আসামে চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জী বা এনআরসি নিয়ে হতাশ ক্ষমতাসীন বিজেপি থেকে বিরোধী দল ও সাধারণ মানুষ। তালিকা থেকে বাদ পড়াদের মনে বিরাজ করছে চরম আতঙ্ক। এ পরিস্থিতিতে নতুন করে আবারো ‘এনআরসি’ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এ বিষয়ে ভারতের প্রথম সারির সংবাদ মাধ্যম ‘দ্য হিন্দু বিজনেস লাইন’ এর প্রকাশিত সম্পাদকীয় তুলে ধরা হলো-
চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জী থেকে বাদ দেয়া হয়েছে ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জনকে। সীমান্তবর্তী এই রাজ্যে এটা হলো ভয়াবহ দ্বন্দ্ব, সংঘাতের এক আতঙ্কের সূচনামাত্র। এসব ‘রাষ্ট্রহীন মানুষগুলোকে’ নিয়ে কি করা হবে সে বিষয়ে দৃশ্যত রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো পরিকল্পনা বা ধারণা নেই। বাদ পড়া ব্যক্তিরা নিজেদেরকে ভারতীয় হিসেবে প্রমাণ করতে সময় পাবেন ১২০ দিন। তারা যদি তা না পারেন, আসাম থেকে প্রকাশিত রিপোর্টগুলো যদি সত্য হয়, তবে তাদেরকে রাখা হবে ১১টি বন্দিশিবিরে। এসব বন্দিশিবির রাজ্য সরকার আগামী কয়েক মাসের মধ্যে নির্মাণ করবে বলে বলা হয়েছে।
আসামের অর্থমন্ত্রী হিমান্ত বিশ্ব শর্মার মতো সিনিয়র মন্ত্রীরা অবশ্য এমন কোনো বন্দিশিবির নির্মাণ করার কথা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, এ রকম একটি এক্সক্লুসিভ বন্দিশিবির, যা গোয়ালপাড়ায় নির্মাণ করা হচ্ছে। আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য তা যথেষ্ট। এমনিতেই রাজ্যে আছে ৬টি বন্দিশিবির। তার সঙ্গে অধিকন্তু আরো ১১টি এক্সক্লুসিভ বন্দিশিবির নির্মাণ হতে যাচ্ছে। ১৯৫৫ সালের আসাম চুক্তির ৬-এ ধারার অধীনে যেসব ব্যক্তিকে নাগরিকত্বের বিশেষ বিধানে ‘বিদেশি বলে চিহ্নিত’ করা হয়েছে তাদেরকে বিদ্যমান ৬টি বন্দিশিবিরে রাখা হয়েছে। তাদের সংখ্যা প্রায় ১০০০। উপরন্তু ‘বিদেশি নাগরিক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এক লাখের বেশি মানুষকে। তাদেরকে আটক করা হয়নি। এর কারণ সোজা। তাহলো, এসব বন্দিশিবিরে পর্যাপ্ত স্থান সংকুলান নেই।
উদ্ভট বিষয় হলো, প্রস্তাবিত ১১টি বন্দিশিবিরে রাখা হবে অতিরিক্ত বন্দিদের। হিমান্ত বিশ্ব শর্মার মতো সিনিয়র মন্ত্রীরা অব্যাহতভাবে বলে আসছেন যে, নিজেদের নাগরিকদের ফেরত নিতে রাজি করানো উচিত বাংলাদেশকে। এটি হলো অনিশ্চয়তায় ভরা একটি বিবৃতি। কারণ যেসব মানুষ ভারতীয় নাগরিকত্ব দাবি করছেন তাদেরকে ফেরত নেয়ার জন্য প্রতিবেশী দেশটিকে করানো কার্যত অসম্ভব। বাস্তব অর্থে এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে থাকার স্থান দেয়া, খাওয়ানো, পোশাক দেয়া এবং আটক করা অথবা তাদেরকে সীমান্ত দিয়ে ঠেলে দেয়া স্বাভাবিক ভাবেই সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে যা ঘটতে পারে তা হলো, আসামে এমনিতেই বিদ্যমান ১০০ ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল। এর ওপর ডিসেম্বর নাগাদ আরো অতিরিক্ত ৪০০ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করা হবে। এসব আদালতে বাদ পড়া ব্যক্তিদের আপিল শুনানি শুরু হবে। এ সময়ের মধ্যে বিজেপি যা করতে পারে বলে মনে হচ্ছে তা হলো, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আনতে পারে। এর মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের পুনর্বাসন করা হতে পারে, যারা এনআরসি থেকে বাদ পড়েছেন।
সাম্প্রদায়িক এই পৃথকীকরণে আসামের নাগরিক বনাম বাংলাদেশিদের মধ্যে একটি বড় ধরনের বিচ্যুতি দেখা দেয়ার ঝুঁকি আছে। ১৯৮০’র দশকে এমনই এক বিচ্যুতি এই রাজ্যে আসামের উপ-জাতীয়তাবাদ উস্কে দিয়েছিল এবং তা থেকে ভয়াবহ এক সহিংস আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এক্ষেত্রে সর্বোত্তম উপায় হলো এনআরসি নতুন করে করা, যাতে শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া অধিক অর্থপূর্ণ হয় এবং সমাধানটা হয় অধিক বাস্তবসম্মত ও মানবিক। ধর্মীয় ও জাতিগত জটিলতার বিষয়টি মাথায় রেখে বহুবিধ দিক থেকে অভিবাসনের বিষয়টি দেখা উচিত। সীমান্তের অন্যপাড়ে যে হতাশা তা প্রশমনে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা উচিত বাংলাদেশকে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন