হিজরী সনের প্রথম মাস মুহাররম। মহাররম শব্দের অর্থ হলো হারাম, নিষিদ্ধ ও পবিত্র। মুহাররম মাসসহ আরো তিনটি মাস গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদা সম্পন্ন মাস। এরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর কাছে মাস গণনায় বারোটি, এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত।’ (সূরা তাওবা:৩৬)। এ চারটি মাস হলো, ১ মুহাররম, ২. রজব, ৩. যিলকদ, ৪. যিলহজ¦। এ মাস গুলোতে আরব দেশে যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রক্তপাত বন্ধ থাকতো। এ চার মাস আরব দেশে শান্তি বিরাজ করতো বিধায়, এ সময়ে মানুষ হজ ও ওমরা পালন করতো। এরশাদ হয়েছে, ‘একটি সম্মানিত মাসের পরিবর্তে একটি সম্মানিত মাস, এ সম্মানিত মাসসমূহেও প্রতিশোধ বৈধ হবে; যদি কেউ তোমাদের ওপর হস্ত প্রসারিত করে তাহলে তোমরাও তাদের ওপর তেমনি হস্ত প্রসারিত করে জবাব দাও, তবে আল্লাহকে ভয় করতে থাকো, নিশ্চয় আল্লাহ তাকওয়াবানদের সাথে থাকেন।’ (সূরা বাকারা:১৯৪)।
মুহাররম মাসের আমলের বিশেষ ফজিলত রয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, ‘হযরত রাসূল (সা) মদিনায় এসে দেখেন যে, ইহুদীরা আশুরার দিনে রোজা পালন করে। তিনি তাদেরকে বলেন, এ দিনটির বিষয়ে কি যে তোমরা এ দিনে রোজা পালন কর? তারা বলল, এটি একটি মহান দিন। এ দিনে আল্লাহ তায়ালা মূসা (আ) ও তার জাতিকে পরিত্রাণ দান করেন এবং ফেরাউন ও তার জাতিকে নিমজ্জিত করেন। এ জন্য হযরত মূসা (আ) কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এ দিন রোজা পালন করেন।তাই আমরা এ দিন রোজা পালন করি। তখন হযরত রাসূল (সা) বলেন, হযরত মূসা (আ) এর বিষয়ে আমাদের অধিকার বেশি। এরপর তিনি এ দিন রোজা পালন করেন এবং রোজা পালন করতে নির্দেশ প্রদান করনে।’ (মুসলিম:২৭১৪)।
রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পূর্বে আশুরার রোজা ফরজ ছিলো। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর আশুরার রোজা মুস্তাহাব আমলের পর্যায়ে গণ্য করা হয়। আশুরার রোজা পালন করলে অফুরন্ত সাওয়াব পাওয়া যাবে। তা পালন না করলে গোনাহ হবে না। হযরত রাসূল (সা) বলেছেন,‘আমি আশা করি, আশুরার রোজার কারণে আল্লাহ পূর্ববর্তী বছরের কাফফারা করবেন।’ (মুসলিম:৮১৮)।
এ মাসে মহানবী (সা) এর দৌহিত্র হযরত হোসাইন (রা) ও তার সঙ্গী সাথীদের বর্বরোচিতভাবে শহীদ করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুহাররম তথা কারবালা বা আশুরার ইতিহাস নতুনভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। এ মাসে আরো কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনার তথ্য পাওয়া যায়। মুহাররম মাসে আল্লাহতায়ালা পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। মুহাররম মাসেই হযরত আদম (আ) ও হযরত হাওয়া (আ) নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে জান্নাত থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। আল্লাহতায়ালা এ মাসে হযরত আদম (আ) ও হযরত হাওয়া (আ) এর তওবা কবুল করেছিলেন। হযরত ইউনুছ (আ) চল্লিশ দিন মাছের পেটে থাকার পর মুক্তি পেয়েছিলেন। হযরত ইয়াকুব (আ) তার প্রিয় পুত্র হযরত ইউসূফ (আ) এর সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। হযরত সোলায়মান (আ) হারানো রাজত্ব ফিরে পেয়েছিলেন। হযরত নুহ (আ) মহাপ্লাবন থেকে বাঁচতে বিশাল আকারের কিস্তি তৈরী করেছিলেন। হযরত ইব্রাহিম (আ) কে নমরূদের আগুন থেকে রক্ষা করেছিলেন। হযরত আইয়ুব (আ) কুষ্ঠু রোগ মুক্ত হয়েছিলেন। ফেরাউন দলবলসহ নীল নদে ডুবে নিহত হয়েছিল।
কারবালার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে, মুসলমানদেরকে সকল প্রকার বিভেদ ভ‚লে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা তাদের মতো হয়ে যেয়ো না, যাদের আল্লাহর পক্ষ থেকে সুষ্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও তারা ভিন্ন ভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং বিভিন্ন ধরনের মতানৈক্য সৃষ্টি করেছে; এরাই হচ্ছে সেসব মানুষ যাদের জন্য কঠোর শাস্তি রয়েছে।’ (সূরা আল ইমরান: ১০৫ )। ‘তোমরা কল্যণমূলক ও খোদাভীরুতার কাজে পরষ্পর সহযোগী হও, মন্দ ও সীমা লঙ্ঘনের কাজে পরস্পর সহযোগী হয়ো না।’ ( সূরা মায়েদা:২)।
মুহাররম মাসের গুরুত্ব অনুধাবন করে, দৃঢ়তার সাথে আমল করলে, আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই আমাদের পূর্বেকার পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। তাই আমাদেরকে বেশি বেশি নফল রোজা, নফল নামাজ ও তাসবিহ তাহলিল পাঠ করতে হবে। মুহাররম উপলক্ষে হায় হোসেন, হায় হোসেন বলে কান্নাকাটি করা, বুক চাপড়ানো, বেøড বা ছুড়ি দিয়ে আঘাত করা, নিজের শরীর থেকে চাবুক মেরে রক্ত বাহির করা, খালি পায়ে হাটা ইত্যাদি মনগড়া কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। আল্লাহ তায়ালা সকলকে তৌফিক দান করুক। আমীন।
(লেখক: ইসলামিক চিন্তাবিদ ও গবেষক )
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন