উত্তর বঙ্গের অন্যান্য জেলার মতো পাবনা জেলায়ও ইসলামী স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন রয়েছে। এই জেলায় তুর্কী-পাঠান মুঘলদের আগমন ঘটেছিল। পাবনা হুসেন শাহ-এর রাজত্বভুক্ত হলে অর্থাৎ পূর্ববঙ্গে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার প্রায় তিন শতাব্দী পর থেকে (১৫০০ খৃ.) এই জেলায় মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের বিকাশ শুরু হয়। এই সমস্ত নিদর্শন যেমন প্রাচীনত্বের দাবি রাখে, পাশাপাশি ইসলামী স্থাপত্যকলার এক বিস্ময়কর অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
এ প্রসঙ্গে তাড়াশের নবগ্রামে নুসরত শাহ-এর শাসনামলে (১৫২৬ খৃ.) নির্মিত, পাবনার চাটমোহরের হান্ডিয়ালে অবস্থিত শের শাহ-এর পুত্র শাহ সলিম কর্তৃক নির্মিত (১৫৪৯ খৃ.), চাটমোহরের কাজী পাড়ায় মাসুম খাঁ কাবুলীর (১৫৮১ খৃ.) এবং শাহজাদপুরের মখদুম শাহ দৌলা শহীদ মসজিদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য।বর্তমান প্রতিবেদনে পাবনার চাটমোহরের কাজীপাড়ায় অবস্থিত সৈয়দ নেতা আবুল ফতেহ মোহাম্মদ মাসুম খাঁ কাবুলী কর্তৃক নির্মিত মসজিদটি সম্পর্কে আলোকপাত করা হচ্ছে।
সম্রাট আকবরের একজন সেনাধ্যক্ষ মাসুম খাঁ কাবুলী এই মসজিদটি তৈরি করেন। মসজিদটির উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট। এর উপরি ভাগে তিনটি গম্বুজ এবং সম্মুখ ভাগে তিনটি খিলান আকৃতির গেট রয়েছে ও পশ্চিমপাশে এর রকম খিলান আকুতির আরো দুইটি গেট আছে। মসজিদের অভ্যন্তরে মেহরাবের চারদিকে ইটের সুন্দর কারুকার্য লক্ষণীয়। এটি ইসলামী স্থপত্যকলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মসজিদের অভ্যন্তরে ছোট ছোট চারটি কুলুঙ্গী রয়েছে। মসজিদের বাইরে এবং ভেতরে দেয়ালগাত্রে জাফরী ইটের সুন্দর কারুকার্য দেখা যায়। নানা কারনে এই সব নকশা এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।
অনেকের মতে, এই খিলান পরিকল্পনার মূলে আছে প্রাচীন পারস্যের সাসনীয় স্থাপত্যের প্রভাব। সাসনীয় আমলে (২১২-৬৫১ খৃ.) ইরানে এ রকম খিলান তৈরির কৌশল উদ্ভব হয়েছিল। মাসুম খাঁ কাবুলী নির্মিত মসজিদটির ভেতরে একটি কালো বর্ণের ফলক ছিল। (এটি রাজশাহী বরেন্দ্র মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে)। ফলকে খোদাইকৃত ফার্সি ভাষায় মসজিদ নির্মাণের ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে। মসজিদের সামনে ইঁদারার মধ্যে কলেমা তৈয়বের শিলালিপি দেখা যায়। মাসুম খাঁ কাবুলীর পরিচয় সম্পর্কে জানা যায় যে, তার পূর্ব পুরুষ তুর্কী জাতির কাকসাল ছিলেন। উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর জেলায় তাদের জায়গীর ছিল। পাবনার চাটমোহর অঞ্চলে কাকসালদের কয়েকজন জায়গীর নিয়ে বসতি স্থাপন করেন। এখানেই মাসুম খাঁ কাবুলীর জন্ম হয়। তার পিতার নাম ছিলো তুঈ মোহাম্মদ কাকসাল। নিজ কর্মদক্ষতায় মাত্র বিশ বছর বয়সে মাসুম খাঁ সম্্রাট আকবরের পাঁচ হাজার সৈন্যের সেনাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। নিষ্কর জায়গীর প্রথা তুলে নেওয়ায় এবং সম্রাট আকবর নতুন ধর্ম দিন-ই-ইলাহী চালু করলে ইসলামের প্রতি সম্্রাট আকবর অনুগত নন- এমন কথা ভেবে এতদঞ্চলে কাকসালরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এ সময় বারো ভূঁইয়ারা সম্্রাট আকবরের বিরুেেদ্ধ বিদ্রোহ করলে মাসুম খাঁ কাবুলী অন্যতম বারো ভূঁইয়া ঈসা খাঁর সাথে যোগ দেন (১৫৭৯ খৃ.) এবং চাটমোহরে স্বাধীন শাসন ব্যবস্থা চালু করেন। বাদশাহী ফৌজের সাথে যুদ্ধে মাসুম খাঁ কাবুলী পরাজিত ও নিহত হন (১৫৯৯ খৃ.)। অনেক ইতিহাসবেত্তার মতে পরাজিত মাসুম খাঁ কাবুলী শীতলক্ষ্যার তীরে গভীর জঙ্গলে আত্মগোপন করেন এবং সেখানে ৪৪ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। মাসুম খাঁ কাবুলীর বিদ্রোহের ইতিহাস যাই হোক, মসজিদ নির্মাণের মধ্য দিয়ে তার ধর্ম পরায়ণতার পরিচয় পাওয়া যায়। মাসুম খাঁ কাবুলীর এই মসজিদটি দীর্ঘদিন সংষ্কার না করায় ধ্বংসের পর্যায়ে চলে আসে। বিনষ্ট হয় ইটের কারুকার্য। সা¤প্রতিক সময়ে ইসলামী ফাউন্ডেশনের সৌজন্যে একটি পাঠাগার, স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় ব্যক্তিদের সহযোগিতায় সীমানা প্রাচীর নির্মিত হয়েছে। ক্ষয়ে যাওয়া ইটে সংষ্কারের ছোঁয়া পড়েনি। ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সবার এগিয়ে আসা দরকার। এই মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং শুক্রবারে জুম্মার নামাজ আদায় করতে বিপুল সংখ্যক মুসল্লী উপস্থিত হন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন