মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

মুসলিম ইতিহাস ও ঐতিহ্যে হিজরী সন

মুহাম্মদ আতিকুর রহমান | প্রকাশের সময় : ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

স্বাগতম ১৪৪১ হিজরী সন। ইসলামী জীবন-বিধানে এ হিজরী সনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। এ সনের সাথে মিশে আছে মুসলিম ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আদর্শ। সময়ের পরিক্রমায় হিজরী সনের মাসগুলোর আগমন ও এর বিভিন্ন ঘটনা স্মরণে মুসলমানদের ঈমানী শক্তি বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে যায় এবং এর দ্বারা ইসলামী বিধি-বিধান পালনে আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌছে যায়। আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকেই সময়ের হিসাব গণনার জন্য চন্দ্র ও সূর্যের মাধ্যমে বছরে বারোটি মাস নির্ধারণ করেছন এবং সময়ের পরিক্রমায় বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠি হিসাব নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন নামে এ বারো মাসের ব্যবহার করে আসছে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠি যুগে যুগে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি নির্ধারণ করেছে; এর মাঝে উল্লেখযোগ্য: জুলিয় বর্ষপঞ্জি, গ্রেগরয়ি বর্ষপঞ্জি, ইরানিয় বর্ষপঞ্জি, বাইজেন্টাইন বর্ষপঞ্জি, হিজরী বর্ষপঞ্জি, চীনা বর্ষপঞ্জি, কোরীয় বর্ষপঞ্জি, বুদ্ধাব্দ ও মায়া পঞ্জিকা। আল্লাহ তাআলা আল-কুরআনে এ প্রসঙ্গে ইরশাদ করেছেন, “নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে মাসগুলোর সংখ্যা হচ্ছে বারো, যেদিন থেকে তিনি মহাকাশমÐল ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, এর মধ্যে চারটি হচ্ছে পবিত্র মাস” (আল-কুরআন, তাওবা-৩৬)।

প্রাচীনকাল থেকেই আরবরা বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভিক্ত ছিল এবং নানা কারণে তাদের মাঝে যুদ্ধ লেগে থাকতো। আরবদের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি ছিল পশু-চারণ ও ব্যবসা-বাণিজ্য; তারা মক্কা ছাড়াও হিজাজ, ইয়েমেন ও ওমানের বিভিন্ন স্থানে বসতী স্থাপন করেছিল এবং ব্যবসা-বাণিজ্য তারা বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করতো। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকেও আদম সন্তানেরা কাবা ঘরের তাওয়াফ ও হজ্জের উদ্দেশ্যে বছরের বিভিন্ন সময়ে মক্কায় আগমন করত। আরবরা চন্দ্র বৎসর হিসাবে দিন মাস গণনা করতো, কিন্তু তাদের কোন নির্দিষ্ট বর্ষ পঞ্জিকা ছিল না। ফলে বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘বর্ষ গণনা’ করা হত। যেমন আমুল ফীল, আমুর রিমাদাহ, আমুত ত্বাউন, হারবুল ফুজ্জার, আমুল হুযুন ইত্যাদি

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর রা. ৬৩৮ খৃস্টাব্দে ধর্মীয়, প্রসাশন ও আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন কারণে মুসলিম জাতির ‘বর্ষপঞ্জি’ প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সা. হিজরতের গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে স্মরণ করে ‘হিজরী সনের’ গোড়াপত্তন করেন। হিজরত একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ হলো ত্যাগ করা, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করা। ইসলামের ইতিহাসে মক্কায় রাসূল সা. ও সাহাবায়ে কেরামের উপর অত্যাচার ও নির্যাতনের প্রেক্ষিতে ইসলামের প্রচার ও প্রসার করে নতুন জাতি গঠনের জন্য আল্লাহর নির্দেশে রাসূল সা. ও সাহাবাগণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্থান মক্কা নগরী ত্যাগ মদিনায় গমন করেছিলেন, তাই হিজরত। ‘হিজরী সন’ চন্দ্র গণনার উপর নির্ভরশীল, এর মাসগুলো ২৯ বা ৩০ দিনে পূর্ণ হয়। এ কারণে খৃস্টীয় বর্ষ থেকে হিজরী বর্ষ ১০ বা ১১ দিন কম হয়ে ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিনে প্রতি বৎসরের সমাপ্তি ঘটে। হিজরী বর্ষের মাসগুলো খৃস্টীয় বর্ষের বিভিন্ন মাসে প্ররিভ্রমণ করে এবং এ চক্রটি প্রতি ৩৩ বছরে পুনারাবৃত্তি করে।

আরব জাতি বহু পূর্ব থেকেইে যুদ্ধ-বিগ্রহ, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং কাবা ঘর নির্মাণ, হজ্জ ও কুরবানীর ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন নামে এ মাসগুলোর গণনা করে আসছিল। রাসূল সা. এর জন্মের ১৫০ বছর পূর্বে তাঁর ৫ম পূর্ব পুরুষ ‘ক্বিলাব’ বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠির সাথে পরামর্শ করে এ বারো মাসের নামকরণ করেন। আর তা হলো:

মুহাররম: হিজরী বৎসরের ১ম মাস। মুহাররম অর্থ ‘নিষেধাজ্ঞা’। আরবরা যে কয়েকটি মাসে যুদ্ধ বিগ্রহ থেকে বিরত থাকত তার মধ্যে মুহাররাম
অন্যতম। উক্ত মাস যেহেতু নিষিদ্ধ ও সম্মানিত, তাই উক্ত নামে অভিহিত করা হয়েছে। এ মাসের ১০ তারিখে আল্লাহ তাআলা হযরত মূসা আ. ও তার অনুসারীদেরকে ফেরাউনের অত্যাচার থেকে মুক্ত করেন এবং ফেরাউনকে নীল নদে ডুবিয়ে মারেন। ১০ই মুহাররমকে কেন্দ্র মুসলমানগণ রোজাব্রত পালন করে থাকেন। রাসূলুল্লাহ সা. এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন রা. কারবালা প্রান্তরে এজিদের সৈন্য দ্বারা শহীদ হন এ মাসেরই ১০ তারিখে।

সফর: হিজরী বৎসরের ২য় মাস। সফর অর্থ খালি বা শূন্য। এ সময়ে আরবা যুদ্ধ ও সফরের উদ্দেশ্যে নানা স্থানে যেত, তাই এ সময় তাদের ঘর-বাড়ী খালি বা শূন্য হয়ে যেত। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, এ সময়ে যুদ্ধে পরাজিতদের বাড়ি-ঘরে লুট-তারাজ চালানো হতো, ফলে তাদের বাড়ি-ঘর খালি হয়ে যেত এবং আরবরা তাদের বাড়ি-ঘর শূন্য রেখে পালিয়ে যেত। রবিউল আওয়াল ও রবিউস সানি: হিজরী বৎসরের ৩য় ও ৪র্থ মাস। ‘রাবীউন’ অর্থ বসন্ত। এ সময় তাদের গবাদী পশুদের চারণ ভূমিতে সাচ্ছন্দ্যে নিয়ে যেত। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে মানবতার মুক্তির দূত শেষ নবী ও রাসূল মুহাম্মদ সা. রবিউল আওয়াল মাসে জন্ম গ্রহণ করেন এবং মৃত্যু বরণ করেন।

জামাদিউল আওয়াল ও জামাদিউল আখির বা জামাদিউস সানি: হিজরী বর্ষের ৫মও ৬ষ্ঠ মাস। এ সময়টায় মরু আরবের পানি জমে বরফ হয়ে যেত। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, এ সময়টা গ্রীষ্ম কালীন খরতাপে সব শুষ্ক হয়ে যেত। এ মতপার্থক্যের কারণ হচ্ছে, হিজরী বৎসর খৃস্টীয় বৎসরে থেকে কম হওয়া তার মাসগুলো বিভিন্ন ঋতুতে পরিভ্রমণ করে থাকে।

রজব: হিজরী বর্ষের ৭ম মাস। রজব শব্দটি আরবী ‘তারজীব’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘সম্মান করা’। কারণ এটি সর্বদা একটি পবিত্র সময় হিসেবে বিবেচিত হত। যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধের চারমাসের মধ্যে রজব অন্যতম। এ মাসেই মুহাম্মদ সা. মেরাজের মাধ্যমে আল্লাহর একান্ত সন্নিধ্য লাভ করেন।

শা‘বান: হিজরী বর্ষের ৮ম মাস। শাবান অর্থ ‘ছড়িয়ে পড়া’। পবিত্র রজব মাসের পর আরবরা তাদের শত্রæদের বিরুদ্ধে লড়ায়ের জন্য বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়তো। এ সময় তারা পানির সন্ধানেও বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়তো। এ মাসে রাসূল সা. অধিকহারে রোজাব্রত পালন করতেন এবং হাদিসে এ মাসের ১৪তম তারিখের দিবাগত রাত্রি ‘নিসফে শা‘বান’ নামে অবহিত করা হয়েছে এবং মুসলিমগণ এ রাতে ইবাদত করে থাকেন।

রামাদান: এ মহিমান্বিত মাসটি হিজরী বর্ষের ৯ম মাস। রামাদন শব্দটি ‘রামাদা’ শব্দ থেকে উৎপত্তি, এর অর্থ ‘তীব্র গরম’। এ সময় আরব উপদ্বীপে প্রচÐ উত্তপ্ত আবহাওয়া আসত। আল কুরআন ও হাদিসে গুরুত্বের সাথে এ মাসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা এ মাসেই আল-কুরআন নাযিল করেছেন ও মুহাম্মদ সা. নবুওয়্যাত লাভ করেন এবং মুসলমানগণ এ মাসে ইসলামের ফরয বিধান রোজাব্রত পালন করে থাকেন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ রজনী ‘লাইলাতুল ক্বাদর’ এমাসেই রয়েছে। ১৭ই রামাদান বদর প্রান্তে মুহাম্মদ সা. এর নেতৃত্বে মুসলমানগণ প্রথম সশস্ত্র ও সম্মুখ যুদ্ধে মক্কার কাফির-মুশরিকদের পরাজিত করেন।

শাওয়াল: হিজরী বর্ষের ১০ম মাস। শাওয়াল শব্দটি ‘তাশাওয়াল’ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ ‘উঠিয়ে রাখা’। এ সময় আরবের উটনীগুলো গর্ভধারণের ফলে দূর্বল হয়ে যেত এবং তাদের দুধ কমে আসত। আরবদের অন্যতম খাদ্য দুধ-এর দূষ্প্রাপ্যতার কারণে তাদের মন্দ সময় কাটত। একমাস রোজাব্রত পালনের পর আল্লাহ তাআলা এ মাসের প্রথম দিবসকেই মুসলমানদের জন্য ঈদের দিন নির্ধারণ করেছেন এবং এ মাসে ৬টি রোজা পালনের মাধ্যমে মুসলমানগণ সারা বছর রোজা রাখার সাওয়াব পেয়ে থাকেন।

জিলক্বাদ: হিজরী বর্ষের ১১তম মাস। জিলক্বাদ শব্দটি ‘ক্বউদ’ শব্দ থেকে নিষ্পন্ন, যার অর্থ ‘বিশ্রাম’। আরবদের প্রথা অনুয়ায়ী ‘সম্মানিত ও যুদ্ধ নিষিদ্ধ’
৪টি মাসের প্রথম মাস এটি। এ সময় তারা যুদ্ধ ও সফর পরিহার করে বাড়িতে বিশ্রাম নিত এবং হজ্জের প্রস্তুতি নিত।

জিলহাজ্জ: হিজরী বর্ষের সর্বশেষ ১২তম মাস এটি। আরবরা প্রাচীনকাল থেকেই এ মাসে হজ্জ পালন করত, তাই এ মাসের নাম জিলহাজ্জ নির্ধারণ করেছে। এ সময় তারা হজ্জ যাত্রীদের সাহায্য সহযোগিতা এবং তাদের সাথে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করত। ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ হজ্জ। এ সময় সারা বিশ্ব থেকে মুসলমানগণ হজ্জ পালনের জন্য আরবে গমন করেন এবং মিনা, আরাফা, মুযদালিফাসহ বিভিন্ন স্থানে হজ্জের বিধি-বিধান পালন করেন। ১০ জিলহজ্জ সারা বিশ্বের মুসলমানগণ হযরত ইবরাহীম আ. কে স্মরণ ও আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নে পশু কুরবানী করেন এবং ঈদুল আদহা উদযাপন করেন।

রাসূলুল্লাহ সা. ও সাহাবায়ে কিরামের হিজরতের মাঝে রয়েছে ত্যাগ ও আনুগত্যের মাধ্যমে নতুন জাতি গঠনের প্রেরণা। তাই আসুন ‘হিজরী সনের’ ইতিহাস, ঐতিহ্য আদর্শকে লালন করে বাংলাদেশে বিরাজমান নানা সমস্যা ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করি এবং ইসলামী বিধানসমূহ সঠিকভাবে পালন করে উভয় জগতের কল্যাণ লাভ করি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Khaled Reza ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ৬:১৫ এএম says : 0
Very good.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন