমি। আপনার সাথে পরিচয় নেই।
-আমি মিতু।
-অ, আমি দেব।
-দেবতা নাকি!
-না, খুব সাধারণ। দেবতা হতে চাই না।
-কিন্তু দেবতা হয়েই যেন আমার হাতে হাত রাখলেন। রাস্তা পার করে দিলেন। ভীষণ ভয় পাচ্ছিলাম।
-আমি জানি না। আনএক্সপ্লেইনএবল।
-ঘটে যায়...না?
-তাই তো মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছিল, কেউ একজন রাস্তা পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। মনের তাল বোঝা মুশকিল।
-তা ঠিক। আমার কাছেও তাই মনে হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, অনেক পথ। অনেক দূর। পার হওয়ার পর মনে হলো এই রাস্তাটুকুই তো। কত ছোট। কি করেন আপনি?
-নাটক করি।
-অভিনেতা?
-না। চেষ্টা করছি। দলের রিহার্সেল ছিল। ফিরছিলাম।
-আমি তিতুমীর কলেজে পড়ি। অনার্স ফার্স্ট ইয়ার। জুলজি। কোথায় রিহার্সেল করেন? কোন দলে?
-বিজ্ঞান কলেজে। পৃথিবী থিয়েটার। আসি।
দেব হাঁটছে। মিতু দাঁড়িয়ে থাকে। লোকজনের ভিড়ের মধ্যেও দেবকে আলাদা করা যাচ্ছে। সবার মাথার উপরে তার মাথা। ঘাড়ের উপর পড়ে থাকা ঝাকরা চুল হাওয়ায় উড়ছে। দৃঢ় পদক্ষেপে মাথা নিচু করে সোনালী রোদ- ঝিরঝির বৃষ্টি কিংবা ঝিরঝির বৃষ্টি-সোনালী রোদের মধ্য দিয়ে চলে যাচ্ছে। দেবতাই যেন হেঁটে হেঁটে আকাশে উঠে যাচ্ছে। মিতুর বুকটা হাহাকার করে উঠে।
মিতুর ঘুম হয়নি। সারারাত দেব, দেবতা জিউস হয়ে তার মন আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কতভাবেই না জিউস প্রলুব্ধ করেছে। প্রলোভিত হয়েছে। কিন্তু ধরতে পারেনি। বাস্তব আর অবাস্তবতার মাঝে পড়ে মন শূন্যতায় ভেসেছে। পরদিন বিকেলে বিজ্ঞান কলেজে যায়। পরিচয় হয় রুমার সাথে। রুমা পৃথিবী নাট্য দলের সাথে যুক্ত। মিতু দেবের কথা জিজ্ঞেস করে।
-দেব কী আপনাদের দলে?
-হ্যাঁ, কেন বলেন তো?
-গতকাল দেখা হয়েছিল। বলছিল, পৃথিবী নাট্য দলের সাথে আছেন।
-হ্যাঁ, ও খুব ভাল অভিনয় করে। মঞ্চাঙ্গণে বেশ সুনাম। ও কি আপনাকে আসতে বলেছে?
-হ্যাঁ।
-ও তো আজ আসবে না। ঢাকার বাইরে গিয়েছে। দেখেন তো কী উড়নচন্ডী। আপনাকে আসতে বলে ও নেই। মাঝে মাঝেই এ কাজ করে। হাওয়া হয়ে যায়। আর ওর ওয়াইফ খোঁজাখুঁজি করে।
-উনি বিবাহিত?
-হ্যাঁ, আপনাকে বলেনি?
-আসলে ওসব বিষয়ে আলোচনা হয়নি।
-ওর এক মেয়ে এক ছেলে।
মিতুর আর ভাল লাগছে না। গভীর অন্ধকার খাদে পড়ে যায়। পড়তেই থাকে। দীর্ঘ দূরত্বের শূন্যতা।
মুসলধারে বৃষ্টি। ইংরেজীতে বলে ক্যাটস এন্ড ডগস। দেব তার ছোট্ট অ্যাডভার্টাজিং ফার্মে বসে আছে। মিতু এসে উপস্থিত। ভিজে চুপচুপ। গায়ে হলুদ শাড়ি লেপটে আছে। চোখের কাজল গলে গাল পর্যন্ত এসেছে। চুল বেয়ে পানি পড়ছে। খেয়াল নেই মিতুর। দেব অবাক হয়।
-আপনি! বসুন, বসুন।
পিয়নকে ঢাক দেয়।
-অ্যাই, তোয়ালে নিয়ে আয়।
মিতু বলল,
-এত ব্যস্ত হবেন না। এখনই চলে যাব। আপনার সামনে একটু বসব?
-বসুন, বসুন। তার আগে পানি মুছে নিন। ঠান্ডা লেগে যাবে।
-আমার কিছুই হবে না। আপনার হাতটা একটু দেবেন?
দেব ডান হাত বাড়িয়ে দেয়।
মিতু হাত ধরে বসে থাকে। কাঁদছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। মিতু বুঝতে পারে ও কাঁদছে। মাথা থেকে চুঁইয়ে পড়া বৃষ্টির ঠান্ডা পানির সাথে চোখের গরম পানির ধারাও গালের উপর গড়িয়ে থুতনিতে ফোটা হয়ে ঝরে পড়ছে। দেবের ভাবান্তর নেই। স্বাভাবিকভাবেই বলে,
-হাতটা কি ছাড়িয়ে নিতে পারি?
মিতু চঞ্চল হয়ে উঠে।
-ও, হ্যাঁ... হ্যাঁ।
-অফিস চিনলেন কী করে?
-রুমা আপা বলেছিলেন।
-ও। এভাবে বৃষ্টিতে ভিজে না এলেই পারতেন।
-কেন যেন মনে হলো আপনাকে দেখে আসি। আসতেই বৃষ্টিতে পড়তে হলো।
-আমি বলে দিই। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে।
-কৃতজ্ঞতা!
-হ্যাঁ, আপনাকে রাস্তা পার করে দিয়েছিলাম... কথাটি আপনার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। ঐ দিন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। ততক্ষণে চলে এসেছি। তাই না?
মিতুর কান্না আসছে। কষ্টে সংবরণ করে বলল,
-হ্যাঁ...হ্যাঁ...আপনি ঐ দিন পার করে না দিলে হয়ত পার হতে পারতাম না।
-নিন কফি খান। ভাল লাগবে।
-আমি যাই।
-বৃষ্টির মধ্যেই? আপনাকে কিন্তু এই বৃষ্টিতে কেউ নিয়ে যাবে না। আর দ্বিতীয়বার আপনাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগও আমি দেব না।
-না...না। চলে যেতে পারব। সেদিন রোদ আর বৃষ্টির মধ্যেই তো আপনি চলে গিয়েছিলেন। আপনি খুব ভাগ্যবান। আমি শুধু বৃষ্টি আর সন্ধ্যার অন্ধকার পাচ্ছি। রোদ পাচ্ছি না।
-বাহ্, আপনি তো চমৎকার কথা বলেন।
-চমৎকারের কিছু নেই। দুইটি ঘটনা মিলালে খুব স্বাভাবিক।
-তা ঠিক। দুজনই দুইটি ঘটনার স্বাক্ষী।
-ওকে! রাত হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি বাড়ছে। আপনি চলে যান।
-এভাবে বলছেন?
-রাত আর বৃষ্টি দুটো বাড়লে বিপদ। আর মেয়েদের তো পদে পদে বিপদ।
-হ্যাঁ, বিপদ। আপনার মতো অনেকেই ভাবে। উদ্ধারে এগিয়ে আসে না।
-আচ্ছা, চলুন...আপনাকে দ্বিতীয়বার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ করে দিই। এক রিকশায় পর্দা দিয়ে দুজনকে বসতে হবে।
-সমস্যা নেই।
-ভয় পাচ্ছেন না?
-আপনি দেব, দেবতা...ভয় পাব কেন?
দেব হাসে।
-চলুন।
বাইরে ঝুম বৃষ্টি। সাথে বাতাসের ঝাটকা। রিকশাওয়ালার টানতে কষ্ট হচ্ছে। ধীরে ধীরে চলছে। পুরানা পল্টন মিতুদের বাসা। মিতু মাথা নিচু করে বসে আছে। যেন জলে ভেজা মূর্তি। দেব জিজ্ঞেস করে,
-আপনার বাবা-মা, ভাই-বোন?
-বাবা ব্যবসায়ী। ডলার ব্যবসা করেন। এক ভাই, দুই বোন। মা গৃহিনী।
-তাহলে তো আপনারা অনেক বড়লোক!
-মোটামুটি। আচ্ছা, আপনাকে কি আমি ‘তুমি’ বলতে পারি?
-পারেন। মজার বিষয় কি জানেন, আমার ওয়াইফ আমাকে আপনি বলেন।
-কেন?
-ওর ইচ্ছা। অনেক চেষ্টা করেছি ‘তুমি’ বলাতে। পারিনি।
-আচ্ছা, আমরা কি বন্ধু হতে পারি না?
-কেন পারব না। অবশ্যই পারব। আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু। ওকে?
-ওকে!
মিতু মনের অগ্নেয়গিরির যে উদগিরণ নিয়ে দেবের কাছে ছুটে গিয়েছিল, এর ব্যখ্যা তার কাছে নেই। তবে উদগিরিত গনগনে লাভা ধীরে ধীরে শীতল হয়ে এসেছে। বাস্তবতার আবরণে ঢেকে গেছে। কিন্তু দেবের সাথে সম্পর্কটা থেকেই যায়। অন্যভাবে। দেবের অসীম আকর্ষণশক্তি। সহজে মানুষের মনের ভেতর কেমন করে যেন ঢুকে পড়ে। দেব ঢুকে না, মানুষ ঢুকিয়ে নেয়। মিতুর বাবা, মা, ভাই, বোন এমনকি আত্মীয়-সজন তার প্রতি মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ে। ওর বাবা তো পুত্র বলেই সম্বোধন করে। কোথাও পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় বলে,‘আমার বড় ছেলে’। একবার এক ঘটনা ঘটে। বন্ধুদের সাথে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিল দেব। সমুদ্র সৈকতে সবাই ঝাপাঝাপি করছে। একটি মেয়ে ছাতার নিচে চেয়ারে আধশোয়া। চোখে সানগ্লাস। চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। সানগ্লাস প্রত্যেক মানুষের সৌন্দর্যে বাড়তি কিছু যোগ করে দেয়। একটু সুন্দর হলে তো কথাই নেই। সানগ্লাস খুললে মুখশ্রী থেকে কিছু সৌন্দর্য খসে পড়ে। আবার পড়লে যুক্ত হয়। মেয়েটি সুন্দর। সানসানগ্লাস তার সৌন্দর্য আরেকটু বাড়িয়ে দিয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, কিছুক্ষণ আগে সমুদ্র তীরের হাঁটু জলে হাঁটাহাঁটি করে এসেছে। সালোয়ারের নিচের অংশ এখনও ভিজে। সানসানগ্লাসের উপর দিয়ে রংধনুর মতো বাঁকা ভ্রু দেখা যাচ্ছে। কপাল থেকে নাকটি সূ²ভাবে দুই চোখের মাঝ দিয়ে বিভক্তি টেনে সূঁচালো হয়ে পাতলা ঠোঁট দুটোর উপর উদ্ধত ভঙ্গিতে এসে থেমেছে। দূর থেকে তার রূপ চোখে পড়ে। সবাই দেখছে। মেয়েটিও বুঝছে। বিকেলে দেবের অন্যরূপ। কোট-টাই পড়ে সেজে গুঁজে বের হচ্ছে। বন্ধুরা অবাক। ও এমন পোজপাজে কোথায় যাচ্ছে। তাদের একজন জিজ্ঞেস করে,
-ব্যাপার কি, কোথায় যাচ্ছিস?
-তেমন কোথাও না। এই সামনে। তোরা থাক। ঘন্টা খানেকের মধ্যে ফিরব।
দেব বেরিয়ে যায়।
পরের ঘটনা শুনে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। চেয়ারে যে মেয়েটি বসেছিল, সেই মেয়েটির সাথে দেব দেখা করতে গিয়েছিল। সৈকতে বসে সূর্যাস্ত উপভোগ করে। মেয়েটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার ছাত্রী। গান লিখে। ডায়রিতে তার সারাজীবনের লেখা গান। দেবের সঙ্গ পেয়ে মেয়েটি এতটাই মুগ্ধ-বিমুগ্ধ, যে ডায়রিটি দিতে মহুর্ত দেরি করেনি। দেব কথা দিয়েছিল, ঢাকায় ফিরে কোন শিল্পীকে দিয়ে তার লেখা গান গাওয়াবে। মেয়েটি তার লেখা গান কেউ গাইবে, এ প্রত্যাশায় ডায়রিটি দেয়নি। দেবের আকর্ষণ শক্তি তাকে বাধ্য করে। তবে সৈকতে হাজার মানুষের ভিড়ে দেবের সাথে মেয়েটির কিভাবে কোন জাদুমন্ত্রে পরিচয় হয়েছিল, তা রহস্যই থেকে যায়। বন্ধুরা দেবকে জিজ্ঞেস করলে, ও শুধু হাসে। অনেক দিন পর দেব বন্ধুদের কাছে আফসোস করে বলেছিল, মেয়েটির ডায়রিটা ফেরত দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু ওর ফোন নম্বরটি হারিয়ে ফেলেছি। যোগাযোগের পথ পাচ্ছি না। অবশ্য মেয়েটিকে খুঁজে পাওয়া দেবের জন্য জটিল নয়। ও তো দেবতা জিউসের উত্তরসূরী। শুধু ইচ্ছা পোষণ করলেই হয়। পার্থক্য এটুকুই জিউস নানা রূপ ধারণ করে ছলেবলে নারীদের আয়ত্তে এনে ভোগ করত, দেব তা করে না।
আজ মিতুর গায়ে হলুদ। খুব ধুমধাম। গান-বাজনা, ছেলে-মেয়েদের নাচানাচি চলছে। দেব তার স্ত্রী, পুত্র-কন্যা নিয়ে এসেছে। এসেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মিতুর বিয়ে, বিরাট ব্যাপার। বড় ছেলে হিসেবে ওর দায়িত্ব আরও বিরাট। অতিথিদের অর্ভ্যথনা থেকে শুরু করে খাওয়া দাওয়ার তদারকি করছে। মিতুর বাবা মা দেবের ভূমিকায় মুগ্ধ। ছেলে মনে করে যে ভুল করেননি, মিতুর বিয়ের এ সময়টাতে এসে তাদের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়। আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠেন দুজন। মিতুর হলুদ দেয়া চলছে। মাইকে নাম ঘোষণা হচ্ছে। নামধারীরা একে একে মিতুর কপালে, গালে, নাকে, গলায় হলুদ মেখে দিচ্ছে আর পায়েস, মিষ্টি, ফল খাইয়ে দিচ্ছে। মিতুর বমি আসছে। উপায় নেই, খেতেই হবে। ব্যস্ততার মধ্যে হঠাৎ থেমে যায় দেব। মিতুকে দেখে। স্টেজে একটা পদ্মফুল ফুটে আছে। এই প্রথম ইচ্ছে হলো দীঘির স্বচ্ছ জল সাতরে ফুলটিকে একটানে তুলে আনি। পাহাড়ের চূড়ায় যেন একটু একটু মেঘ জমছে। মাইকে একটি নাম শুনে চমকে উঠে। তার স্ত্রী নীলার নাম ঘোষণা করা হয়েছে। নীলা এগিয়ে যাচ্ছে। মিতুর সামনে বসে। তর্জনীতে একটু হলুদ নিয়ে মিতুর কপালে ছোঁয়াতে যায়। মিতু দেবের দিকে তাকিয়ে থাকে। দেব ঘুরে দাঁড়ায়। মিতুর ভেতরের সুপ্ত আগ্নেয়গিরির লাভা টগবগ করছে। চেপে রাখতে চেষ্টা করছে। যেন ফেটে না যায়। নীলা মিতুর কপালের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত হলুদ রেখা এঁকে দেয়। মাথাটা কেমন ঘুরে উঠে। অন্ধকার অন্ধকার লাগছে। যেন সুউচ্চ কোন চূড়া থেকে শূন্যে ভেসে নিচে পড়ছে। পড়ছেই পড়ছে। কানে ভেসে আসছে, নীলা সবার কপালে সয় না....সয় না।
মিতুর বিয়ে হয়ে গেল। বরের সাথে চলে যাওয়ার পালা। গাড়ি রেডি। কমিউনিটি সেন্টারের গেইটে সবাই দাঁড়িয়েছে। বিদায় দেবে মিতুকে। মিতু কাঁদছে না। গাড়ির পাশে দেব। পরণে সাদা পাঞ্জাবী। ঝাকড়া চুলগুলো ঝুলে আছে। দেবতার মতো দাঁড়িয়ে। সামনে দাঁড়ায় মিতু। দেব ডালসহ একগুচ্ছ বড়ই পাতা সুন্দর করে বেঁধে মিতুর হাতে দেয়। বড়ই পাতা মিতুর খুব পছন্দ। মিতু বলেছিল, কেউ ফুল দিয়ে আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না। যদি একটি বড়ই পাতা দেয়-আমার আনন্দের সীমা থাকে না। দেবের কাছে অদ্ভুত লেগেছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, পৃথিবীতে এতকিছু থাকতে বড়ই পাতা কেন? মিতু জবাব দিয়েছিল, জানি না। ভাল লাগে। মিতুর সেই প্রিয় বড়ই পাতা দেব বিদায় বেলা উপহার দিচ্ছে। এবার আর আগ্নেয়গিরি চেপে রাখতে পারল না মিতু। উদগিরণ হতে থাকে। দেবের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। কাঁদে। কাঁদতে থাকে, অঝরে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন