বাংলার ইতিহাসে বাঙালির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দু’টি গৌরবোজ্জল ঘটনা হলো বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা এই দুটি মহান আন্দোলনে বিজয়ী হয়েছি। আজ সেই মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ এর মহান ভাষা আন্দোলনে এ দেশের সর্বস্তরের নর-নারী স্বতঃস্ফূর্তভাবে শরীক হয়েছিলেন। আমাদের বাহান্নর এই মহান ভাষা আন্দোলনে বিপ্লবের সঙ্গী ছিলেন নাম জানা-অজানা অনেক নারী। ভাষা আন্দোলনের এই সব বিপ্লবী নারীদের নাম বিস্মৃতির অতল তলে হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকের নাম হয়তো আমরা সবাই ভুলে যেতে বসেছি। একুশ মানে মাথা নত না করা। এখানে সেই ভাষা আন্দোলনের অমর সেই সব নারীদের কথা তুলে ধরা হলো-
রওশন আরা বাচ্চু : জন্ম ১৯৩২ সালে মৌলভী বাজার জেলায়। ১৯৪৭ সালে বরিশাল বি.এম. কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হয়েও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবিতে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশ স্থানটিতে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে আহত হন রওশন আরা বাচ্চু। তিনি কুলাউড়া গালর্স স্কুল, ঢাকার আনন্দময়ী গালর্স স্কুল, নজরুল একাডেমীসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন সুনামের সাথে।
মমতাজ বেগম : ১৯১৬ সালের ২০ মে হিন্দু পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন মমতাজ বেগম। তার আসল হিন্দু নাম ছিল কল্যাণী রাণী। কলকাতায় অবস্থান কালেই তিনি ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলনের মমতাজ বেগমের নাম কিংবদন্তি হয়ে রয়েছে। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন নারায়ণগঞ্জ মর্গান হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। ভাষা আন্দোলনের অংশগ্রহণের দায়ে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। পুলিশ ও কোর্টের কাছে তিনি মুচলেকা দিয়ে মুক্তির বিরুদ্ধে অনীহা প্রকাশ করেন ও পরবর্তীতে জেলে নিজ কর্মকান্ডে অবিচল থেকে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেন।
সুফিয়া আহম্মদ : জাতীয় অধ্যাপিকা সুফিয়া আহম্মদ এর জন্ম ফরিদপুর জেলায়। তিনি রাজমোহন কলেজ থেকে আইএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপিকা হিসাবে যোগদান করেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রথম সারিতে ছিলেন তিনি। পুলিশের কাঁদুনে গ্যাস ও লাঠির আঘাতে সুফিয়া আহম্মদ আহত হন। পরবর্তীতেও তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
ডঃ শাফিয়া খাতুন : জন্ম ১৯৩১ সালে উত্তর বঙ্গের লালমনিরহাটে। লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার চিরকুমারী কৃতি কন্যা ড. শাফিয়া খাতুন ১৯৮৩ সালে প্রেসিডেন্ট হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের সময় সমাজ কল্যাণ ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নিয়োগ হন। ১৯৫১-৫২ সালে ছাত্রী অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়ে তিনি উইমেন্স স্টুডেন্টেস ইউনিয়নের ভিপি ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নিবাস, চামেলি হাউজের ছাত্রীদের নিয়ে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে এক দূর্জয় প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার আহ্বান ছিল তাঁর
মতো তেজী নেত্রীর। তিনি তৎকালীন রোকেয়া হলের প্রভোষ্টের দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সাথে। ড. শাফিয়া খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ও একজন সদস্য ছিলেন।
হামিদা রহমান : বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভাষা সাব কমিটিতে হামিদা রহমান সদস্য মনোনীত হন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ হামিদা রহমানের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল বের হয়। “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” ধ্বনীতে মুখরিত করেছিলেন চারদিক। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোওনা জারি হয়। পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে রাতে যশোর কলেজের বৈঠকে তিনি ছেলেদের পোশাক পরে সভায় যোগ দেন। পুলিশের ওয়ারেন্টের অত্যাচারে তিনি সে সময় আত্মগোপন করতে বাধ্য হন।
ডা. কাজী খালেদা খাতুন : জন্ম পিরোজপুর জেলার স্বরূপ কাঠিতে। ৫২’ এর ভাষা আন্দোলনের সময়ে ডা. কাজী খালেদা খাতুন ঢাকার কামরুন্নেসা স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। তিনি সে সময় মিছিল, সমাবেশ ও অবরোধে সক্রীয় ভাবে অংশগ্রহণ করেন। স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশে ২১ ফেব্রুয়ারি আমতলার সভায় তিনি বক্তব্য রেখেছিলেন। পরবর্তী ৫২’ এর ভাষা আন্দোলনের সেই উত্তাল দিনগুলোতেও রাষ্ট্রভাষা দাবির পক্ষে মিছিল করেছেন। ১৯৭০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রভাষক ছিলেন। পরবর্তীতে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং বর্তমানে ঢাকার কলাবাগানে বসবাস করছেন।
জুলেখা হক ঃ ১৯৫২ সালের প্রথম থেকেই উর্দূকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে জুলেখা হক সে সময় বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। একুশে ফেব্রুয়ারিতে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জনতার সমাবেশে জুলেখা হক অংশ গ্রহণ করেন।
গুলে ফেরদৌস ঃ রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনে উত্তাল দিনে গুলে ফেরদৌস ছিলেন ঢাকার ইডেন কলেজের ছাত্রী। ইডেন কলেজ হোস্টেলের মিছিলে ও সমাবেশগুলো ফেরদৌস সক্রিয়ভাবে নিয়মিত অংশগ্রহণ ও বক্তব্য রেখেছেন। ইডেন কলেজের মেয়েরা তার সান্নিধ্যে এসেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সে সময় জোরালো ভূমিকা পালন করে। তিনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ছেলেদেরকেও সে সময় সহযোগিতা করেছিলেন।
দৌলতুন্নেসা খাতুন ঃ জন্ম ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর স্টেশন মাস্টার পিতার নাম মুহম্মদ ইয়াসিন আলী। দৌলতুন্নেসার শিক্ষা জীবন শুরু হয় নীলফামারী জেলার ডোমারে। দৌলতুন্নেসার বিয়ে হয় ডা. হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে এম.এ পাস করেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন পূর্ব বাংলার সর্ব প্রথম রাজনীতিবিদ। ১৯৫৪ সালে ও ১৯৫৬-৫৭ সালে তিনি প্রাদেশিক পরিষদের এমএলএ নির্বাচিত হন। সংগ্রামী এই নেত্রী বহুগল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ লিখেছেন, অনন্য গুণের অধিকারীনি দৌলতুন্নেসা খাতুন ছিলেন সেকালের সমাজ সেবিকা, প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও নামকরা লেখিকা। তাঁর তুলনা এ যুগে সারা বৃহত্তর রংপুরে যে নামটি সর্বাঙ্গে আসে তিনিই হলেন দৌলতুন্নেসা খাতুন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রেরণা বহু নারী নেত্রী তাঁর নিকট থেকে লাভ করেন। এছাড়া তিনি ও ছিলেন সে সময় আমাদের ভাষা আন্দোলনের একজন সংগ্রামী উদ্যোক্তা। দৌলতুন্নেসা ১৯৯৭ সালের ৪ আগস্ট রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
চেমন আরা : ১৯৩৫ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন অধ্যাপক চেমন আরা। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক ও অধ্যাপক শাহেদ আলীর সহধর্মিণী। ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংগঠক তমুদ্দন মজলিসের সঙ্গে ১৯৪৮ সাল থেকেই চেমন আরা সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। এ সময় থেকেই তিনি সভা ও মিছিলে যোগদান শুরু করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে চেমন আরা ইডেন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী হয়ে নেতৃত্ব দেন। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শহীদ বরকতের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে যে মিছিল বের হয়, সে মিছিলে চেমন আরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন।
শামসুন নাহার আহসান : জন্ম ১৯৩২ সালে ১১ মে বরিশাল জেলার আলোকান্দায়। ৫২ এর ভাষা আন্দোলনে ঢাকার রাজপথে সহপাঠীদের প্রায় সব ছাত্র মিছিলে ও পিকেটিংয়ে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালের ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন থেকে যে সব মিছিল ও সমাবেশ হয়েছিল প্রায় সব মিছিলেই শামসুন নাহার অংশগ্রহণ করেন। তিনি বহু বছর সিদ্ধেশ্বরী গালর্স কলেজে অধ্যাপনা করেন।
ড. হালিমা খাতুন : জন্ম ১৯৩৩ সালের আগস্ট মাসে বাগের হাট জেলার বাদেকা পাড়া গ্রামে। ১৯৫১ সালে বাগেরহাট প্রফুল্ল কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন লাভের পর সে বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমএ শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই সময়ই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের লক্ষ্যে তিনি প্রস্তুতিমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং একুশের সকালে তার দায়িত্ব ছিল পিকেটিং করা। আহত ভাষা সৈনিকদের চিকিৎসা ব্যায় বহন এবং সে সময় সহকর্মীদের নিকট থেকে তিনি চাঁদা তুলেন। ভাষা আন্দোলনের পুরো সময় তিনি এভাবেই কাজ করেন। কর্মজীবনে তিনি খুলনা গালর্স কলেজ, রাজশাহী কলেজ ইনস্টিটিউটে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। ড. হালিমা খাতুন শিশু-কিশোরদের জন্য বহু বই লিখেছেন।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সেই সংগ্রাম মূখর দিনগুলোতে নারী সমাজের সক্রিয়ভাবে আরো যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন-
বেগম সুফিয়া কামাল, সানজিদা খাতুন, সৈয়দা লুৎফুন্নেসা খাতুন, রাণী ভট্টাচার্য, নুর জাহান বেগম, মাহমুদা খাতুন, বেগম জাহানারা মতিন, সারা তৈফুর, সোফিয়া খাতুন, জোবেদা খাতুন, রাবেয়া খাতুন, মিসেস কাজী মোতাহার হোসেন, সৈয়দা শাহরে বানু চৌধুরীসহ আরো অনেক নাম না জানা নারী। এসব নারীর সক্রিয় আন্দোলনে আজ আমরা আমাদের মায়ের মধূর ভাষায় কথা বলতে পারছি।
১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা আন্দোলনের যে সব নারীরা জীবন কে বাজী রেখে তুচ্ছ জ্ঞান করে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা মায়ের ভাষাকে ছিনিয়ে এনেছেন, ইতিহাসের যুগ সন্ধিক্ষণে তাঁদের আজ আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন