থেমে থেমে বস্তিতে আগুনের ঘটনা ঘটছেই। এক একটি অগ্নিকান্ডে প্রাণহানি ও পঙ্গুত্ব ছাড়াও নিঃস্ব হয় হাজার হাজার পরিবার। তবে এসব আগুনের ঘটনায় কখনো ভাগ্যও খোলে অনেকের। গত বছর রাজধানীসহ সারাদেশে ১৬৫টি বস্তিতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ২৮টি বস্তিতে আগুন লাগে। সর্বশেষ গত শুক্রবার রাজধানীর মিরপুর-৭ নম্বর সেকশনের ঝিলপাড়ের চলন্তিকা বস্তিতে ভয়াবহ আগুন লাগে। এতে প্রায় ১৫ হাজার ঘর পুরে ছায় হয়ে যায়। নিঃস্ব হয় ৫০ হাজারের বেশি বস্তিবাসী।
নগর সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও ভুক্তভোগীরা বলেন, সরকারি জায়গা দখলে নিতে বস্তিতে আগুন লাগানো হয়। কখনো জায়গা সংশ্লিষ্টরা দুর্বৃত্তদের দিয়ে এ আগুন লাগায়। আবার কখনো ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা অধিপত্য বিস্তার ও বস্তির নিয়ন্ত্রণ নিতে আগুন লাগায়। ভুক্তভোগী বস্তিবাসীরা বলেন, বস্তিগুলোকে ঘিরে চলছে শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য। স্থানীয় ক্ষমতাসীন প্রভাবশালীরা ছাড়াও গ্যাস-বিদ্যুৎ-ওয়াসাসহ সেবা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে গড়ে উঠেছে এ সিন্ডিকেট। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে তখন তাদের অনুসারীরা প্রভাব বিস্তার ও দখল নিতে বস্তিতে আগুন দেয়। তবে ফায়ার সার্ভিস ও বস্তিবিষয়ক গবেষকরা বলছেন, অবৈধভাবে টানা গ্যাস-বিদ্যুতের অনিরাপদ ব্যবহার, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট ও অসতর্কতাসহ বিভিন্ন কারণে বস্তিতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা বেশি ঘটে।
রাজধানীসহ সারাদেশে বস্তিবাসীর সংখ্যার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে ২০১৫ সালের বস্তিশুমারি অনুযায়ী দেশে বস্তিবাসীর সংখ্যা সাড়ে ২২ লাখ। এদের বেশিরভাগের বসবাস ঢাকা ও চট্টগ্রামে। এ দুটি বড় শহরের প্রায় ৫ হাজারের মতো বস্তিতে অর্ধেকের বেশি মানুষের বাস।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্যানুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ১৬৫টি বস্তিতে আগুন লাগে। এর মধ্যে ঢাকায় ৩৩, চট্টগ্রামে ৪৩, রংপুরে ৮৮ এবং সিলেট বিভাগে ১টি বস্তি আগুনে পুড়ে যায়। এসব অগ্নিকান্ডে আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৯৩ কোটি ৬১ লাখ ৩৩ হাজার ৬৫০ টাকা। এদিকে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত সারাদেশে আগুনে ২৮টি বস্তি পুড়েছে। এসব ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ ১৮ জনের।
সর্বশেষ গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ভয়াবহ আগুনে ছাই হয়ে গেছে মিরপুরের রূপনগরের ঝিলপাড় বস্তির প্রায় ১৫ হাজার ঘর। এতে ৫০ হাজার মানুষকে আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। আগুনের সূত্রপাত কীভাবে ফায়ার সার্ভিস প্রাথমিক তদন্তে বলতে না পারলেও বস্তিবাসীর অভিযোগ সেখানে দাহ্য পদার্থ দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। তাদের অভিযোগ, একই সঙ্গে বস্তির উত্তর ও দক্ষিণ দিকে আগুন জ্বলে ওঠে। দুর্ঘটনাক্রমে আগুন লাগলে এমনটি হতো না বলে তারা মনে করেন।
ভুক্তভোগী ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, ঝিলপাড় বস্তিটি জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের জমিতে গড়ে ওঠে। ১৯৭৩ সালে রূপনগর থানার পেছনের ওই ঝিলের ২০ একর জমি গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ অধিগ্রহণ করে। স্থানীয়রা পরে নিচু জমিতে ময়লা ফেলে ঝিল ভরাট করে বস্তিঘর বানায়। ২০০০ সালে পুরো ঝিলের জমি বস্তিতে ভরে যায়। সর্বশেষ বস্তিতে প্রায় ১৫ হাজারের মতো ঘরে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ থাকতেন। প্রতিটি ঘরের ভাড়া ২ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা। এছাড়া গ্যাস, পানি, বিদ্যুতসহ অন্যান্য সেবার নামে প্রতিটি ঘর থেকে ৩০০ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হতো। ১৫ হাজার ঘর থেকে মাসে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির বিল বাবদ প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি টাকা ওঠানো হতো বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২০০১ সালের পর স্থানীয় বিএনপি ও যুবদলের কিছু নেতাকর্মী বস্তির নিয়ন্ত্রণ নেয়। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে বস্তির নিয়ন্ত্রণ নেয় ক্ষমতাসীন নেতাকর্মীরা।
ভুক্তভোগী সূত্রে জানা যায়, গত এক দশকে বনানীর কড়াইল বস্তিতে ১৭ বার অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে গত তিন বছরে লাগে ৬ বার ও গত এক বছরে লাগে তিনবার। এছাড়া গত ৩ মার্চ আগুনে কারওয়ানবাজার রেললাইন বস্তির তিন শতাধিক ঝুপড়িঘর পুড়ে যায়। এ ঘটনার চার দিন আগেই ভয়াবহ আগুন লাগে ভাসানটেকের সিআরপি ও বিআরপির মাঝখানের সরকারি জায়গায় আবুল ও জাহাঙ্গীরের বস্তিতে। এ ঘটনায় তিন শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ২০১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতেও ওই বস্তিতে আগুনে শতাধিক ঘর পুড়েছিল। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের চাক্তাই এলাকায় ভেড়া মার্কেট বস্তিতে আগুন লেগে ঘুমন্ত অবস্থায় পুড়ে মারা যায় ৯ জন। এছাড়া গত বছর ১১ মার্চ ভোরে পল্লবীর ইলিয়াস মোল্লা বস্তিতে প্রায় ২ হাজার ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এভাবে থেমে থেমে দেশের একেক এলাকার বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেই চলছে।
ভুক্তভোগী বস্তিবাসীদের অভিযোগ, বস্তিতে আগুন কোনো দুর্ঘটনা নয়। বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল সুপরিকল্পিতভাবে বস্তিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। উচ্ছেদ ও দখল, বস্তি থেকে পাওয়া টাকার ভাগাভাগি, প্রভাব বিস্তার ও মাদক ব্যবসাসহ নানা কারণে বস্তিতে আগুন লাগানো হয়ে থাকে।
জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমঞ্চের সভাপতি মাসুদ খান বলেন, বস্তিতে আগুন লাগার বিষয়টা সবসময় স্বাভাবিক নয়। অনেক সময়ই দেখা যায়, ঈদ বা বড় কোনো ছুটির সময়ে বস্তিতে আগুন লাগে। এর পেছনে দখল আর উচ্ছেদই বড় কারণ। বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এমনটাই ঘটে আসছে।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, মূলত অসচেতনতার কারণে বস্তিতে ঘন ঘন অগ্নিকান্ড ঘটে। এ ছাড়াও রান্নার পর অসাবধানতাবশত চুলার আগুন না নেভানো, যত্রতত্র সিগারেটের জ্বলন্ত অংশ ফেলা, অরক্ষিত স্থানে মোমবাতি-কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়া, অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগসহ বিভিন্ন কারণে বস্তিতে আগুন লাগে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন