সাতচল্লিশের আগস্ট মাস যেমন আমাদের জাতীয় ইতিহাসে অমর হয়ে আছে পৌনে দু’শ বছরের সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার কারণে, সাতচল্লিশের সেপ্টেম্বর মাসও তেমনি বিখ্যাত হয়ে আছে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ভিত্তিরূপী ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরুর মাস হিসাবে। আজকের নতুন প্রজন্মের কাছে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তারা চোখ বুঁজে বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির কথা বলবেন। কিন্তু ইতিহাসের কোন বড় ঘটনাই হঠাৎ করে রাতারাতি সংঘটিত হয় না।
ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন সম্পর্কেও একথা সত্য। ভাষা আন্দোলন হঠাৎ করে বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি রাতারাতি সংঘটিত হয়নি। এরও একটা দীর্ঘ পটভূমি ছিল। ইতিহাস-গবেষকরা জানেন, উনিশ’শ সাতচল্লিশে যখন উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে তখন এ সংগ্রামের নেতৃত্বে ছিল এ উপমহাদেশের দু’টি রাজনৈতিক দল। এর একটি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। আরেকটি নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। প্রথমটির দাবি ছিল ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ অবিভক্তভাবে স্বাধীন হতে হবে। অপর পক্ষে মুসলিম লীগের দাবি ছিল ব্রিটিশ শাসিত ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাসমূহে একাধিক স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রর প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মুসলিম লীগের এ দাবি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব হিসাবে ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
যদিও এ দাবির কোথাও ‘পাকিস্তান’ শব্দ ছিল না, তারপরও পরবর্তী দিন সকল হিন্দু পত্রিকায় এ খবরটি প্রকাশিত হয় ‘পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত’ এ শিরোনামে। পরবর্তীকালে মুসলিম লীগও এ আন্দোলনকে পাকিস্তান আন্দোলন হিসাবেই মেনে নেয় এবং উপমহাদেশের মুসলিম জনগণ এ দাবির সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ হয়।
মুসলিম লীগের এ দাবির সমর্থনে তদানীন্তন অবিভক্ত বাংলার মুসলমানদেরই যে অধিক অবদান ছিল তার কারণও ছিল। প্রথমত: মুসলিম লীগের জন্মই হয় ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে ১৯০৬ সালে। ঐ বছর ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে নিখিল ভারত মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন নামের একটি সম্মেলন আহ্বান করা হয় এবং ঐ সম্মেলনে উপস্থিত ডেলিগেটদের নিয়ে মুসলমানদের একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অধিবেশনে ভারতের মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনার কথা ছিল।
এই অধিবেশনে তদানীন্তন উদীয়মান মুসলিম নেতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি এ আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন এই যুক্তিতে যে, এর ফলে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে পরিচালিত স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভক্তি আসবে এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম দুর্বল হয়ে পড়বে। তিনি (মুহম্মদ আলী জিন্নাহ) তখনও কংগ্রেসের নেতৃত্বে ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষপাতী ছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলন এবং স্বতন্ত্র স্বাধীনতা সংগঠনেরও ঘোরতর বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে ‘হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূত’ হিসাবেও বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন।
কিন্তু এই মুহম্মদ আলী জিন্নাহই নির্মম বাস্তবতার আলোকে পরবর্তীকালে শুধু কংগ্রেস বিরোধীই হয়ে ওঠেন না, মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র স্বাধীন আবাসভূমি তথা পাকিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। পাকিস্তান আন্দোলন বিশেষত তদানীন্তন বাংলায় কতটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে তার প্রমাণ মেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ শীর্ষক গ্রন্থেও। বঙ্গবন্ধু এই গ্রন্থে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, অখন্ড ভারতে মুসলমানদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে এই আশঙ্কায়ই তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ব্রিটিশ-শাসিত বেঙ্গল তথা তদানীন্তন বাংলাদেশে পাকিস্তান আন্দোলন কতটা জনপ্রিয় হয়েছিল, তার প্রমাণ মেলে ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে। এই নির্বাচনের প্রধান ইস্যুই ছিল মুসলমানরা মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবি সমর্থন করে, না তারা কংগ্রেসের অখন্ড ভারতের দাবির সমর্থক।
১৯৪৬ সালের এ গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ নির্বাচনে শুধু তদানীন্তন বাংলা প্রদেশেই মুসলিম লীগ বিজয়ী হয়ে লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরওয়ার্দীর নেতৃত্বে সরকার গঠন করে পাকিস্তান দাবির সমর্থনে কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর হাত শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়। বর্তমান পাকিস্তান নামে পরিচিত রাষ্ট্রের কোনো প্রদেশেই বাংলার মতো এমন নিরঙ্কুশ সমর্থন লাভে সক্ষম হয়নি মুসলিম লীগ।
পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে বাংলার মুসলমানদের এ ঐতিহাসিক অবদানের কারণে পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে বাংলার প্রত্যাশাও ছিল অত্যধিক এবং সেটা ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলার মুসলমানদের এই প্রত্যাশা কখনও পূরণ হয়নি। প্রথমত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজধানীসহ সেনা বাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী অর্থাৎ সমগ্র প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদর দপ্তর তদানীন্তন পাকিস্তানের পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত হবার কারণে সামরিক শক্তির ভারসাম্য তদানীন্তন পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে রক্ষিত হতে পারছিল না।
শুধু তাই নয়, সমগ্র পাকিস্তানের জনসংখ্যার অধিকাংশ বাস করত তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানে। তারা ছিল বাংলা ভাষাভাষী। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে উর্দুভাষীদের সংখ্যাধিক্যের সুযোগে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগেই উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সমগ্র দেশের উপর চাপিয়ে দেয়ার একটা গোপন চক্রান্ত শুরু হয়ে যায়। তার প্রমাণ পাওয়া যায় নতুন রাষ্ট্রের পোস্টকার্ড, এনভেলপ, মানি অর্ডার ফর্ম প্রভৃতিতে ইংরেজির পাশাপাশি শুধু উর্দুর ব্যবহার থেকে।
এর প্রতিবাদেই পূর্ব পাকিস্তানে গড়ে ওঠে একটি আন্দোলন যা ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই আন্দোলন গড়ে তুলতে এগিয়ে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের তরুণ শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম। যে সংগঠনের মাধ্যমে এই ভাষা আন্দোলন গড়ে ওঠে, তার নাম ছিল তমদ্দুন মজলিস। ১৯৪৭ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর জন্ম নেয়া এই সংগঠনের পক্ষ থেকে উনিশশ’ সাতচল্লিশের ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা, না উর্দু’ শীর্ষক একখানি পুস্তিকা প্রকাশের মাধ্যমে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন শুরু করা হয়।
শুধু ভাষা আন্দোলনের স্বপক্ষে পুস্তিকা প্রকাশের মাধ্যমেই অধ্যাপক আবুল কাসেম নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ছাত্র শিক্ষকদের নিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠান ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবির প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে বলার কাজ অব্যাহত রাখেন। এর ফলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন যত সহজে বলা হলো, তা মোটেই ততটা সহজ ছিল না। যদিও তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের (বর্তমানের পাকিস্তান) কোনো প্রদেশের মাতৃভাষা উর্দু ছিল না, তবুও তাদের শিক্ষিত সমাজ মোটামুটিভাবে উর্দু বুঝতেন। সুতরাং এ ব্যাপারে তাদের তেমন অসুবিধা হতো না। তাছাড়া ভারতের অন্যান্য প্রদেশের যেসব অফিসার অপসন দিয়ে পাকিস্তানে এসে পূর্ববঙ্গে পদায়ন লাভ করেন তারা সবাই উর্দু বুঝতেন। সুতরাং পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই ছিলেন উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সমর্থক। ফলে ভাষা আন্দোলন এখন যতটা সহজ মনে করা হয় তখন তা মোটেই সহজ ছিল না।
১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ে উর্দু বিভাগে ভর্তির ক্ষেত্রে বেশ ভীড় ছিল। অথচ বাংলায় অনার্স নিয়ে সে বছর ভর্তি হয়েছিলাম মাত্র তিন জন
ছাত্রছাত্রী: আমি, নূরুল ইসলাম পাটোয়ারী এবং মমতাজ বেগম। এদের মধ্যে আমি ১৯৫০ সালে পড়ালেখা বাদ দিয়ে তমদ্দুন মজলিসের কাজের
প্রয়োজনে মজলিসের সার্বক্ষণিক কর্মী হয়ে যাই। আমি পড়া বাদ দেয়াতে নূরুল ইসলাম পাটোয়ারীও নিরুৎসাহিত হয়ে পড়াশোনা বাদ দেন। ফলে শুধু মমতাজ বেগম (পরবর্তীকালে মমতাজ মল্লিক) একাই অনার্স পরীক্ষা দিয়ে কোন ক্লাস না পেয়েও প্রথম স্থান অধিকার করেন। এই মমতাজ বেগম (মমতাজ মল্লিক) পরবর্তীকালে ইডেন কলেজের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল হয়ে রিটায়ার করেন। আমিও পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এ. কে আহমদুল্লাহর সৌজন্যে ১৯৬২ সালে সমাজকল্যাণ বিষয়ে মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ ও ঢাকা আবুজর গিফারী কলেজে অধ্যাপনা করার সুযোগ লাভ করি। অন্যদিকে আমাদের অন্যতম ক্লাসফ্রেন্ড নূরুল ইসলাম পাটোয়ারী শিক্ষকতা করতে না পারলেও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করেন।
যে বিষয় নিয়ে আজকের এ লেখা শুরু করেছিলাম, সে বিষয়ে আবার ফিরে আসি। আজ আমরা বাংলাদেশ নামের যে স্বাধীন রাষ্ট্রের গর্বিত নাগরিক, তার মূলে ছিল ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যে পাকিস্তান গঠিত হয়, তাতে বাঙালি মুসলমানদের যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল, সে কথা আগেই বলেছি। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা সংস্থা নিখিল ভারত মুসলিম লীগের জন্মই হয় ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে। তাছাড়া ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান ইস্যুতে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে একমাত্র অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগ জয়ী হয়ে হোসেন শহীদ সোহরওয়ার্দীর নেতৃত্বে সরকার গঠন করে পাকিস্তান দাবিতে কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর হাতকে শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়।
সেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে সুবিচার না পেয়ে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়, তারই পরিণতিতে প্রথমে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। সুতরাং, উনিশশ’ সাতচল্লিশের সেপ্টেম্বরে যে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন শুরু হয় তারই চূড়ান্ত প্রতিফল হিসেবে আজ আমরা বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রের গর্বিত নাগরিক হতে পেরেছি, একথা বলাই বাহুল্য।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন