আকাশে বড় একটা পূর্নিমার চাঁদ উঠেছে। একটুও মেঘ নেই। মাঝরাতে পূর্নিমার হালকা আলো ঘরের জ্বানালা দিয়ে প্রবেশ করে ঘরটাকে মায়াবী আলোয় আলোকিত করে তুলেছে। দুপুরের দিকে ডায়রীর পাতায় লিখেছিল – প্রিয়ন্তী তুমি সুখী হলে তোমায় অসুখী করে সাধ্য কার!নিজেকে সুখী করার ব্যপারে, সুখী হওয়ার ব্যপারে প্রিয়ন্তীর ধারনাটা এমন হয়েছে। শ্রাবনের সাথে বিয়ে হয়েছিল বছর দু’য়েক আগে। বেচারা হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেল। যেখানে যাবি যা, যেতে মানা করেছে কে? কিন্তু যাবার আগে যাবার কথাটা তো বলে যাবি। তাও যায়নি।শ্রাবনের কথাটা বুকের ভেতর মাঝে মধ্যে নাড়া দিলেও পাত্তা দেয় না প্রিয়ন্তী। কেন গেছে সেটাও ভাবতে ইচ্ছা করে না।পরের কথা ভেবে শুধু শুধু নিজে কষ্ট পেয়ে কি লাভ! শ্রাবন তো ওর কথা একবারের জন্যও ভাবেনি।রাতের পর রাত নির্ঘূম চোখে আকাশে জ্বলা মিটি মিটি তারা দেখে সময় পার করেনি। প্রিয়ন্তী কেন ভাববে! ফাগুনের শুরুতে কোকিল ডাকে দূরে কোথাও। প্রিয়ন্তীর ছাদে যেতে ইচ্ছে করে। মাঝরাতে ছাদে গিয়ে পূর্নিমা দেখতে ভালই লাগবে। এদিক ওদিক থেকে আসা কিছু বাতাসও ছুঁয়ে যাবে।
বিছানা ছাড়ে প্রিয়ন্তী। আস্তে করে নিজের রুমের দরজা খোলে। অনেকটা নিঃশব্দে। শব্দ মানুষের ঘুম ভেঙ্গে দেয়। মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গা দারুন কষ্টের। এ সময় ঘুম ভাঙ্গলে আর ঘুম আসতে চায় না। বাবার রুম পার হয়ে সিড়ি ঘরে যেতে হবে বলেই খুব খেয়াল করে দরজা খোলা। বৃদ্ধ বয়সে বাবা মানুষটা প্রিয়ন্তীকে নিয়ে খুব ভাবেন। হাসান সাহেবের একমাত্র সন্তান। সে সূত্রে ভাবনা আর ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু সে হবে এটাই স্বাভাবিক। বাবার রুম দিয়ে যাবার সময়, হঠাৎ করে কথা বলে ওঠেন । যেন একটুও ঘুমাননি।
- মাঝ রাতে কোথায় যাচ্ছিস?
-ছাদে যাচ্ছি।
- কেন লাফ দিবি!
- না।
- দেখিস ইদানীং তো লাফালাফির পরিমাণ খুব বেড়েছে। লাফ দিলে ফেসবুক, ডায়েরি তে কিছু লিখে যাস।
শ্রাবন চলে যাবার পর থেকে বাবা যেন কেমন হয়ে গেছেন।
-না, লাফ দেবো কেন!
-তাহলে?
-পূর্নিমা দেখবো।
-ও, আচ্ছা। একটা দীঘর্শ্বাস বের হয় বাবার কন্ঠ দিয়ে।
- তুমি ঘুমাও নি কেন?
- ঘুম আসছে না। দেখেছিস একটুও বাতাস নেই।
- না, দেখিনি। বাতাস দেখা যায় না।
প্রিয়ন্তী ছাদের দিকে পা বাড়ায়। হালকা কুয়াশা। মৃদু শীতল বাতাস। গাছে গাছে নতুন কচি সবুজ পাতা। হঠাৎ করে চোখে পড়ে একজন মানুষ! অন্ধকারে ঘুপ মেরে এককোনায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে একটা বাড়তি পিলার মনে হয়। প্রথমে চমকে উঠলেও পরমুহূর্তে নিজেকে সামাল দেয়। কে হবে। কী হবে! এগিয়ে যেতেই চাদের মৃদূ আলোয় মানুষটির মুখচ্ছবি স্পষ্ট হয়। ভাড়াটিয়া নোমান সাহেবের ছেলে রনি। পাশাপাশি বসবাস করার সুবাদে পরিচয়। সেটা বছর পেরিয়ে গেছে। দেখা হলেই ছেলেটা প্রিয়ন্তীর দিকে ডাগর ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকতো। প্রিয়ন্তী কিছু মনে করেনি। কাছাকাছি পৌঁছে পরিচয় টা স্পষ্ট হতে প্রিয়ন্তী ভাবে সে আরেক প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াবে। একা একা। নিরবে। কিছু বলা ভদ্রতা, সৌজন্য। প্রিয়ন্তী ছোট করে বলে, ও আপনি।
রনি মৃদু শব্দে হাসির সাথে বলে,বহুদিন অপেক্ষার পর....
- কী!
- তোমাকে পেয়েছি। কথা শেষ করেই প্রিয়ন্তীর হাত ধরে।
রনির দুঃসাহস দেখে যতটা না অবাক হয় তার চাইতে বেশি ভয় করে। এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে দৌড়। সামান্য এগোতেই পেছন থেকে শক্ত দুটো হাত ওর গলা চেপে ধরে। চিৎকার করার আগেই মুখের ভেতর ওড়না গুজে দেয়। সাথে সাথে পিঠের ওপর হাতের কানু দিয়ে প্রচন্ড আঘাত। কয়েকবার। প্রিয়ন্তী দুমড়ে মুচড়ে যায়। শ্বাস বন্ধ হওয়া বুকের ভেতর রাক্ষুসে কষ্ট। সামান্য শব্দ করার উপায় নেই। সে কী মরে যাবে! চেতন, অবচেতন, মৃতকল্প। তারপরও হাত পা ছুড়ে বাচার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। রনি কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফাস করে বলে, তোমার স্বামী আমার বিরুদ্ধে নালিশ দেয়। আমি মাদকাসক্ত, ব্যবসায়ী। জানতো না সবখানে আমার লোক আছে। তুমিও যে একটা কাটা সুন্দরী।
শ্রাবন..... বুকের ভেতর উচ্চারিত শব্দের পর প্রিয়ন্তী লুটিয়ে পড়ে।
বসন্তের সকাল গুলো সুন্দর হয়। মৃদু শীতল বাতাসের ছোঁয়া।পাখির কিচির মিচির গান। না হাসান সাহেবের ঘুম ভাঙ্গে বউয়ের তীব্র হেচকা টান আর কর্কশ গলার চিৎকারে। এই যে শুনছো?
-কী?
- প্রিয়ন্তী নেই। পাওযা যাচ্ছেনা। রাশিদা বেগমের গলায় ভয়।
হাসান সাহেব ঘুমভাঙ্গা আড়ষ্ট গলায় বলন, পাওয়া যাবে। ছাদে আছে।
রাশিদা বেগম দৌড়ে চলে যান একটু পরেই আবার ফিরে আসেন, হাউমাউ করে কান্নাঁজুড়ে বলেন, তোমার প্রিয়ন্তী আর নেই।
হাসান সাহেব উঠে বসেন, ছাদেও নেই! কেন লাফ দিয়েছে?
রাশিদা বেগম ফুপিয়ে কেঁদে উঠেন। নেই। কারা যেন মেরে ফেলেছে। ছাদের উপর পড়ে আছে প্রিয়ন্তীর রক্তাক্ত মৃতদেহ।
হাসান সাহেবের দুঃসংবাদ শুনতে ভালো লাগেনা।
- ডায়েরি তে কিছু লিখে গেছে?
- তুমি পাগলের মতো কী সব বলছো!
- হ্যাঁ, পাগলই তো। আমি পাগল। চিৎকার করে ওঠেন ভদ্রলোক।
মাস ছয়েক আগের ঘটনা হাসান সাহেব কেবল অফিসে ঢুকেছেন। মোবাইলে ফোন আসে। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে, একটি দুঃসংবাদ। একটা লাশ পাওয়া গেছে ড্রেনের ভেতর। সম্ভাবত আপনার ছেলে।
হাসান সাহেব অবাক হন। আমার কোন ছেলে নেই। আর থাকলেই বা সে লাশ হবে কেন! তাও আবার ড্রেনের ভেতর পড়া লাশ।
- সরি মোবাইলে আব্বু নামে আপনার নাম্বার সেভ করা।
- ভুল নাম্বার। কথাটা বললেও কৌতুহল বশত লাশের প্রাপ্তিস্থান জেনে বেরিয়ে পড়েন। ঘন্টা খানিক সময় লাগে। বেশ কিছু মানুষ জটলা পাকিয়েছে। কিছু পুলিশ ড্রেস পরে লাশটি ঘিরে আছে। চেহারার দিকে তাকাতেই চমকে ওঠেন। তার বুকের মানিক। শ্রাবণ। বাবা-মা হীন এতিম শিশুকে চায়ের দোকানে কাজ করতে দেখে বাড়িতে নিয়ে আসেন। সে অনেক বছর আগের কথা। পড়াশোনা শেষে দূরে যেতে দেননি। নিজের মেয়ের সাথেই বিয়ে দিয়েছেন। শ্রাবনের লাশটা দেখে নিজেকে অপরাধী মনেহয়। কেন এনেছিলেন? চায়ের দোকানে কাজ করলে কী কেউ তাকে মেরে ফেলতো! শহরের হাজার হাজার মৃত মানুষের মিছিলে যোগ হয় একটি বেওয়ারিশ লাশ। কথাটা প্রিয়ন্তীকে বলেন নি হাসান সাহেব। একমাত্র মেয়ে। কষ্টটা ভুলতে পারবে না। জীবন বিষন্ন হয়ে উঠবে। দুঃসংবাদ বয়ে বেড়াবে। চেয়েছিলেন, ভুল ভাল কিছু বলে, শ্রাবনকে ভুলিয়ে দিতে। স্বাভাবিক হতে পারুক প্রিয়ন্তী।হ্যাঁ, প্রিয়ন্তী খুউব স্বাভাবিক হয়ে গেছে। একেবারে স্বাভাবিক, একেবারে শান্ত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন