মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

নির্বাচন কমিশনকে একদিন কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে

প্রকাশের সময় : ১০ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কামরুল হাসান দর্পণ
যে কোনো ভালো কাজে সফল হলে, সেটা ব্যক্তি পর্যায়ে হোক আর দলগতভাবেই হোক, আমরা আল্লাহর দরবারে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে শোকর আদায় করি। কোনো খারাপ কাজ সংগঠিত হলে বা মন্দ কথা শুনলে ‘নাউজুবিল্লাহ’ বলি। কেউ মারা গেলে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ বলি। পাঁচ মাস ধরে ছয় ধাপে যে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হলো, তাতে দেশের সর্বস্তরের মানুষ নাউজুবিল্লাহর মধ্যেই ছিলেন। একমাত্র নির্বাচন কমিশন এবং তার প্রধান কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদের কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে তিনি যেন ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে খুবই খুশি। ভয়াবহ নির্বাচনী সহিংসতায় যে ১৩২ জন মানুষের প্রাণ গেল তাতে তিনি সামান্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। উল্টো তিনি মনোবিদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বলেছেন, আমাদের যারা নির্বাচনে দাঁড়ান, তারা সবাই মনে করেন নিজেরই জয়ী হওয়া উচিত। ভোটাররা কী ভাবেন তা তোয়াক্কা করেন না। এ জন্য তারা যে কোনোভাবেই হোক নির্বাচনে জিততে চান। এসব কারণেই এমন ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার (প্রাণহানি) জন্য তিনি ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ বলেননি। বললেই তো যে নির্বাচনটি তার নেতৃত্বে হয়েছে, ওটাই নিহত বলে গণ্য হবে। আর একজন কাঁচা, অদক্ষ, অক্ষম, মেরুদ-হীন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এটা বলা মানেই তার নির্বাচনের ‘ইন্না লিল্লাহ’ পড়া। সঙ্গত কারণেই এটা তার করার কথা নয়। তবে দেশের মানুষ ‘ইন্না লিল্লাহ’ নির্বাচনের শুরুতেই পড়েছে। পুরো নির্বাচন শেষে ‘নাউজুবিল্লাহ’ও বলেছে। নির্বাচন নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বহু বিশ্লেষণ ও কথা বলেছেন। কারও মুখ থেকে নির্বাচন নিয়ে একটি ভালো কথা শোনা যায়নি। সবাই অসন্তোষ এবং এটা কোনো নির্বাচনই নয়, এমন মতামত ব্যক্ত করেছেন। বিরোধী দল ভালো বলবে না, এটা সবাই জানে। তবে সরকারি দল এবং তার সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা ভালো বলবে না, এটা কস্মিনকালেও হতে পারে না। তবে এবারের ইউপি নির্বাচন নিয়ে সরকারি দল ভালো-মন্দ কিছু না বলে তার বিপুল জয় নিয়ে সন্তুষ্ট হতে দেখা গেছে। তাদের এই কিছু না বলা থেকেই বোঝা যায়, জয়ই আসল কথা, সেটা যেভাবেই হোক। খেলায় ভুল হলে বা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে জয় সব ভুলিয়ে দেয়। রেফারি ভালো করল কী মন্দ করল, তা বিজয়ী দলের কাছে কিছুই যায় আসে না। তবে যারা খেলা থেকে সত্যিকারের আনন্দ উপভোগ করতে চায়, তারা কখনই যেনতেন বা ওয়াকওভারের জয়ে তৃপ্তি লাভ করে না। সমর্থিত দল জিতলেও একমাত্র বোধ-বুদ্ধিহীন ও গোয়ার ছাড়া আনন্দ প্রকাশ করে না। এবারের ইউপি নির্বাচন নিয়ে তীব্র সমালোচনার শেষ ছিল না। সরকার সমর্থক হিসেবে পরিচিত পত্র-পত্রিকাগুলোও তাদের বিবেকের দায়বদ্ধতা নিয়ে সমালোচনা করতে ছাড়েনি। তারাও এ নির্বাচনকে ইতিহাসের জঘন্যতম ইউপি নির্বাচন, প্রাণঘাতী নির্বাচন, প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন ইত্যাদি নানা শব্দ ও বাক্যে চিহ্নিত করেছে। নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ, নির্বাচন পর্যবেক্ষরা এ নির্বাচনকে ‘ভোট ও গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক’ ঠুকে দেয়া হিসেবে অভিহিত করেছেন। গত শনিবার ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে এক সেমিনারে বক্তব্য দিতে গিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম ইউপি নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করেছেন, নাউজুবিল্লাহ, এ কী নির্বাচন দেখছি! যে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হলো, এতে কত বড় ক্ষতি যে হয়ে গেল তা বুঝতে সময় লাগবে। সরকারকে এ জন্য ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। কীভাবে নির্বাচন ব্যবস্থাকে শেষ করে দেয়া হয়েছে। তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সাংবিধানিকভাবে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। কিন্তু এটা কি গণতান্ত্রিক? যতখানি গণতন্ত্র অর্জন করেছিলাম সব তো শেষ।
দুই.
পাঠকদের মনে আছে কিনা জানি না, ইউপি নির্বাচনের শুরুর দিকে এক নিবন্ধে লিখেছিলাম, এই নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের গ্রাম-গঞ্জের নিবিড় সমাজ ব্যবস্থা এবং ব্যক্তি সম্পর্কের মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ, চির শত্রুতার বীজ বপন করে দেয়া হয়েছে। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন দিয়ে ভাই ভাইয়ের শত্রু, আত্মীয় আত্মীয়র শত্রুতে পরিণত করা হয়েছে। সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে দেয়া হয়েছে। নির্দলীয় নির্বাচন হলে সেখানে বরাবরই দলীয় প্রার্থীর চেয়ে ব্যক্তির সততা, নিষ্ঠা ও কর্মদক্ষতাকে প্রাধান্য দেয়া হতো। এসব ক্ষেত্রে দলমত নির্বিশেষে ভালো মানুষকে নির্বাচিত করে আনার সম্মিলিত প্রয়াস দেখা যেত। এবার দলীয়ভাবে নির্বাচন হওয়ায় চিরায়ত এ প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সাধারণত দলীয় প্রার্থী হলে এর বাইরে যাওয়া যায় না। দলীয় আনুগত্য ও বাধ্যবাধকতা থাকে। প্রার্থী পছন্দ না হলেও তার পক্ষেই কাজ করতে হয়। দলের হাইকমান্ডের কড়া নির্দেশ থাকে। নির্দেশ উপেক্ষা করলে দল থেকে বহিষ্কারের শাস্তি ঘোষণা করা হয়। ফলে নির্দেশ মানতে গিয়ে চিরচেনা, জানা ও সুসম্পর্কের মানুষের সাথেও বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ করতে হয়। এতে হানাহানি, সংঘাত, সংঘর্ষ এমনকি খুনোখুনির মতো ঘটনায়ও জড়িয়ে পড়তে হয়। এবারের পুরো ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এই পরিবেশই বজায় ছিল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচন শেষে ‘সামাজিক অস্থিরতা’র তত্ত্ব তুলে ধরে পুরো বিষয়টিকে জায়েজ করার চেষ্টা করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচনের আগে তার এই উপলব্ধি হলো না কেন? এমনকি নির্বাচনে ধাপে ধাপে যে সহিংস ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটেছে, তখনও কেন তার এই বোধোদয় হয়নি? ১৩২ জন মানুষের প্রাণহানি, ১০ হাজারের বেশি মানুষের আহত হওয়া, অসংখ্য মানুষের পঙ্গুত্ববরণ করা থেকে শুরু করে বাড়িঘর, সহায়-সম্বল ও বেঁচে থাকার অবলম্বন ধ্বংস করার এক নির্বাচন দিয়ে কি তিনি সমাজের অস্থিরতার বিষয়টি পরখ করেছেন? বরং এটা বলা যুক্তিযুক্ত, গ্রামে-গঞ্জে পর্যায়ক্রমে সহিংসতা ছড়িয়ে দিয়ে পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে তিনি নিজেই নির্বাচন নামক পাগলা ঘোড়া দাবড়িয়ে দিয়ে অস্থির করে দিয়েছেন। এ ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণ না করে, যা ইচ্ছা তা করার অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছেন। এর দায় কি তার ওপর বর্তায় না? আজিজ কমিশনকে নিয়ে দুর্নাম ছিল। সে সময়ের প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ‘পাগল’ উপাধিও দেয়া হয়েছিল। তৎকালীন বিরোধী দলগুলো তো বটেই মিডিয়াগুলোও অত্যন্ত হাস্যকরভাবে তাকে উপস্থাপন করত। এমনও বলা হতো, নির্বাচন কমিশনের ইতিহাসে এমন খারাপ নির্বাচন কমিশন আর আসেনি। শেষ পর্যন্ত বিরোধী দলগুলোর প্রচ- বিরোধিতার মুখে আজিজ কমিশনকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। আজিজ সাহেব এখন নিজেকে দায়মুক্ত ও নির্দোষ ভাবতে পারেন। তার সব অপবাদ ধুয়ে-মুছে দিয়েছেন বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার। রকিব কমিশনের নির্লজ্জতা, মেরুদ-হীনতা, অক্ষমতা, বিবেকহীনতা ও বোধহীনতা শুধু আজিজ সাহেবের অপবাদকেই ছাড়িয়ে যায়নি, ইতিহাসের ওপর নতুন ইতিহাস রচনা করেছে। এমন ইতিহাস আগে যেমন রচিত হয়নি, ভবিষ্যতেও রচিত হবে না বলে অনেকে মনে করেন। দেশের মানুষ রকিবউদ্দীন ও তার কমিশনারদের কোনো দিনই ভুলবে না। ‘দ্য ওয়ার্স্ট চিফ ইলেকশন কমিশনার ইন হিস্ট্রি’ হিসেবে তাকে জনগণ মনে রাখবে। এমনকি নির্বাচনী ব্যবস্থা তছনছ এবং গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে দেয়ার মতো নির্বাচনের দায়ে যদি তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়, তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। একটা মানুষ কতটা বিবেক ও বোধহীন হলে বলতে পারেন কিছু প্রাণহানি ও বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ছাড়া নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে। তার অর্থ হচ্ছে, নির্বাচনে মানুষ মারা যাওয়া তার কাছে এমন কোনো বড় বিষয় নয়, আর সংঘর্ষ তো ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। ১৩২ জন মানুষ মারা গেছে সামাজিক অস্থিরতার কারণে, নির্বাচনের জন্য নয়। তার এমন দায়িত্বহীন মন্তব্যের জন্য নাউজুবিল্লাহ বলা ছাড়া আর কী-ইবা বলা যেতে পারে!
তিন.
এই নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির যে কত বড় ক্ষতি করে ফেলেছে, তা সচেতন মানুষের উপলব্ধি করতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। শুধুমাত্র একগুঁয়ে নির্বাচন উন্মাদনামুখী, সরকারের কলের পুতুল হওয়া, সর্বোপরি নিজেদের পদ-পদবির লোভের কারণে দেশের গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে তুচ্ছ করে দিতে এ নির্বাচন কমিশন মোটেও দ্বিধা করেনি। ধারাবাহিকভাবে চলমান দেশের বহু কষ্টার্জিত গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার মিশন নিয়েই যেন তারা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বহুল বিতর্কিত ভোটারবিহীন জাতীয় নির্বাচনটি করে। এমন একতরফা ও বিনাভোটের নির্বাচন বাংলাদেশে তো হয়ইনি, বিশ্বের ইতিহাসেও নেই। বলা যায়, এ নির্বাচন দেশকে এক ধরনের গণতন্ত্রহীনতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। রাজনীতিকে একমুখীকরণ ও অনেকটা কর্তৃত্ববাদীতে পরিণত করেছে। যে গণতন্ত্রের জন্য দেশের মানুষ স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় বছর আন্দোলন সংগ্রাম করেছে, ৫ জানুয়ারির একটি নির্বাচনের মাধ্যমে তা ভূলুণ্ঠিত করে দিয়েছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন। এ নির্বাচনের মাধ্যমে যে দলটির নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছে, সে দল গণতন্ত্রের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছিল। অথচ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তার বিরুদ্ধেই গণতন্ত্র সঙ্কুচিত ও হরণ করার অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে সচেতন মানুষ সরাসরি কোনো কথা না বললেও সরকারের বিভিন্ন কর্মকা- বুঝিয়ে দিচ্ছে, এ সরকার গণতন্ত্রকে উপেক্ষা করে চলেছে। একটি দেশ বাদে বিশ্বের প্রভাবশালী গণতান্ত্রিক দেশগুলোর কাছে নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তারা এখনো অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছে। গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করে সীমিত করে ফেলার এই দায় নিশ্চিতভাবেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর বর্তায়। এ দায় সে কোনোভাবেই এড়াতে পারবে না। দেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ কোনো দিনই প্রধান নির্বাচন কমিশনের ও তার কমিশনারদের ক্ষমা করবে না। ইতিহাসে তারা গণতন্ত্র হন্তারক হিসেবেই ঠাঁই পাবেন। শুধু তাই নয়, এ নির্বাচন কমিশন পরবর্তীতে পৌরসভা ও এবারের ইউপি নির্বাচনসহ যেসব নির্বাচন করেছে, তার মধ্য দিয়ে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াকেই ভেঙে দিয়েছে। মানুষের ভোট দেয়ার যে মৌলিক অধিকার, তা কেড়ে নিয়েছে। মানুষকে তার ভোটাধিকারের প্রতি অনুৎসাহী করে তুলেছে। মানুষের মধ্যে এ ধারণার সৃষ্টি করতে বাধ্য করেছে, তাদের ভোট দেয়ার প্রয়োজন নেই। এমনিতেই প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে যাবে। এবারের ইউপি নির্বাচনে এ ধারণা আরও প্রকট হয়েছে। সরকারি দলের ২২৭ জন প্রার্থী বিনাভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি যারা নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের সিংহভাগই স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত ভোটে নির্বাচিত হননি। জোরজবরদস্তির মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু নির্বাচন করার এই অক্ষমতা দেশের অপূরণীয় ক্ষতি করে ফেলেছে। গণতন্ত্রকে তো প্রান্তিক পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছেই, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকেও থমকে দিয়েছে। সরকার যতই অর্থনৈতিক অগ্রগতির কথা, লাখ লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা ও উন্নয়নের ফুলঝুরি ছড়াক না কেন, সাধারণ মানুষ জানে তারা কী কষ্টে আছে। কত কষ্টে তাদের জীবনযাপন করতে হয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তাদেরকে ন্যূনতমভাবে জীবন চালাতে হয়। কোনো কিছু কিনতে গিয়ে নেহায়েত যতটুকু না হলেই নয়, তা কিনেন। একদিনের খরচকে দুই দিনে বিভক্ত করেন। যেখানে একদিনে ১০০ টাকা খরচ করার কথা, সেখানে ৫০ টাকা খরচ করে বাকি ৫০ টাকা পরের দিনের খরচের জন্য রেখে দেন। একে যদি সরকারের ভাষায় মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বলা হয়, তবে তা সাধারণ মানুষের কাছে কাঁটা গায়ে নুনের ছিঁটা দেয়ার মতোই মনে হয়। বাস্তবতা হচ্ছে, কয়েক লাখ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বেতন আকাশছোঁয়া বৃদ্ধি ও একটি গোষ্ঠীর অঢেল সম্পদের মালিক হওয়ার ক্রয়ক্ষমতাকেই সরকার বড় করে দেখছে। তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিকেই সরকার সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি হয়েছে বলে চালিয়ে দিচ্ছে। এটি একটি শুভঙ্করের ফাঁকি ছাড়া কিছুই নয়। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা যদি ধরা হয়, তবে দেখা যাবে সেখানে বিনিয়োগ বলতে কিছু নেই। ব্যবসা বৃদ্ধি দূরে থাক, চলমান ব্যবসা চালাতেই তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বলতে কিছু নেই। বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকায় বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। অন্যদিকে দেশের বিনিয়োগকারীদের অনেকে বিদেশে বিনিয়োগ করা শুরু করেছেন। দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগ না হওয়ায় ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে। অলস টাকার পাহাড় জমেছে। যে ফরেন রেমিট্যান্সে রিজার্ভ রেকর্ড করেছে বলে সরকার গর্ববোধ করে, তা জমেছে বিনিয়োগ না হওয়া এবং আমদানি-রপ্তানির গতি শ্লথ হয়ে পড়ায়। যে অর্থ কাজে লাগানো না যায়, সে অর্থের মূল্য কি! সরকার গত অর্থবছরে জিডিপি ৭.০৫ হয়েছে বলে বেশ আত্মতৃপ্তি লাভ করেছে। নতুন অর্থবছরে ৭.২০ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। এটাকেও অর্থনীতিবিদসহ বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও বেসরকারি সংস্থাগুলো সঠিক বলে মনে করছে না। ড. মইনুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন, রাজনীতির প্রয়োজনে ‘ডাটা ডক্টরিং’ করে জিডিপিকে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বর্তমান অর্থবছরে জিডিপি ৭ শতাংশে পৌঁছাবে না। অর্থাৎ জিডিপির সংখ্যাটির মধ্যেও সংখ্যাতাত্ত্বিক ফাঁকি-ঝুঁকি রয়েছে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, থমকে যাওয়া অর্থনীতিকে উন্নত দেখানোর জন্য সরকারকে নানা অপকৌশল অবলম্বন করতে হচ্ছে। এই যে দেশের গণতন্ত্র ও অর্থনীতি সংকটের মুখে পড়েছে, এর জন্য প্রধানত নির্বাচন কমিশনই দায়ী। নির্বাচন কমিশন যদি ৫ জানুয়ারির মতো একটি অত্যন্ত খারাপ ও জনগণ বঞ্চিত নির্বাচন না করত তাহলে দেশের এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। দেশের এই পরিস্থিতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও তার কমিশনারদের বোধ-বুদ্ধিতে ধরা পড়েনি, তা তাদের একের পর এক বিতর্কিত ও সংঘাতপূর্ণ নির্বাচন করা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না। এমন হায়া ও বোধহীন নির্বাচন কমিশন দেশের মানুষকে যে সারা জীবন দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়া করবে, তাতে সন্দেহ নেই।  
চার.
মানুষ চিরদিন বেঁচে থাকে না। জীবনকে অর্থবহ ও সুন্দর করে তোলার বাসনা প্রত্যেক মানুষেরই থাকে। মহৎ ও সৎ মানুষ শুধু নিজে বাঁচার প্রয়াস চালান না। তারা সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ কর্ম দিয়ে সবাইকে নিয়ে বাঁচতে চান এবং সবার মাঝে থাকতে চান। সৎ ও নির্ভীক মানুষ যখন দেশ সেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পান, তখন তারা এ সুযোগকে আল্লাহর নেয়ামত হিসেবেই বিবেচনা করে। মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার এ সুযোগ তারা কোনোভাবেই হারাতে চায় না। তবে অসৎ ও দুর্বৃত্ত শ্রেণীও দুষ্কর্মের কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকে। এই শ্রেণী যতটা মানুষের মনে ঘৃণা জন্মায়, তার চেয়ে বেশি ঘৃণা জন্মায় যখন সুশিক্ষিত, মার্জিত ও দায়িত্বশীল কোনো লোক স্বেচ্ছায় অপকর্ম করে। এতে মানুষের যে ক্ষতি হয়, তা অত্যন্ত ভয়াবহ আকার ধারণ করে এবং তা পুষিয়ে ওঠা দুরূহ হয়ে পড়ে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন যেন এ কাজটিই করেছে। সে গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান শর্ত নির্বাচনী ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে দিয়েছে। তার মেরুদ-হীনতার কারণে নির্বাচনী ব্যবস্থার মেরুদ- ভেঙে গেছে। দেশের এত বড় ক্ষতির পরও তার মধ্যে কোনো বিকার নেই। উল্টো নিজেদের সাফাই গাইতে দেখা যায়। বলতে দ্বিধা নেই, গণতন্ত্র ও মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় রত প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনে যারা কমিশনারের দায়িত্ব পালন করছেন, তারা জনসাধারণের ক্ষোভ ও নিন্দার মধ্যেই আজীবন থাকবেন। গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিয়ে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করার মতো গর্হিত কাজের মার্জনা জনগণ কোনো দিনই করবে না। নির্বাচনের নামে যে প্রহসন বছরের পর বছর ধরে তারা করে চলেছেন, এর জবাব একদিন তাদের দিতে হবে। কারণ তারা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক পদে থেকে এ কাজ করেছেন। এ দায় তারা এড়াতে পারেন না, পারবেনও না।
darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Mohammad Sohel ১০ জুন, ২০১৬, ১০:২৮ এএম says : 0
কাঠগডা থেকে সোজা ফাসির মঞ্চে পাঠিয়ে দিতে হবে
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন