মুনশী আবদুল মাননান
‘সব জিনিসের মূল্য আছে, মানুষের দাম নাই,’ এ কথা এ মুহূর্তে আমাদের দেশে নিষ্ঠুর বাস্তবতা হয়ে ধরা দিয়েছে। মানুষ মারা যাচ্ছে নানাভাবে। অসুখ-বিসুখের কথা বাদ। এর বাইরে দুর্ঘটনা, সহিংসতা, পারিবারিক-সামাজিক কলহ-বিবাদ ইত্যাদিতে হরদম মানুষ মারা যাচ্ছে। স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক মৃত্যুর বাইরে হত্যার শিকার হচ্ছে উদ্বেগজনক হারে। সন্ত্রাসী দুষ্কৃতীর হাতে যেমন মানুষ মারা যাচ্ছে তেমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতেও মারা যাচ্ছে। মানুষের জীবন যে কত মূল্যহীন হয়ে পড়েছে, ইউপি নির্বাচনে ব্যাপক প্রাণহানি এবং গত কিছুদিনে সন্ত্রাসী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের মৃত্যুর ঘটনা তার প্রমাণ বহন করে। জীবনের এতটুকু নিরাপত্তা কোথাও নেই; না শহরে, না গ্রামে। কে কখন যে, পৈশাচিক বর্বরতার শিকার হবে, বলার উপায় নেই। নিরাপত্তার এহেন শোচনীয় অবস্থায় সঙ্গতকারণেই মানুষের উদ্বেগ ও বিচলনের শেষ নেই।
যেভাবে ইউপি নির্বাচন হয়েছে তাতে সকলেই একমত যে, এ ধরনের নির্বাচনের আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না। অনিয়ম-দুর্নীতি, দুষ্কৃতি, জালভোট, ভোট প্রদানে বাধাদান, কেন্দ্র দখল ইত্যাদির মধ্যদিয়ে ছয় ধাপের ইউপি নির্বাচন সমাপ্ত হয়েছে। এ ধরনের একটি নির্বাচনের জন্য বিশাল মূল্য দিতে হয়েছে। প্রায় দেড়শ’ মানুষ নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কারণে নিহত হয়েছে। অন্তত ১০ হাজার মানুষ আহত হয়েছে। পঙ্গু হয়েছে কমপক্ষে তিন হাজার। দেশের ইতিহাসে কোনো নির্বাচনে এত মানুষ মারা যায়নি, আহত ও পঙ্গু হয়নি। শুধু তাই নয়, এই নির্বাচনের কারণে গ্রামীণ জনসমাজের যে ক্ষতি হয়েছে তা অভূতপূর্ব, অপূরণীয়। গ্রামীণ জনসমাজের শান্তি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধন সম্পূর্ণ তছনছ ও অনিশ্চিত হয়ে গেছে। নির্বাচন শেষ হলেও এর প্রতিক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা চলছেই। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সহিংসতার খবর আসছে। বাড়িঘরে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, হত্যা, ধর্ষণ এমনকি গণবর্ষণের মতো ঘটনার খবরও পাওয়া গেছে। নিষ্ঠুরতা-বরর্বতার একটা চূড়ান্ত উৎসব চলছে যেন।
বিস্মিত হতে হয়, এই নির্বাচন নিয়েও আত্মপ্রসাদ ও কৃতিত্ব জাহিরের কমতি নেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদের। নির্বাচন ব্যবস্থার আগাপাছতলা মারার পরও তিনি দাবি করেছেন, ইউপি নির্বাচন নাকি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। লজ্জা-শরমের বালাই না থাকলেই সম্ভবত কারো পক্ষে এরকম দাবি করা সম্ভবপর। কেউ এই নির্বাচনকে ‘ভোট ও গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক’ বলে অভিহিত করেছেন। কেউ একে ‘শহীদী নির্বাচন’ বলেছেন। বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘নির্বাচনে মানুষ হত্যার বৈধতা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এতো নির্বাচন নয়, হোলি উৎসব। এর দায় নির্বাচন কমিশনের।’ কথা এটাই, প্রধান নির্বাচন কমিশনার যাই-ই দাবি করুন এই বিপুল প্রাণহানি, এই মানবিক ও আর্থিক ক্ষতি, এই সামাজিক বিবাদ-বিশৃঙ্খলার দায় নির্বাচন কমিশন এড়িয়ে যেতে পারবে না। নির্বাচন হওয়ার কথা অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ। এই মাপকাঠিতে ইউপি নির্বাচনকে নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করা যায় না। এ নির্বাচনে বিরোধী দলের প্রার্থীদের বলতে গেলে মাঠে নামতেই দেয়া হয়নি, হুমকি-ধমকি ও মামলার ভয় দেখিয়ে তাদের মাঠের বাইরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। যেখানে সম্ভব হয়নি সেখানে সন্ত্রাস কিংবা মামলায় আশ্রয় নেয়া হয়েছে। অনেকেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। অবশ্যই তারা সরকারী দলের প্রার্থী। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারী দলের এক প্রার্থী ওপর প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। মারামারি, লাঠালাঠি, কাইজা-ফ্যাসাদ মূলত তাদের মধ্যেই হয়েছে। মাঝখানে সাধারণ মানুষ হত্যা, নির্যাতন ও জুলুমের শিকার হয়েছে। গ্রামীণ জনসমাজের সার্বিক উন্নয়ন ও কল্যাণে জনপ্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই ইউপি নির্বাচন। অথচ এ লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। দেশে-বিদেশে কোথাও এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। নির্বাচন কমিশন এরকম একটি নির্বাচনী প্রহসন করে তার অদক্ষতা-অযোগ্যতারই ফের প্রমাণ দেয়নি, তার দলবাজ ভূমিকাকেও আরো স্পষ্ট করেছে। দেশ-জাতির অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করেছে।
একথা স্বীকার করতেই হবে, দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক দুর্ঘট, সামাজিক বিপর্যয় ইত্যাদির জন্য বর্তমান নির্বাচন কমিশন বিশেষভাবে দায়ী। গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্বাভাবিক চর্চা, অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন অসম্ভব করে দিয়েছে এই নির্বাচন কমিশন। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক বিকাশ রুদ্ধ করে দিয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত সাধারণ নির্বাচন থেকে সর্বশেষ ইউপি নির্বাচন পর্যন্ত সব নির্বাচনেই নির্বাচন কমিশন তার অক্ষমতা ও অযোগ্যতার পরিচয় তুলে ধরেছে। সরকারের আজ্ঞাবাহী প্রতিষ্ঠান হিসাবে তার ভূমিকা সুস্পষ্ট করেছে। এই নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কোনো নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য করা যে একেবারেই সম্ভব নয়, সে বিষয়ে এখন আর কারো মনে কোনো সন্দেহ-সংশয় নেই। বস্তুত, নির্বাচন কমিশন কর্মের মাধ্যমেই তার অপ্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করেছে। বলাই বাহুল্য, এই গণতন্ত্রহীনতা, এই রাজনৈতিক বিভক্তি, এই সংঘাত-সহিংসতা, এই অর্থনৈতিক অচলাবস্থা এবং সামাজিক দুর্বৃত্তায়নের দায় নির্বাচন কমিশনকে নিতে হবে। এই প্রাণহানি, এই মানবিক ক্ষতি ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের জন্য তাকে অবশ্যই একদিন না একদিন জনতা ও আইন-আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
পর্যবেক্ষকরা একমত, দেশে আজকে যে আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ অবনতি দৃশ্যমান, জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের উত্থান ও দৌরাত্ম্য লক্ষযোগ্য, সামাজিক বিন্যাসে ভয়াবহ অবক্ষয় ও অবনমন প্রতীয়মান, তার জন্য রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা-অস্তিরতা ও আশঙ্কাই প্রধানত দায়ী। আর এ জন্য নির্বাচন কমিশনের অবদান প্রধান। গণতন্ত্র না থাকার কারণেই এসবের সঙ্গে সঙ্গে সুশাসনের অভাব ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির প্রাদুর্ভাব হয়েছে। রাজনীতি ঠিক না হলে, গণতন্ত্রের অবাধ চর্চা নিশ্চিত না হলে এ অবস্থার অবসান হবে বলে কেউ বিশ্বাস করে না।
তিনদিনের ব্যবধানে চট্টগ্রামে পুলিশের এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খাতুন মিতু, নাটোরে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সুনীল গোমেজ এবং ঝিনাইদহে আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী নামে একজন হিন্দু পুরোহিত সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়েছেন। গত শুক্রবার পাবনায় আশ্রমের সেবক, নিত্যরঞ্জন নিহত হয়েছেন। সন্ত্রাসী-দুষ্কৃতীরা কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এ সব ঘটনা থেকে তা সম্যক অনুধাবন করা যায়। গত বছর দেড়েক এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা বেশ কিছু ঘটেছে এবং ঘটনার মোট সংখ্যা অর্ধশতের কম হবে না। যারা সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়ে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারিয়েছেন তাদের মধ্যে প্রধানত: রয়েছেন অধ্যাপক, প্রকাশক, ব্লগ লেখক ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন থেকে শুরু করে যাজক, পুরোহিত, ভিক্ষু- কেউই হামলা থেকে রেহাই পাননি। বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনাও হামলার শিকার হয়েছে। সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে, ইমাম-মুয়াজ্জিন, যাজক, পুরোহিত, ভিক্ষু এবং ধর্র্মীয় স্থাপনার ওপর হামলার জন্য বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীই দায়ী। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফে একাধিক গোষ্ঠীর নামও উল্লেখ করা হয়েছে। বিস্ময়কর বাস্তবতা হলো। একটি ঘটনার সময়ও স্পষ্ট থেকে জঙ্গি গোষ্ঠীর কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে যাদের গ্রেফতার করা বা দেখানো হয়েছে তাদের ব্যাপারেও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি। একটি ঘটনারও তদন্ত সম্পন্ন হয়নি এবং হামলাকারী বা ঘাতকদের কারো আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া যায়নি। বিশ্লেষকদের মতে, সন্ত্রাসী ও ঘাতকদের গ্রেফতার ও বিচার করতে না পারার কারণেই একই ধরনের হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনা বারবার ঘটছে। সরকারের পক্ষ থেকে লাগাতার বলা হচ্ছে, সরকারকে অস্থিতিশীল করা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি-সম্ভাব বিনষ্ট করা এবং দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য দেশী-বিদেশী চক্র এসব হামলা ও হত্যাকা- ঘটিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সরকার সেই দেশী-বিদেশী চক্রের সদস্য ও হোতাদের খুঁজে বের করে জাতির সামনে পেশ করতে পারছে না। মাঝে মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এসব ঘটনা বিরোধী দল ঘটাচ্ছে। অথচ এই দাবির স্বপক্ষে উপযুক্ত প্রমাণ হাজির করতে পারছে না। বিরোধী দলের তরফেও পাল্টা বক্তব্য দিয়ে বলা হচ্ছে, এসব হামলা ও হত্যাকা-ের সঙ্গে সরকারী দল বা মহল জড়িত। এরও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ বিরোধী দল দিতে পারছে না। বিষয়টি রাজনৈতিক ব্লেম গেমের শিকার হচ্ছে যা অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক। এতে প্রকৃত অপরাধীদেরই সুবিধা হচ্ছে। তারা একটি আডাল পেয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো হামলা ও হত্যাকা-ের দায় মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আইএস স্বীকার করলেও সরকার তা মানতে নারাজ। সরকারের কথা, দেশে আইএস বা ওই ধরনের কোনো জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব নেই। যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী দেশগুলো সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের প্রতিটি ঘটনার পরপরই গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং সন্ত্রাস দমনে সরকারের সঙ্গে একাট্টা হয়ে কাজ করার আগ্রহ প্রদর্শন করছে। কদিন আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, বিশ্বে যে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে চলেছে, বাংলাদেশে সংঘটিত ঘটনা তার থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। সন্ত্রাস দমনে সহযোগিতা করার আগ্রহ ও প্রস্তাবের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর কী উদ্দেশ্য রয়েছে, আলোচ্য বিষয় হিসাবে তা বিশেষ গুরুত্ব লাভ করতে পারে। তবে উদ্দেশ্য নিয়ে মাথা ঘামানোর চেয়ে আমাদের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ হলো, যে কোনো মূল্যে সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা- প্রতিরোধ করা, দুষ্কৃতীদের দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। বলা বাহুল্য, এক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ, আয়োজন, সাফল্য ও অর্জন কোনটাই উল্লেখযোগ্য ও সন্তোষজনক নয়। ফলে একের পর এক সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা- ঘটছে; সরকার কিছুই করতে পারছে না।
কোথায় কে, কোন ধর্মের মানুষ কিংবা ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এবং ধর্মীয় স্থাপনা সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হবে কারো পক্ষেই বলা সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ক্রমাগত বাড়ছে। ওদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ক্রস ফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনাও সম্প্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে। ৭২ ঘণ্টার ব্যবধানে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৯ জন কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। বন্দুকযুদ্ধ নতুন নয়। তবে তার সংখ্যা বৃদ্ধি নতুন করে ভীতি ছড়িয়ে দিয়েছে। ৫৪ ধারার গ্রেফতার, সাদা পোশাকে গ্রেফতার ও রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের নামে পীড়ন-নির্যাতনের বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের অভিমতের পর গ্রেফতার ও রিমান্ড বিষয়ে কিছুটা স্বস্তির ভাব দেখা দিলেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের সংখ্যা বাড়ার কারণে সেই স্বস্তি উধাও হতে বসেছে। তার স্থলে আতঙ্ক বিস্তার লাভ করছে। সন্ত্রাসী ও জঙ্গি দমনে কঠোর ব্যবস্থাগ্রহণ অত্যাবশ্যক বলে বিবেচিত হলেও এর অংশ হিসাবে বিচারবহিভূর্ত হত্যাকা-কে কেউ সমর্থন করে না। বিচারবর্হিভূত হত্যাকা- নাগরিক অধিকারেই বড় রকমের লঙ্ঘন নয়, এটা সুচিবার প্রাপ্তির নিশ্চয়তাও বাধাগ্রস্ত করে। সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের সন্দেহভাজনকে কথিত বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে সরিয়ে না দিয়ে যদি তাকে বিচার-প্রক্রিয়ার আওতায় আনা যায় তাহলে সন্ত্রাসের কারণ ও পেছনের হোতাদের শনাক্ত করা অনেক সহজ হতে পারে। এটা সন্ত্রাস মোকাবিলায় অধিক কার্যকর বলে প্রমাণিত হতে পারে।
লাগাতার প্রাণহানি, সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা- এবং কথিত বন্দুকযুদ্ধ জনমনে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে দিয়েছে তার আশু অবসান কাম্য। এ জন্য মূল কারণের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করা জরুরি। মূল কারণ যে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। রাজনীতি সুস্থ ধারায় প্রবাহিত হলে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংবিধানিক ও নিয়মতান্ত্রিক পথে পরিচালিত হলে দেশ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের ঝুঁকি থেকে সহজেই মুক্ত হতে পারে। সুষ্ঠু রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুপস্থিতির কারণেই জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠার সুযোগ পাচ্ছে। তাদের রোখা বা প্রতিহত করার পথ হলো, রাজনীতির নির্বাধ চর্চা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা। আইনের শাসন ও সুবিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠিত হলে উন্মুল জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা আপনা আপনিই কোণঠাসা এবং অবশেষে নির্মূল হয়ে যাবে।
সর্বাগ্রে মানুষ ও তার নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছু এ দুনিয়াতে নেই। কারণে-অকারণে প্রাণহানি ও হত্যা রুখতে হবে। এজন্য রাজনৈতিক ঐকমত্যের পাশাপাশি সম্মিলিত উদ্যোগ-পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিশঙ্খলা আরো বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয়, সন্ত্রাস আরো সন্ত্রাসের জন্ম দেয় এবং হত্যাকা- আরো হত্যাকা-ের জন্ম দেয়। জনগণের শান্তি, নিরাপত্তা, উন্নয়ন। সমৃদ্ধি ও বিকাশ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবিদার। এদিকেই রাজনৈতিকভাবে, জাতিগতভাবে আমাদের নজর ও গুরুত্ব দিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন