শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অভ্যন্তরীণ

ছই তোলা গরুর গাড়িতে নাইয়রি আর চড়ে না

প্রকাশের সময় : ১৩ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শফিকুল ইসলাম বেবু, কুড়িগ্রাম থেকে : ওকি গাড়িয়াল ভাই হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারী বন্দরে-শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের হৃদয় পাগল করা এই গান এখন আর মানুষের কণ্ঠে কণ্ঠে ফেরে না। নকশা করা ছই তোলা গরুর গাড়িতে চড়ে নাইয়রি এখন বাপের বাড়ি যায় না। হৈ হৈ হট হট গাড়িয়ালের চিৎকারে ক্যাচ ক্যাচ শব্দ তোলা মাল বোঝাই গাড়ি নিয়ে গলায় ঝোলানো ঘণ্টা বাজিয়ে আর ছোটে না গরুর দল। কিংবা শিল্পচার্য জয়নুল আবেদীনের আঁকা সেই বিখ্যাত ছবির মতো কাদায় আটকে পড়া মাল বোঝাই করা গরুর গাড়ির চাকাও কেউ ঘাড় দিয়ে ঠেলে তোলে না। আর তাই বংশ পরম্পরায় গাড়িয়াল আজিম উদ্দিন হাবিবের মতো হাজার হাজার গাড়িয়াল পেশা বদলে কেউ এখন দিন মজুর, কেউ রিক্সা চালক। তাদের কণ্ঠে ভাসে আমি এখন রিক্সা চালাই শহরে। উত্তর জনপদের একেবারেই উত্তর ঘেঁষে ‘বাহের দেশে’ এই আদি যানটির প্রচলন আগে থেকেই বেশি। মালামাল পরিবহন, নাইয়রি আনা-নেয়া, বিয়ে সহ দূর অঞ্চলে যাতায়াতে গরুর গাড়ি ব্যবহার হয়ে আসছে সেই আদিকাল থেকে। এমন কি রাজা, বাদশারাও যুদ্ধ ক্ষেত্রে রসদ পরিবহনের জন্য এই যানটি ব্যবহার করতেন বলে শোনা যায়। মাত্র কিছুদিন আগেও সুপ্রশস্ত জেলা বোর্ডের কাঁচা সড়ক ধরে ষাট সত্তরটি গরুর গাড়ির বহর পাট, ধান, খয়ের বোঝাই করে সারিবদ্ধভাবে ধুলো উড়িয়ে যেতো সেই বিখ্যাত চিলমারীর বন্দরে। গাড়িয়ালদের কণ্ঠে ফিরতো গান। কৃষি প্রধান এই এলাকার মানুষের প্রধান ফসল ছিল পাট, ধান ও খয়ের। আর ছিল দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যাদি যেমন ঘোল, ঘি, মাখন ও দই। নিম্নবিত্তের লোকেরা দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যাদি বিক্রয় থেকে উপার্জন দিয়েই চালাতো। মধ্যবিত্তরা করত পাটের ব্যবসা। পাট ব্যবসারও আগে ছিল খয়েরের ব্যবসা, আর তারও আগে ছিল রেশম ব্যবসা। সেকালে এসব মালামাল পরিবহনের একমাত্র বাহন ছিল গরুর গাড়ি। ফলে গরুর গাড়ির কদর ছিল প্রশ্নাতীত। একে ঘিরে গড়ে উঠেছিল হাজার হাজার মানুষের জীবিকা। শুধু তাই নয়, প্রায় গৃহস্থ বাড়িতে নিজেদের ব্যবহারের জন্য ছিল গরুর গাড়ি। বাংলা বিশ্ব কোষ থেকে জানা যায়, ব্রঞ্জ যুগে পূর্ব গোলার্ধে কুমারের চাকা এবং গাড়ির কঠিন কাঠ নির্মিত চাকতির মতো চাকা সর্ব প্রথম মানুষের ব্যবহারে আসে। খ্রিস্ট পূর্ব আনুমানিক ২৭০০ অব্দে দÐ লাগানো চাকার প্রচলন হয়। প্রতœতাত্তি¡ক গবেষণামূলক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, মিসরীয় ব্যাবিলন এবং ভারতের প্রাচীন সভ্যতায় চাকাওয়ালা গাড়ি ছিল। এ থেকে বলা যায় চাকার প্রাথমিক আবিষ্কার প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার বছর আগে হয়েছিল। পাঁচ ছয় হাজার বছর আগে কাঠ, পাথর, মালপত্র এবং নানা রকম শিল্পকলার নিদর্শন বয়ে নিয়ে যাওয়া হতো চালু পথে গোলাকৃতির কাঠের গুঁড়ির ওপর দিয়ে। এই কাঠের গুঁড়ি থেকেই মানুষের মাথায় চাকার ধারণা আসে। একটি বসবার জায়গা তৈরি করে তার দুদিকে দুটো চাকা জুড়ে দিয়ে তৈরি করা হয় গাড়ি। এই গাড়ি টানার কাজে ব্যবহার হতো গরু, ঘোড়া ও মানুষ। এর চাকাতে লোহার ও অন্যান্য ধাতুর বেড় লাগানো চালু হয়। এই উপমহাদেশের পাকিস্তানের পাঞ্জাবের মন্টগোমারি জেলার হরপ্পা এবং সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলার মোহঞ্জোদরোর পাঁচ হাজার বছর আগের সভ্যতায় মাটির চাকা লাগানো গরুর গাড়ির প্রচল থাকার নিদর্শন পাওয়া গেছে। এ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় সেই আদিকাল অর্থাৎ চাকা ও গাড়ি আবিষ্কারের সময় থেকেই এতদাঞ্চলেও তার প্রচলন ছিল। প্রাচীনকালে এখানকার বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্ব অংশ বঙ্গ নামে পরিচিত ছিল। উত্তর অংশকে বলা হতো পুন্ড্র বা বরেন্দ্র। ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে ছিল রাঢ় অঞ্চল। গৌড় বলতে বোঝাত উত্তর ও পশ্চিম বঙ্গকে। দু’ হাজার বা তারও আগে সমগ্র উত্তর বঙ্গ ছিল বিরাট রাজার অধীনে। বিরাট রাজা লক্ষাধিক গরু পুষতেন বলে জানা যায়। সে সময় বড় বড় জাতের গরু রাজার মালামাল পরিবহনের গাড়ি টানার কাজে লাগানো হতো। গোবিন্দগঞ্জ ভবানীগঞ্জ থেকে ডিমলা জলপাইগুড়ি পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা ছিল বিরাট রাজার গো পালনের চারণ ভূমি। এ সময় গো যান বা গরুর গাড়ির চাকায় লৌহবর্ত ছিল না। কেবল কাঠের গোলক ছিল। দরিদ্র জনগোষ্ঠী যখন এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে মূলত তারাই লৌহার ব্যবহার চালু করে এবং চাকায় লৌহ পন্ডু লাগায়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গরুর গাড়ি এতদাঞ্চলের প্রধান বাহন হিসেবে প্রচলিত থাকে। ১৬৪৬ সালে সাইকেল আবিষ্কার, রেলপথ প্রবর্তন মূলত যোগাযোগ ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন ঘটায়, ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশে লর্ড ডালহৌসির সময় রেলপথ প্রবর্তিত হলেও সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া এ অঞ্চলেও এসে লাগে। এরপর মোটরগাড়ি ট্রাকসহ নানা ধরনের যান্ত্রিক যানবাহন একের পর এক তৈরি হতে থাকলে ক্রমেই গরুর গাড়ির কদর কমতে থাকে। রাস্তা ঘাটের প্রস্তুত উন্নয়নের কারণে এসব যান্ত্রিক বাহন এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিস্তৃতি লাভ করেছে। হাল আমলে শ্যালো ইঞ্জিনের বহুমুখী ব্যবহারের কারণে গরুর গাড়ি এখন বিলীন হওয়ার পথে। সেই সঙ্গে গো-খাদ্যের ও চারণ ভূমির অভাবে গরু প্রতিপালন কষ্টকর হয়ে পড়ায় গো-সম্পদও হ্রাস পাচ্ছে। এসব মিলিয়ে গরুর গাড়ি আজ জাদুঘরে রেখে দেয়ার পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। অথচ কুড়িগ্রামে একদা গরুর গাড়ির চলমান সারিবদ্ধ রূপ সৃষ্টি করতো উদাসীনভাব। গাড়ির ক্যাচ ক্যাচ শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গাড়িয়ালের গাওয়া গান, গরুর খুরের সঙ্গে ওড়া ধুলি রাশি, আশপাশে বট, পাকুর, অর্জুনের সারি, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষকের কুঁড়েঘর, বাঁশঝাড় এসব ছিল আবহমান বাংলার মাটি গন্ধ-মাখা পরিবেশের মৌলিক রূপ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন